রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


নতুন শিক্ষাবর্ষ: নবীন শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে কয়েকটি কথা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মাওলানা মুহাম্মাদ লুতফেরাব্বী

শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। আর শিক্ষক সেই জাতির পথপ্রদর্শক। পাশের হার বৃদ্ধি বা ছাত্রছাত্রী সংখ্যা শিক্ষার উন্নতির মাপকাঠি নয়, বরং শিক্ষক –ছাত্র–সিলেবাস সকল পর্যায়ে সফলতাই একটি আদর্শ শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারে।

আরবিতে একটি প্রবাদ রয়েছেঃ تَربَّى قبل أن تُربِّي  "অন্যকে আদর্শ শেখানোর আগে নিজে আদর্শবান হও''। তাই প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতার পাশাপাশি নৈতিক –চারিত্রিকভাবেও একজন শিক্ষকের উত্তীর্ণ হওয়া আবশ্যক। বিশেষতঃ যারা ইলমে ওহীর শিক্ষাদানের মহান দায়িত্ব কাঁধে নিবেন তাদের জন্য এই আবশ্যকীয়তা আরো বহুগুণ বেশি। কারণ তারা সভ্য জাতি বিনির্মাণের কারিগর এবং সুশিক্ষাই সভ্যতার মূল স্তম্ভ।

নিম্নে একজন আদর্শ ও সফল শিক্ষকের কিছু গুণাবলি উল্লেখ করা হলো

আত্মিক পরিশুদ্ধি: একজন শিক্ষকের হৃদয় – মনে যখন স্বচ্ছতা ও খোদাভীতি থাকবে তখন সে শিক্ষাদানের দায়িত্বকে নিছক পেশা হিসাবে নয়, ব্যক্তি ও সমাজ বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হিসাবে গন্য করবেন। এতে করে তিনি তার উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথ পালনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে সচেষ্ট হবেন।

মানসিক দৃঢ়তা: শিক্ষাদানের সময় একজন শিক্ষককে বিভিন্ন রকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। এসব পরিস্থিতি সফলভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য মানসিক দৃঢ়তা থাকা প্রয়োজন। হাদিসে ইরশাদ হয়েছেঃ ''পেশীশক্তি প্রকাশকারী শক্তিশালী নয়, প্রকৃত শক্তিশালী হলো, যে রাগের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে''। ( বুখারি, মুসলিম)

দুর্বল চিত্তের মানুষ দ্রুত রেগে যায় এবং তার কথায় – কাজে মিল পাওয়া যায়না। এতে করে তার থেকে মিথ্যা, ওয়াদাভঙ্গ সহ নানা রকম ত্রুটি প্রকাশ পেতে থাকে। তাই একজন আদর্শ শিক্ষকের জন্য মানসিকভাবে দৃঢ় ও স্থিরচিত্ত হওয়া উচিৎ।

বাহ্যিক শালীনতা: পোশাক –পরিচ্ছেদ ও বেশভূষায় ভদ্র –মার্জিত হওয়া শিক্ষকের জন্য অপরিহার্য বিষয়। ছাত্রদের শ্রদ্ধা অর্জন ও সর্ব মহলে গ্রহণযোগ্যতার জন্য এটি অতি প্রয়োজনীয়।

এ প্রসঙ্গে ইমাম বদরুদ্দিন জামা'আ বলেন, "শিক্ষক যখন তার দরসে উপস্থিত হওয়ার ইচ্ছা করেন তখন তার করণীয় হলো, পরিষ্কার –পরিচ্ছন্ন হয়ে সুগন্ধি ব্যবহার করবেন এবং 'তার সমাজে গ্রহণযোগ্য' সর্বোত্তম পোশাক পরিধান করবেন। এর উদ্দেশ্য হলো ইলমের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা।

ইমাম মালেক রহ, এর হাদিসের দরস প্রদানের সময় হলে গোসল করে সুগন্ধি লাগাতেন এবং উত্তম পোশাক পড়ে মাথায় পাগড়ি বাঁধতেন। অতঃপর দরসে বসতেন। দরস শেষ না হওয়া পর্যন্ত সুগন্ধি উ'দ জ্বালানো হত। তিনি বলতেন, (এসবের মাধ্যমে) আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিসের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করছি''।

