এম. মাহমুদ খান
ফ্রান্স, প্যারিস থেকে
"এখন যৌবন যার, মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।" হাঁটি-হাঁটি পা-পা থেকে শৈশব, কৈশোর, যৌবন। মহান আল্লাহর এক অপার কৃপা। মানুষ মরণশীল। সে যেই ধর্মেরই অনুসারী হোক না কেনো। সৃষ্টিকর্তার নির্ধারিত নিয়মেই হবে জন্ম অথবা মৃত্যু। এরই মধ্যে মানুষ হিসাবে আমাদের প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হয় বাঁচবার জন্য। সৃষ্টিকর্তার নির্দেশেই রিজিকের সন্ধানে আমাদেরকে ছড়িয়ে পড়তে হয় জমিনে। আমিও তো মানুষ, আশরাফুল মাকলুকাত। তাই আমিও এর বাইরে নই।
২.
প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক অতঃপর বিশ্ববিদ্যালয়-পাঠ চুকিয়ে জীবন-জীবিকার তাগিদে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া। যৌবনের রঙীন স্বপ্নে বিভোর। কতশত ভাবনায় ব্যাকুল মন আমার দিকবিদিক ছোটাছুটি। পারিবারিক ঐতিহ্য ব্যবসা না-কি চাকুরি! সরকারি উপর মহলে মামা-চাচার শক্তি না থাকা এবং টাকা বা ঘুষ বিনিময়ে নিজের অনীহা। চাকুরি পাবার শতভাগ অনিশ্চিয়তা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, হানাহানি, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, পেশী-শক্তিবাজদের দৌরাত্ম্য। দুরন্ত তরুণ মনকেও সাহস দেয় না ব্যবসায় ঝাঁপিয়ে পড়তে । নিজেকে নিজে প্রশ্ন করি প্রিয় ঢাকা অর্থাৎ জন্মভূমি বাংলাদেশ কি ঐ সব অন্যায়-অনাচার অপরাধীদের দ্বারাই ঢেকে যাবে? অপরাধ এবং অপরাধী তো সারা বিশ্ব জুড়েই আছে । তবে আমার মনে এসব প্রশ্ন কেনো? মাতৃভূমি, তাই? ভাবনার সমুদ্রে হাবুডুবু খাই। সঠিক উত্তর খুঁজে পাই না।
৩.
প্রবাসের ভালো-মন্দ গল্প শুনি, জাপান প্রবাসী ভাইয়ের কাছে। খবরের কাগজের পাতায়। উন্নত দেশগুলোর জীবন ব্যবস্থা, সামাজিক ও ব্যক্তি-নিরাপত্তা, কাজের মর্যাদা সর্বোপরি আর্থিক নিরাপত্তা ও সচ্ছলতা আমার মনকে ব্যাকুল করে তোলে। মাথায় বিদেশ যাবার ভূত চেপে বসে! স্টুডেন্ট ভিসায় দেশ ছাড়বার চেষ্টায় ব্যর্থ হই। বিভিন্ন এজেন্টদের কাছে ধর্না দেই। ভিজিট- ভিসায় দেশ ত্যাগের চুরান্ত সিদ্ধান্ত নেই। আজ,কাল,পরশু করে সময় অতিবাহিত হয়। হতাশার সাগরে নিমজ্জিত প্রায়। তবুও হাল ছাড়ি না। "মেঘ দেখে তুই করিস না ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে।" দেশ ত্যাগের চেষ্টায় অটল থাকি। "তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার সোনার হরিণ চাই।" সৃষ্টিকর্তার কৃপায় সর্বশেষ প্রবাসী হবার স্বপ্ন পূরণ হয়। অনেক চড়াই- উতরাইয়ের পর। কথায় বলে, "রাখে আল্লাহ মারে কে?"
একযুগ অতিবাহিত হয়েছে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে বসবাস করছি। জীবনসঙ্গিনী ও এদেশেই জন্ম নেয়া সন্তানদের নিয়ে। এখন প্রবাসে ব্যস্ততম জীবন কাটে জীবিকা বা বেঁচে থাকার জন্য কাজ করে। কখনোবা খানিক অবসরে পরিবার-সন্তানদের সাথে গল্প-আড্ডায় অথবা জন্মভূমিতে অবস্থানরত গর্ভধারিনী 'মা', আপন ভাই-বোন, ভাতিজা-ভাতিজী-ভাগ্নীদের, নিকট আত্মীয় -বন্ধুদের সাথে টেলিফোন বা ইন্টারনেটে কথা বলে।
৪.
ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টি-কালচার, সভ্যতা এবং পৃথিবীর উন্নত ও পঞ্চম পরাশক্তির দেশ ফ্রান্সের জীবন ব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে বলার আছে বলে মনে হয় না। প্রাসঙ্গিক কারণে পুনরায় স্মরণের জন্য বলা বৈকি। যেমন সারা বিশ্বের প্রথম সারিতে থাকা এরোপ্লেন "এয়ারবাস (Airbus)", দ্রুতগতির ট্রেন "টি জি ভি (TGV)", যুদ্ধ-বিমান "রাফায়েল (Rafael)", বিখ্যাত গাড়ি "পুজো (Pegeau)", ছিতোয়েন Citroën- রনো" Renault, কসমেটিকস্ সামগ্রী "লরেয়াল পারি (L'Oréal Paris)", খ্যাতনামা সব পারফিউম "Chanel/Dior" ফ্রান্সে তৈরি হয়। পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটি, "আইফেল টাওয়ার (Tour Eiffel)", লিওনার্ডো দা ভিন্সীর অংকিত "মোনালিসার" বিখ্যাত চিত্রকর্ম ও মিসরের পৃথিবীখ্যাত "মমি" রক্ষিত প্যারিসের "লুভর মিউজিয়াম (musée du Louvre)", ইতিহাস খ্যাত "সেন নদী (Seine basin)", বাঙালী কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ক্ষনস্থায়ী বসবাসের ঐতিহাসিক "ভার্সাইয়ের রাজপ্রাসাদ (chateau de Versailles)", "ডিজনিল্যান্ড (World desney Land)" আরো কতো কী! আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার কথাতো বলাই বাহুল্য! রাতের শহর প্যারিস নগরীর মাটির নিচের পাতাল ট্রেন (Metro train) এর লাইনগুলো মাকড়সার জালের মত বিছানো। চালকহীন ১৪ নং মেট্রো রেলসহ অন্য মেট্রোগুলো (১৩টি) প্রতি ২-৩ মিনিট অন্তর অবিরাম চলছে প্যারিসের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। ভোর ৫টা থেকে রাত ১টা পর্যন্ত। রাতের বাস চলে ভোর পর্যন্ত। অপরদিকে দূরত্ব ভেদে তিন শ্রেনির রেলগাড়ি যেমন RER, SNCF ও দুরপাল্লার এবং আন্তর্জাতিক ট্রেন TGV গুলো চলাচল করছে বিভিন্ন গন্তব্যে ।
রাজধানী প্যারিসের ডাস্টবিনের ময়লাও সন্ধ্যা থেকে ভোরের মধ্যে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। রাস্তাগুলোকে ঝাড়ু দিয়ে পরিচ্ছন্নের পর পানি দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করা হচ্ছে। ফরাসি নাগরিকদের জনসচেতনতা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ট্রাফিক সিগন্যাল মানতে যেয়ে পথচারী কিংবা গাড়ি-চালক, সিগন্যাল বাতির দিকে তাকিয়ে থাকা, হোক তা গভীর রাত অথবা দিন। প্যারিসের রাস্তায় পুলিশ দেখলে কেউ ভয়ে পালিয়ে যায় না বরং পথচারী ভিজিটর অথবা জনগন পুলিশের নিকট প্রয়োজনীয় তথ্য বা সাহায্য কামনা করে। অপরদিকে রাস্তায় থু-থু ফেলা, ডাস্টবিন ব্যবহার না করা, উচ্চস্বরে কথা বলা-- ফরাসিদের দ্বারা কল্পনা করা যায় না। ছোট বড়কে অথবা বড় ছোটকে সন্মান বা রেসপেক্ট করা- অফিস কিংবা ঘরে অথবা যানবাহন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে সর্বত্র তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
০৬.
