শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণেও বিপদ

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আওয়ার ইসলাম : ৮০ র দশকেও দেশে পরিবারপিছু পাঁচ-ছয়টি করে সন্তান খুব চেনা দৃশ্য ছিল। সীমিত সম্পদের দেশে বিস্ফোরিত জনসংখ্যার চাপ ছিল অন্যতম দুশ্চিন্তার কারণ। সে সময় জনপ্রিয় স্লোগান ছিল ‘ছেলে হোক, মেয়ে হোক, দুটি সন্তানই যথেষ্ট’। পরে তা আরো সংশোধন করে চালু করা হয়, ‘দুটি সন্তানের বেশি নয়, একটি হলে ভালো হয়’। তবে ধীরে ধীরে পরিস্থিতি বদলেছে। যৌথ পরিবার ভেঙে গেছে, মানুষ নগরমুখী হয়েছে।

জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ এবং মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় জন্মহার কমেছে। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৫ সালে দেশে গড় প্রজনন হার ছিল ৬.৩, ২০১১ সালে তা নেমে এসেছে ২.৩-এ। দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে তা ২-এর নিচেও নেমে গেছে। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ৩ শতাংশ। ২০১১ সালের হিসাব অনুযায়ী তা কমে হয়েছে ১.৩৪ শতাংশ।

তবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির রাশ টেনে ধরার উল্টো পিঠও আছে, যা জনসংখ্যাবিদসহ সংশ্লিষ্টদের ভাবিয়ে তুলেছে। তাঁরা বলছেন, গড় প্রজনন হার ২-এর নিচে নেমে গেলে অদূর ভবিষ্যতে অস্বাভাবিক হারে জনসংখ্যা কমে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হবে। সে ক্ষেত্রে ৩০ বছরের মধ্যেই দেশে মাথাভারী জনসংখ্যা বা বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সংখ্যা অত্যধিক বেড়ে যেতে পারে। তখন নবীন-প্রবীণে ভারসাম্য থাকবে না। কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী কমে যাবে। প্রবীণরা দেশের ও জাতির জন্য বোঝা হয়ে দেখা দেবে, কারণ কর্মক্ষমতা হারানোর পাশাপাশি তাদের চিকিৎসা-পুনর্বাসন বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। তাই বিশেষজ্ঞরা গড় প্রজনন হার ২-এর মধ্যে ধরে রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।

জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ কে এম নুর-উন-নবী বলেন, এখন বাংলাদেশে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের চেয়ে জনসংখ্যার সার্বিক ব্যবস্থাপনায় গুরুত্ব দেওয়া বেশি জরুরি। নয়তো বিপদ বেশি দূরে নয়। বিশ্বের অনেক দেশই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নিতে গিয়ে উল্টো বিপদে পড়েছে। কোথাও কোথাও বাধ্য হয়ে জনসংখ্যার ভারসাম্য রক্ষায় অন্য দেশ থেকে মানুষ ধার করতে হয়েছে। বাংলাদেশে এখন ‘পজিটিভ পপুলেশন গ্রোথ’ একেবারেই ভারসাম্যের শেষ সীমায় চলে এসেছে। এমনকি খুলনা-রাজশাহীতে প্রজনন হার জাতীয়ভাবে প্রত্যাশিত হারের চেয়েও নিচে নেমে ১.৯-এ ঠেকেছে। ঢাকা বিভাগেও যদি প্রজনন হার কোনোভাবে নিম্নগতির হয়ে যায় তবে তা দেশের জন্য অবশ্যই ‘নেগেটিভ গ্রোথ’ হয়ে উঠবে।

অধ্যাপক এ কে এম নুর-উন-নবী বলেন, বর্তমানে গড় প্রজনন হার ২.৩। এ হারে জনসংখ্যা বাড়লে ২০৪৭ সাল নাগাদ দেশে অপ্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর তুলনায় প্রবীণদের সংখ্যা বেড়ে যাবে। অর্থাৎ নবীন-প্রবীণে

ভারসাম্য থাকবে না। তখন বয়স্ক ব্যক্তিরা দেশের ও জাতির জন্য বোঝা হয়ে দেখা দেবে। কারণ একদিকে তারা কর্মক্ষমতা হারাবে, অন্যদিকে তাদের চিকিৎসা-পুনর্বাসন বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। দেশে এখন মোট জনসংখ্যার ৬৮ শতাংশের বেশি মানুষই কর্মক্ষম, যাদের মধ্যে বড় অংশই তরুণ। ২০৪৭-২০৫০ সাল নাগাদ সম্ভাব্য জনসংখ্যা হবে ২২ কোটি। তখন কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী কমে যাবে, প্রায় সাড়ে চার কোটি প্রবীণ জনগোষ্ঠীর চাপ সামাল দিতে হবে, যা বিপজ্জনক হয়ে উঠবে।

২০১৩ সালের এক গবেষণার বরাত দিয়ে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে দেশে প্রবীণদের মধ্যে ৫৮ শতাংশই দারিদ্র্যের শিকার, যাদের মৌলিক চাহিদা পূরণেরও সামর্থ্য নেই। যৌথ পরিবার ভেঙে যাওয়া এবং পারিবারিক ও সামাজিক নীতিগত অবক্ষয়ের কারণে প্রবীণদের প্রতি অবজ্ঞামূলক আচরণ দেখা যায়, যা মর্যাদার জায়গা থেকেও প্রবীণ জনগোষ্ঠীর জন্য কষ্টের। সামনে যত প্রবীণ বাড়বে ততই এ সমস্যা বাড়বে।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের নাম প্রকাশে আরেক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাস্তবতা হচ্ছে আমরা এখন জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের চেয়ে বরং নিরাপদ প্রজনন, প্রজনন স্বাস্থ্য, মা ও শিশুস্বাস্থ্যের প্রতিই বেশি নজর দিচ্ছি। সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে যেহেতু এখনো জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি, তাই সেদিকে জন্মনিয়ন্ত্রণের কাজে গতি আনার চেষ্টা করছি। ’