চারিত্রিক উৎকর্ষ: প্রতিটি শিক্ষক তার ছাত্রদের জন্য আইডল বা নমুনা। বিশেষতঃ শিশুরা সর্বক্ষেত্রে তার শিক্ষকের অনুকরণপ্রিয় হয়। তার উঠাবসা, খাওয়া দাওয়া, আচার ব্যবহার সব কিছুই তারা ফলো করে এবং সে অনুযায়িই বেড়ে উঠে। তাই একজন শিক্ষকের এই বিষয়ে অত্যন্ত বেশি সচেতন হওয়া উচিৎ।

ইমাম ইবনে আব্দিল বার রহ. বলেন, একজন আলেমের পরিপূরক গুণাবলীর অন্যতম হলো- ''তিনি ধীরস্থির ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হবেন। উচ্চবাচ্য, ঝগড়া বিবাদ, অহেতুক খেলাধুলা, অনর্থক কাজ ও মূর্খের সাথে বিতর্ক থেকে বিরত থাকবেন। বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ ইসলামী শিষ্টাচার মেনে চলবেন। অপ্রয়োজনীয় কথা বলবেন না এবং কোন প্রশ্ন ভালোভাবে না বুঝে উত্তর দিবেন না''।

ব্যক্তিগত এসব গুণাবলীর পাশাপাশি ছাত্রের প্রতি স্নেহ–মমতা ও ভালবাসার প্রকাশ জরুরি। ইমাম ইবনে জামা'আর মতে, '' ওই শিক্ষকই ছাত্রের উপর প্রভাব ফেলতে পারেন যিনি তাদের আদর-স্নেহ করেন এবং পড়ালেখায় খুশি হোন। নরম ও কোমল পন্থায় তাদের শিক্ষাদান, চরিত্র গঠন ও যেকোন সমস্যার সমাধানে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করেন''।

যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা অর্জন: নির্ধারিত পাঠ্যসূচি ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রয়োজনীয় জ্ঞান থাকা শিক্ষকের জন্য অপরিহার্য বিষয়। কারণ এটা তার কাজের প্রধানতম শর্ত। শিক্ষক হওয়া মানে আর জ্ঞানার্জনের কিছু নেই, কখনোই এমনটি ভাবা উচিৎ না।

ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারাক রহ. কে একজন জিজ্ঞেস করল- ''আপনি কতদিন পর্যন্ত ইলম অর্জন করবেন? তিনি বললেন, মৃত্যু পর্যন্ত ইনশাআল্লাহ''।

বর্তমান প্রযুক্তির উৎকর্ষের যুগে ছাত্ররা সিলেবাসের বাইরেও বিভিন্ন বিষয়ে জানতে ইচ্ছুক থাকে। তাদের এসব প্রশ্নের সদুত্তর দেয়ার জন্য বহুমুখী জ্ঞান থাকাও জরুরি হয়ে পড়েছে। এ বিষয়গুলো মাথায় রেখে একজন শিক্ষকের যোগ্যতা অর্জনে সচেষ্ট হওয়া উচিৎ।

দায়িত্বের অনুভুতি: সহিহ বুখারীতে এসেছে- রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ''তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকেই তার অধীনস্তদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে''। অন্য হাদিসে এসেছে, "আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক দায়িত্বশীলকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন, সে কি তা যথাযথ আদায় করেছে না নষ্ট করেছে''।

তাই একজন শিক্ষকের কর্তব্য হলো, আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার নিয়তে সর্বদা অর্পিত দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থাকা।

উপরে শিক্ষকতার মৌলিক কিছু গুণাবলি আলোচনা হলো। এছাড়াও ছাত্র গঠন, পাঠদান পদ্ধতি ইত্যাদি বিষয়ে অনেক শর্ত ও গুণাবলি রয়েছে। এগুলো যথাযথভাবে আয়ত্ব করার মাধ্যমেই একজন শিক্ষক আদর্শ ও সফল হতে পারবেন।

তথ্যসূত্র
জামিউ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাদলিহি
তাযকিরাতুস সামি' ওয়াল মুতাকাল্লিম ফি আদাবিল আলিমি ওয়াল মুতাআল্লিম

লেখক: শিক্ষার্থী, আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়

কওমি মাদরাসায় শুরু হচ্ছে ভর্তিযুদ্ধ, যেভাবে প্রস্তুতি নিবেন


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