প্রিয় ঢাকার যানজট, অপরিচ্ছন্নতা নতুন কিছু নয়। এর সমাধানে চেষ্টারও কমতি নেই। তবে এ বিষয়ে জনসচেতনতা অনেকটা দায়ী। সরকার বা কর্তৃপক্ষ যেমন সঠিক নির্দেশনা দিবেন, তেমনি জনগণের স্বতঃস্ফূর্তভাবে আইন মেনে চলাই বাঞ্ছনীয়। প্রবাস জীবনে আমরা যেটা দেখি, আইনের নিরপেক্ষ ও সঠিক প্রয়োগ জনগনকে আইন মানতে বাধ্য করে। যা পরবর্তীতে অভ্যাসে পরিণত হয়। প্রবাদ আছে "মানুষ অভ্যাসের দাস।" ঢাকা নগরী ঘনবসতিপূর্ণ। এটা নতুন করে বলার না থাকলেও, রাজধানী ঢাকা-কে বাসউপযোগী রাখতে আমাদেরকে কি সত্যিকারের সভ্যতা শিখতে হবে? আমরা কি আদিম যুগের জাতি থেকে আমাদেরকে আলাদা করব না? আমাদের আচরণে, কথায় এবং কাজে? আধুনিক/ডিজিটাল যুগে শুধু দামী পোশাক পরিধান এবং কম্পিউটার-মোবাইল ব্যবহার ও ইন্টারনেট চালনাকেই সভ্যতা বা আধুনিকতা মনে করা বোকামী বৈকি। মনীষীরা বলেন, "যে জাতি যত শিক্ষিত-সচেতন, সে জাতি তত উন্নত।" প্রবাস জীবনে চলার পথে, কাজের ফাঁকে অথবা সামান্য অবসরে কেনো যেনো এসব ভাবী নিজের অজান্তেই ।
০৭.
দিন,মাস,বছর,যুগ পেরিয়ে এই আমি ফ্রান্সে বসবাস করছি। এদেশের জাতীয়তাসহ। ভোটাধিকার প্রয়োগ করছি। স্বাধীন চলাফেরা, শ্রমের মর্যাদা, ভেজালমুক্ত খাবার। মনুষ্য-সৃষ্ট ভয়হীন জীবনযাপন। অতো সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছি বটে, তবুও কেনো জানি মন ছুটে যায় জন্মভূমি সোনার বাংলায়।
বাংলাদেশের যেকোনো ভালো সংবাদে আনন্দে আপ্লুত হই। দুঃসংবাদে ব্যথিত হই। তা হোক পরিবারের অথবা মাতৃভূমির। আনমনে গুন-গুন করি "একবার যেতে দে-না আমার ছোট্ট সোনার গাঁ-য়, যেথায় কুকিল ডাকে কুহু দোয়েল ডাকে মুহুমুহু" কখনোবা "আবার আসিব ফিরে, ধান সিরির তীরে, এই বাংলায়।"
আধুনিক ও সভ্যতার উচ্চ শিখরে থাকা ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের হাওয়া গায়ে মেখেও কেনো মন আমার হারিয়ে যায় মাতৃভূমি বাংলায়? মসজিদের নগরী ঢাকায়? বায়তুল মোকাররম মসজিদ ও জাতীয় ঈদগাহে জুম'আ অথবা ঈদের জামাত। বাংলা একাডেমির একুশে বইমেলা। শহীদ মিনার ও জাতীয় স্মৃতিসৌধ। আরো কত-শত স্মৃতি,আনন্দ, বেদনা। তাইতো ছুটে যাই প্রিয়জনের অসুস্থতায়। সত্যিকার ভাবে,"নাড়ীর টানে, বাড়ীর পানে।" আবার যাওয়া হয়ে উঠে না হাজার ইচ্ছার পরও আপনজনের মৃত্যু সংবাদে। প্রবাস জীবনের নানান ঝামেলায়, কঠিন বাস্তবতায়। তখন শুধু কাঁদি। নীরবে-নীভৃতে। জীবন-তরী বহমান। চলছে, চলবে আল্লাহর দেয়া মৃত্যু পর্যন্ত। এভাবেই!
"জীবন-তরী থেমে কি যায় কখনো,
কভু কাহারো শূন্যতায়?
সময়ের স্রোতে জীবন ভাসে,
কে আছে থাময়?
সঙ্গী কেহ না হলেও,
তবুও চলে জীবন।
বন্দর সেদিন খুঁজিয়াই পায়,
পরিলে সাদা কাফন।"