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুসারে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ১৭ লাখ ৫০ হাজার। এর আগে ২০১৫ সালের নমুনা জরিপ অনুযায়ী, দেশের  মোট জনসংখ্যা ছিল ১৫ কোটি ৮৯ লাখ। এ হিসাবে গত এক বছরে জনসংখ্যা বেড়েছে ২৮ লাখ ৫০ হাজার। সর্বশেষ হিসাব মতে, দেশে বয়স্ক জনগোষ্ঠীর হার প্রায় ৮ শতাংশ।

বাংলাদেশে সর্বশেষ আদমশুমারি হয়েছে ২০১১ সালে। পঞ্চম ওই আদমশুমারি প্রতিবেদনে জনসংখ্যা ছিল ১৪ কোটি ২৩ লাখ ১৯ হাজার। ওই তথ্যের সঙ্গে সর্বশেষ নমুনা জরিপের তথ্যের তুলনা করলে দেশে গত ছয় বছরে জনসংখ্যা বেড়েছে দুই কোটি। ২০০১ সালের আদমশুমারিতে দেশের জনসংখ্যা ছিল ১৩ কোটি ৫২ লাখ। সেই হিসাবে ২০০১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে জনসংখ্যা বেড়েছিল প্রায় দেড় কোটি। বিবিএস তথ্য অনুসারে, ২০১২ সালে দেশে গড় খানার সদস্য ছিল ৪ দশমিক ৫ জন, যা ২০১৬ সালে নেমে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৩ জনে।

সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনসংখ্যা উল্টো পথে হাঁটার ঝুঁকির নেপথ্যে একসঙ্গে বেশ কিছু বিষয় কাজ করেছে। এর মধ্যে চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নতি, গড় আয়ু বেড়ে যাওয়া, মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার কমে যাওয়া, শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধি, আয় বৃদ্ধি, জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এর সঙ্গে সরকারের পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের কার্যক্রমও সহায়ক হিসেবে ভূমিকা রাখছে।

অধ্যাপক নুর-উন-নবী ভবিষ্যতের ঝুঁকির কথা মাথায় রেখে প্রবীণদের জন্য এখনই সরকারের উদ্যোগী ভূমিকা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, ২০১৩ সালে ষাটোর্ধ্বদের সিনিয়র সিটিজেন ঘোষণা করা হয়েছে; যদিও এখনো তা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। এ ছাড়া ২০১৩ সালেই সন্তানের জন্য মা-বাবার ভরণ-পোষণ আইনও পাস হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সের অধ্যাপক আমিনুল হক বলেন, জনসংখ্যার স্থিতি বর্তমানে যেখানে আছে, তার চেয়ে আরো কমে গেলে বিপদ আসতে পারে। ‘দুটি সন্তানের বেশি নয়’ জনসংখ্যার এ নীতি ঠিক আছে। কিন্তু চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ওই নীতি বাস্তবায়ন নিয়ে। নীতির যেসব খাতে নজর দেওয়া অপরিহার্য সেগুলোতে কতটা নজর দেওয়া হচ্ছে সেটা দেখা দরকার।

এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘আমাদের মূল সমস্যা জনসংখ্যার চেয়ে জায়গার। যে পরিমাণ জায়গা আছে তা যথাযথ পরিকল্পনার মাধ্যমে কাজে লাগাতে পারলে এ জনসংখ্যাই শক্তিতে পরিণত হবে। বিশেষ করে সুষ্ঠু নগরায়ণ ও জন ব্যবস্থাপনা এবং অবকাঠামো তৈরি করা জরুরি। কোন এলাকায় কত মানুষ বসবাস করবে, তা ঠিক করে দেওয়া, সেখানে কী পরিমাণের অবাসন-রাস্তাঘাট প্রয়োজন হবে, তা আগে পরিকল্পনা করার সময় এসেছে। ’

অধ্যাপক নুর-উন-নবী বলেন, গড় প্রজনন হার দুইয়ে রাখাটা খুবই যুক্তিযুক্ত নীতি। এটাকে কার্যকর রাখতে, বিশেষ করে যাতে না বাড়ে কিংবা না কমে এমন পর্যায়ে রাখতে এখন থেকেই পরিকল্পিতভাবে কাজ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে নারীশিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন ও স্বাবলম্বী হওয়ার উদ্যোগগুলো জোরালো করতে হবে।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. কাজী মোস্তফা সরোয়ার বলেন, ‘এখন যে হার আছে, তাতেই ২০৩০ সাল নাগাদ দেশে বয়স্ক জনগোষ্ঠী বেড়ে যাবে, তরুণের সংখ্যা কমতে থাকবে। তাই প্রজননহার এখন যে অবস্থায় আছে সেটাই স্থিতিশীল পরিস্থিতি; যদিও আগে থেকেই আমাদের প্রজননহার দুইয়ে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা আছে, এখন যা আছে ২ দশমিক ৩। আমরা লক্ষ্যমাত্রা পর্যন্ত এগিয়ে যাব, তারপর যাতে আর না কমে বা তখন কী করণীয় তা ঠিক করব। অবশ্য এরই মধ্যে কোনো কোনো অঞ্চলে প্রজননহার দুইয়ের নিচে নেমে গেছে, আবার কোথাও বেশি আছে। সেদিকে নজর রেখে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। ’

-এজেড


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