মাহমুদুল হাসান, কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি: এক সময় হাওরের জেলেদের শ্লোগান ছিল ‘জাল যার, জলা তার’। এখন পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে ‘জাল যার, জ্বালা তার’।
কারণ কিশোরগঞ্জের যেসব উন্মুক্ত জলালয়ে এক সময় মৎস্যজীবীরা অবাধে মাছ শিকার করে পরিবার চালাতেন, সেগুলি এখন আর উন্মুক্ত নেই। ‘জলমহাল’ নাম দিয়ে ইজারার বিনিময়ে এগুলি তুলে দেয়া হয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালী অপেশাদার লোকদের হাতে। যে কারণে জেলে সম্প্রদায় এখন অসহায়। তাদের জাল এখন জ্বালায় পরিণত হয়েছে।
কিশোরগঞ্জ দেশের অন্যতম মৎস্যভাণ্ডার হিসেবে পরিচতি। এ জেলায় রয়েছে প্রচুর জলাশয়। এসব জলাশয়ে প্রচুর নানা প্রজাতির সুস্বাদু দেশি জাতের মাছ পাওয়া যায়। এসব মাছ স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের অন্যান্য জেলা, এমনকি বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে।
মৎস্য বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, জাতীয়ভাবে চাহিদার তুলনায় তিন লক্ষাধিক মেট্রিকটন মাছের ঘাটতি থাকলেও কিশোরগঞ্জ এদিক থেকে একটি উদ্বৃত্ত জেলা। জেলায় বছরে মাছের চাহিদা রয়েছে ৪৬ হাজার ৮৬৫ মেট্রিকটন। কিন্তু বছরে উৎপাদন হয় ৬৭ হাজার ৩৮০ মেট্রিকটন। ফলে বছরে উদ্বৃত্ত থাকে ২০ হাজার ৫১৫ মেট্রিকটন।
কিশোরগঞ্জের যেসব জলাশয় এক সময় উন্মুক্ত ছিল, সেগুলোতে জেলার মৎস্যজীবী বা জেলে সম্প্রদায় অবাধে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতো। কিন্তু এসব উন্মুক্ত জলাশয়ই এখন ‘জলমহাল’ নামে পরিচিত। এগুলি সরকারিভাবে মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির অনুকূলে পত্তন দেয়া হয়। কিন্তু প্রকৃত মৎস্যজীবীরা এসব জলমহালের ইজারা পান না। নামটা ব্যবহার করে কোন না কোন মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির। প্রকৃতপক্ষে এসব জলমাহল ইজারা নেন স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। এর পেছনে রাজনৈতিক ইন্দনও থাকে।
মৎস্য বিভাগের হিসাব মতে, জেলায় ৪৫৩ দশমিক ৭৪ হেক্টর আয়তনের ১২৮টি খাল রয়েছে। ১৩ হাজার ৬১২ দশমিক ৮৫ হেক্টর আয়তনের ৫২টি নদী রয়েছে। ১৩ হাজার ৪৮৫ দশমিক ৪০ হেক্টর আয়তনের ২৪১টি বিল রয়েছে। ৪০ হাজার ৮১০ দশমিক ১০ হেক্টর আয়তনের ৪৮টি হাওর রয়েছে।
এসব জলাশয়ে এক সময় জেলে সম্প্রদায় অবাধে মাছ শিকার করতে পারতেন। কিন্তু এখন এর প্রায় সবগুলোই পৃথক পৃথক জলমহালে বিভক্ত করে ইজারা দেয়া হচ্ছে। জেলায় ২০ একরের বেশি আয়তন বিশিষ্ট জলমহাল রয়েছে ১৭৯টি, আর ২০ একরের কম আয়তন বিশিষ্ট জলমহাল রয়েছে ১৫২টি। তবে যারা এসব জলমহাল ইজারা নেন, তারা অত্যন্ত প্রভাবশালী। যে কারণে ২০ একর ইজারা নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় অথবা উদাসীনতায় জোরপূর্বক ভোগদখল করে ৩০-৪০ একর। ইজারাদারদের লাঠিয়াল বাহিনীও থাকে। ফলে কোন মৎস্যজীবী বা জেলে এসব জলমহালের কাছেও ঘেঁষতে পারেন না। কেবলমাত্র ইজারাদারের নির্ধারিত জেলেরাই জলমহালে মাছ শিকার করে থাকেন। এরপর এসব মাছ স্থানীয় পাইকারসহ বিভিন্ন আড়তে নিয়ে বিক্রি করা হয়।
কিশোরগঞ্জ দানাদার খাদ্যের দিক থেকেও একটি উদ্বৃত্ত জেলা। কৃষি বিভাগের হিসাব মতে, কিশোরগঞ্জের ১৩ উপজেলায় বছরে প্রায় ৮ লাখ মেট্রিকটন খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয়। বছরে জেলার চাহিদা রয়েছে প্রায় ৫ লাখ মেট্রিকটন। ফলে প্রতি বছর জেলায় প্রায় ৩ লাখ মেট্রিকটন খাদ্যশস্য উদ্বৃত্ত থাকে।
কিন্তু এবছর কিশোরগঞ্জসহ দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ৭টি হাওর অধ্যুষিত জেলায় আগাম বন্যায় স্মরণাতীতকালের ভয়াবহতম ফসলহানি হয়েছে। মহা বিপর্যয় নেমে এসেছে কৃষদের জীবনে। হাওরের কৃষকদের বর্ষার পানির কারণে প্রায় ৬ মাস কোন কাজ থাকে না। ফলে এই সময়টাতে তারা ভাসান পানিতে মাছ শিকার করে সংসার চালান। এছাড়া কিশোগঞ্জে রয়েছেন ৫৬ হাজার ৪১৫ জন পেশাদার মৎস্যজীবী।
কোন না কোনভাবে এরা কৃষির সঙ্গেও জড়িত। ফসলহানির কারণে এবার বিভিন্ন মহল থেকে জোরালোভাবে সরকারের কাছে দাবি উঠেছে, যেন জলমহাল ইজারা প্রথা বাতিল করে এসব জলমহালকে উন্মুক্ত জলাশয় ঘোষণা করে অভাবপীড়িত মানুষদের অবাধে মাছ শিকারের সুযোগ করে দেয়া হয়।
এসএস/