নোমান বিন আরমান
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
বছর দশেক আগেও স্টলে স্টলে কিছু পত্রিকা দেখা যেত। নিরেট ভালো লাগা, ভালোবাসার পত্রিকা। সংখ্যার বিচারে কম না মোটেও। নিয়ম মাফিক বেরোত এমন অন্তত পাঁচ-দশটি পত্রিকা সিংহভাগ স্টলে আলাদাভাবে শোভা পেত। বেচা-বিক্রিও খারাপ হত না। পত্রিকার মধ্যে শুধু এই পত্রিকাগুলোই স্টলে রাখা হত এমনটাও ছিল। এগুলোর নাম ছিল ইসলামি পত্রিকা। এখন, এই ২০১৭ সালে অবস্থাটা কেমন!
ইসলামি পত্রিকার অবস্থা এখন শূন্য ডাকবাক্সের মত। কোনো প্রেমিকার হলুদ খাম সেখানে আসে না। এখন আর কেউ পোস্ট অফিস মাড়ায় না। ঝাপসা স্মৃতি হয়ে গেছে... মদীনা, রহমত, আদর্শ নারী, মঈনুল ইসলাম, রাহমানী পয়গাম, কাবার পথে, পাথেয় আরও কী কী জানি!
গতকাল সিলেটে আমরা (ফায়যুর রাহমান, নাওয়াজ মারজান, সাইয়্যিদ মুজাদ্দিদ) একটি গ্রুপের ইফতারে অংশ নিয়েছিলাম। বড় অর্থনৈতিক উদ্যোক্তা। প্রবাসীদের অর্থায়নে দেশের দু’ দু’টো বেসরকারি পাওয়ারসহ (বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র) এই গ্রুপের অধীনে রয়েছে বড় কিছু সহপ্রতিষ্ঠান। ইফতারের পর আড্ডায় বসে তাদের গ্রুপের অন্য প্রতিষ্ঠানের নামগুলো যখন দেখছিলাম, তখন ফায়যুরকে বললাম, হুজুররা একটা দোকান খুলে এটাকে দুই দোকানে সম্প্রসারের আগেই ভেঙে খান খান হয়ে যায়। কোনো উদ্যোগই আসলে ঠিকমত আগায় না। স্থায়িত্ব তো পায়ই না। অথচ অন্যরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে একেকটা প্রতিষ্ঠানকে ধরে রাখে। সম্প্রসারণ করে। আক্ষেপে আমাদের কণ্ঠ ধরে আসে।
হুজুরদের দোকান বলেন, মোকাম বলেন, দল বলেন আর পত্রিকা— কোনো কিছুই এই দেশে এখনো ঠিক প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠেনি। মোকামগুলো অবশ্য পারিবারিক প্রতিষ্ঠান হয়েছে কোথাও কোথাও)। এর বাইরে কোনো উদ্যোগ প্রতিষ্ঠান হতে পেরেছে? ব্যক্তির খোলস থেকে বেরিয়েছে? জানা নেই।
পত্রিকা বিষয়েই যদি বলি, এখন পর্যন্ত যে ক’টা উদ্যোগই হয়েছে, যে ক’টি পত্রিকা বেরিয়েছে সবই ব্যক্তি-উদ্যোগ, ব্যক্তিকেন্দ্রিক। এমন কি প্রতিষ্ঠান (মাদরাসা) থেকেও যেগুলো বেরোয় সেগুলো আরও বড় রকমের ব্যক্তিকেন্দ্রিক। প্রাতিষ্ঠানিক রূপরেখায় দাঁড়িয়েছে এমন একটি দৃষ্টান্তও কোনো পত্রিকার নেই।
এই যে ব্যক্তি কেন্দ্রিক বা ব্যক্তি-উদ্যোগের কথা আমরা বলছি, এই নিয়ে দু’চার কথা বলা দরকার। আমাদের অঙ্গনে পত্রিকা বেরোয় সামাজিক ভাবনা থেকে। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, দ্বীনি দরদে। (দু’ দেড়জনের নিয়তে-তৎপরতায় ‘ধান্ধা/কামাই’ নেই— এমনটা বলব না)। আমার পকেটে যখন টাকা ছিল না, তখন আমরা অভিযাত্রী, কালকণ্ঠ, সুচিন্তা, সপ্তাহের রমজান বের করেছি। কত রকমের অভিজ্ঞতা যে হয়েছে। প্রথমবার যখন পত্রিকা করি, তখন তিনশ’ টাকার এক বিজ্ঞাপনের ‘বিলে’র জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির এতোবার আজকাল শুনেছি, এতোবার গিয়ে ফিরে এসেছি। ইয়ত্তা নেই!
