নাসিম মুমতাজী
রাকিবের মনটা আজ একটু বেশিই খুশী ৷ হাসছে প্রাণখুলে ৷ মেজাজটাও উৎফুল্ল ৷ ওর বাবা ওর জন্য ঈদের নতুন জামা কিনে দিতে রাজী হয়েছেন ৷ এজন্যই ওর মনে এতো আনন্দ ৷ গত ঈদেও কিনে দেননি ৷ রাকীবও বলার সাহস পায়নি ৷ ওর বাবা অবশ্য এসব পছন্দ করেন না ৷ এবার সাহস করে বলেই ফেললো রাকিব ৷ ওর বাবাও কোনোরকম দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই রাজী হয়ে গেলেন ৷ তাই ওর হাসি যেনো আর থামতেই চাচ্ছে না ৷
আগামীকাল ঈদ ৷ দোকানগুলোতে তাই উপচে পড়া ভীড় ৷ অনেকেই সপরিবারে মার্কেটে এসেছে ৷ ব্যাগভর্তি পণ্য নিয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে ৷ সবার মাঝেই কেমন যেনো খুশির আমেজ ৷ শুধুমাত্র রাকিবের বাবাই কেবল গম্ভীর ৷
রাকীব কেমন ভয় পাচ্ছে ৷ ওর বাবা আবার মত পরিবর্তন করে ফেলেন কি না! তাহলে তো ওর ঈদের আনন্দটা একেবারেই মাটি !
ওর বাবা ওকে প্রথমে মার্কেট ঘুরিয়ে দেখালেন ৷ কতো দামি দামি আর সুন্দর সুন্দর পোষাক! নজরকাড়া এসব পোশাকের দামও বেশ! সবার মুখেই হাসি ৷ আনন্দের ছায়া ৷ দেখে মনে হয়, পুরো পৃথিবীটাই যেনো হেসে ওঠেছে৷
মার্কেট দেখানোর পর ওর বাবা ওকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গেলেন ফুটপাতে ৷ সেখানে সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃশ্য ৷ এ যেনো এক অন্য দুনিয়া ৷ রিকশাচালকরা আগের মতোই ৷ হাড্ডিসার দেহ নিয়ে আজো তারা হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে যাচ্ছে ৷ কপাল বেয়ে মাটিতে ঘাম পড়ছে ৷ পঙ্গু, লেংড়া, লোলা ও অসুস্থ কর্মক্ষম প্রভৃতির লোকগুলো থলে-বাটি নিয়ে রাস্তার ধারে শুয়ে আছে ৷ আর উচ্চস্বরে আল্লাহ আল্লাহ আওড়াচ্ছে ৷ পথিকের দয়া হলে তাতে দু’এক পয়সা ফেলে যাচ্ছে ৷ কেউ কেউ উদাস ভঙ্গিতে কিছুই না, এমন ভাব দেখিয়ে পাশ কেটে যাচ্ছে ৷ একটি শিশু— রাকিবের সমবয়সী— নোংড়া একটা বস্তা নিয়ে ময়লার স্তুপ থেকে কী সব খুঁজে বেড়াচ্ছে ৷ মাঝে মাঝে ফেলে দেয়া অব্যবহার্য বোতল ও কাগজ জাতীয় কিছু আবর্জনা বস্তায় ঢুকাচ্ছে ৷ আরেকজন মহিলা তার দুধের শিশুকে কোলে নিয়ে ডাস্টবিনে খাবার খুঁজছে ৷ সাথে চার-পাঁচ বৎসর বয়সী কঙ্কালসার এক ছেলে ৷ ডাস্টবিনে কিছু কুকুর ও কাক খাবার খুঁজছিলো, তাদের আগমনে কাকগুলো ওড়ে গেলো ৷ কুকুরগুলো অদূরে দাঁড়িয়ে ঘেউ ঘেউ করতে লাগলো ৷
রাকীব ও তার বাবা এতক্ষণ একেবারেই নীরব ছিলো ৷ শুধুই দেখে যাচ্ছিলো ৷ মুখ খুললেন তার বাবা-ই ৷ বললেন, এরাও ঈদ পালন করবে ৷ ঈদের খুশি এরাও ভোগ করবে ৷ কিন্তু এদের কেউ-ই ঈদ উপলক্ষ্যে মার্কেট করবে না ৷ ব্যাগভর্তি বাজার করবে না ৷ এদের ঈদ এভাবেই কেটে যাবে ৷
তুমি শুধু তোমার চেয়ে ধনীলোকদেরই দেখে এসেছো ৷ যারা এমন হাজারো মানুষকে ঠকিয়ে রাতারাতি কোটিপতি বনে গেছে ৷ আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছে ৷ আর তাদের দেখে মনে করেছো, সমাজের সকলেই খুশী— তুমি বাদে ৷ কিন্তু তুমি কখনো সমাজের নিম্নশ্রেণির লোকেদের দিকে নজর দাওনি ৷ দেখোনি তাদের জীবন-চলন ৷ কতোকষ্টে তারা দিনগুজরান করছে ৷ ঠিকমতো দু’বেলা খাবার খেতে পাচ্ছে না ৷ পরনের কাপড় পাচ্ছে না ৷ অথচ, তাদেরও মনে চায় ঈদের আনন্দ সমানভাগে উপভোগ করতে ৷ কিন্তু যেখানে ওরা খাবারই পাচ্ছে না, ঈদের জন্য মার্কেট করার সাধ্য কোথায়?
তুমি কী চাওনা, এরাও ঈদের খুশি উপভোগ করুক! ঈদের আনন্দে এরাও শরীক হোক! এরাও একটা দিন কিছু ভালো-মন্দ খাবার খাক! সবার সাথে একটা দিন প্রাণখুলে হাসুক!
রাকীবের চোখে জল ৷ এ জল— এ কান্না কাপড় না কিনে দেওয়াতে নয়, সমাজের নিম্নশ্রেণির অধিকারবঞ্চিত মানুষগুলোর কষ্ট দেখে ৷ এ অশ্রুফোটাগুলোতেই তার বাবার সকল প্রশ্নের জবাব রয়েছে ৷ সকল আবদার-বায়নার প্রাপ্তি এ এশ্রুতে ৷
ও তার বাবাকে বললো, আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি বাবা ৷ আমায় আর লজ্জা দিও না! আমার নতুন জামা লাগবে না বাবা ৷ আমি আগের কাপড় দিয়েই ঈদ করবো ৷ ওগুলো পরেই মাঠে যাবো ৷ বাবা! আমায় কিছু টাকা দাও! ঐ ছেলেটাকে দিয়ে আসি ৷ দেখো বাবা! ওর গায়ের হাড্ডি সব দেখা যাচ্ছে ৷ মনে হচ্ছে, অনেকদিন কিছু খায়নি ৷ ঐ মহিলাটাকে দেখো বাবা! দু’টো সন্তান নিয়ে কতো কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন তিনি ৷ তাকেও কিছু দেওয়া দরকার ৷ চলো না বাবা! কিছু দিয়ে আসি ঐ ভিক্ষুকের বাটিতে ৷ কতো কাতর কণ্ঠে চাইছে সে ৷ আমার খুবই মায়া হচ্ছে বাবা!