কালকণ্ঠ নিয়ে বরাবরই আমরা ছিলাম অ-কমার্শিয়াল। পাঠকবান্ধব। ওই সময় নাঈমুল ইসলাম খান সাপ্তাহিক ‘মিডিয়া ওয়াচ’ পাঠকের হাতে দিতেন দু’টাকায়। আমাদের অত সঙ্গতি ছিল না। কালকণ্ঠের প্রিন্টিং খরচ পড়ত প্রায় সতের টাকার মত। পাঠকের হাতে সেই পত্রিকা আমরা দিতাম পাঁচ টাকায়। এরমধ্যে বিক্রেতারা নিতেন দু’টাকা। আমরা তিন টাকা করে ফেরত পেতাম। বিজ্ঞাপন থেকে আসত সর্বোচ্চ হাজার দশেক টাকা। এর বেশি কখনোই আসেনি। পকেটে টাকা ছিল না, আয়-রোজগারও না। এরপরও এই লগ্নির পেছনে বড় একটা সময় ধরে টাকা ঢেলেছেন আমার সহপাঠী মনসুর আহমদ। একটা দীর্ঘসময় আমার উদ্যোগে চলেছে। এখন চাইলে, কারও কাছে বিজ্ঞাপনের জন্য হাত না পেতেও এমন পত্রিকা বের করে ফেলা সম্ভব। কিন্তু করতে পারছি না!
বেশির ভাগ ইসলামি পত্রিকার প্রিন্টার্স লাইনে শোভাবর্ধক প্রাসঙ্গিক পদবি থাকলেও সম্পাদকই মূলত ওইটার ‘মা-বাপ, পাঠক’! বাকি যাদের নাম ছাপা হয়, নিজের নামটা ছাপা হচ্ছে কি না এর বাইরে দেখার, জানার, করার মত কোনো কর্তব্য তারা খুঁজে পান না। দরকারও মনে করেন না। ভাবেন, ‘আল্লার মাল, আল্লায় চালায়’। মোটা দাগে এভাবেই চলে ইসলামি পত্রিকা।
এভাবে চলে বলতে আসলে কীভাবে চলে? কোনো সম্পাদক জমিদারের পুত না। পকেটে টাকা নেই এমন ছেলেপেলে, এমন দরদিরাই মূলত এসব পত্রিকার উদ্যোগক্তা।
কোনো পত্রিকাই আহামরি বাজেট নিয়ে এখনো পথ চলা শুরু করেনি। তাহলে চলে কীভাবে? বিজ্ঞাপনে। শুধু বিজ্ঞাপনে চলে যায়, ইসলামি পত্রিকা এত টাকার বিজ্ঞাপন পায়! এমন অবাক-ভাবনা দূরে রাখাই ভালো। এইসব পত্রিকার এক রহস্যের জায়গা এটা। আপনি দেখবেন, এখানে ‘লাখে লাখে বিজ্ঞাপন ছাপে কাতারে কাতার’...। এরপরও পকেট ফাঁকা। এইসব পত্রিকার বিজ্ঞাপনের ফাঁকিটা শুভঙ্করের ফাঁকির মতই। বিজ্ঞাপন গুণে শেষ হয়না, কিন্তু পকেট ফাঁকা থেকে যায়। প্রেসে বাকির হিসাব সংখ্যার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে।
ইসলামি পত্রিকা বিষয়ক একটি সাক্ষাৎকার পড়তে নিচের লিংকে ক্লিক করুন