মঈনুদ্দীন তাওহীদ
২য় হিজরীর ১৭ রমজান। রমজানের খুদ-পিপাসায় কাতর মাত্র ৩১৩ জন সাহাবী বদর রণাঙ্গনে উপস্থিত। সম্মুখে তাদের ভারী অস্ত্রে সুসজ্জিত হাজার সৈণ্য। শুরু হলো যুদ্ধ। বাতিলের বিরুদ্ধে সত্যের লড়াই। হাজারের বিরুদ্ধে মুষ্টিমেয় কিছু ঈমানদারের সংঘাত।
মূর্তির বিরুদ্ধে একত্ববাদের দফারফা। একদিকে মানবরুপী শয়তান আর অন্যদিকে নুসরাতের ফেরেশতা। একপাশে আমিত্বের অহমে উদ্ধত কোরাইশ সম্রদায়, অপরপাশে আগত বিশ্বের নেতৃত্বদানকারী ফকিরি মুসল্মান।
কে জিতবে! অবাক তাকিয়ে বিশ্ব!! মুসলমানরা কি হেরে যাবে ; তাহলে যে আর এধরার বুকে আল্লাহর নাম জপার কেউওই থাকবেনা! প্রিয় নবী মোহাম্মদ সাঃ সেজদাবনত। অঝোরে কেঁদে যাচ্ছেন তিনি.. অবশেষে জয় হলো সত্যের। হাজারের বিরুদ্ধে জয়ের আনন্দে ভাসলো গুটিকয়েক হকের ধ্বজাধারী। একত্ববাদের আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে চূর্ণবিচূর্ণ হলো মূর্তি পুজারী কুরাইশ-কাফেরদের আমিত্ব আর পরশ্রীকাতরতার সকল অহম। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো অবাক তাকিয়ে থাকা সৃষ্টির প্রতিটা অণু।
এতক্ষণ ঐতিহাসিক বদরের দিকে ফিরে দেখছিলাম। মক্কায় কাফেরদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ মুসলামানেরা যখন দুর্বিষহ জীবনযাপন করছিলো, তখন আল্লাহর নির্দেশে সকলেই প্রিয় জন্মভূমি ছেড়ে মদীনায় হিজরত করেন। কিন্তু কাফেররা এখানেও তাদেরকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে দেয়নি। যার ফলস্বরুপ হিজরতের দুই বছর না পেরোতেই সংঘটিত হয় ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ। বদর একটি কুপের নাম। মদীনা থেকে ৮০ মাইল দূরে এ-কুপ অবস্থিত। কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ানের সিরিয়া ফেরত বানিজ্যকাফেলাকে রুখতেই মুলত মোহাম্মদ সাঃ ও তার সাহাবীরা বের হন। কিন্তু গুপ্তচর মারফত খবর পেয়ে ধুরন্ধর আবু সুফিয়ান স্বাভাবিক পথ পরিহার করে উপকুলবর্তী পথে কাফেলা নিয়ে নির্বিঘ্নে মক্কা চলে যায়।
এদিকে আগেই দূত পাঠিয়ে মক্কায় খবর পাঠানোর ফলে অপর নেতা আবু জেহেলের নেতৃত্বে ১০০০ সদস্যের বিরাট এক দল মদীনার নিকটবর্তী বদর কুপের সন্নিকটে এসে উপস্থিত হয়। এখানেই মুখোমুখি হয় দুদল। বেধে যায় যুদ্ধু। প্রকৃত পক্ষে এটি ছিলো একটি অসম লড়াই। কারণ কুরাইশদের সংখ্যা ছিলো ১০০০। তন্মধ্যে ১০০ অশ্বারোহী, ৭০০ উষ্ট্রারোহী আর বাকিরা পদাতিক। এছাড়াও তারা ছিলো সব ধরণের অস্ত্রে সুসজ্জিত একটি পূর্ণাঙ্গ সামরিক বাহিনী। আর মুসলমান, সর্বসাকুল্যে ৩১৩। ২ জন অশ্বারোহী, ৭০ জন উষ্ট্রারোহী। কয়েকটিমাত্র তলোয়ার। গোটা যুদ্ধ জুড়েই ছিলো আল্লাহপাকের অপার নুসরত।
এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের সুরা আনফালের ১২-১৪ নং আয়াতে মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, আর স্মরণ করুন সে সময়ের কথা, যখন আপনার রব ফেরেশতাদের কাছে এ মর্মে প্রত্যাদেশ পাঠালেন যে, নিশ্চয়ই আমি তোমাদের সঙ্গে আছি। তোমরা পরস্পরে ঈমানদারদের মনোবল ও সাহস বৃদ্ধি কর। আর আমি অচিরেই কাফেরদের অন্ত:করণে ভয়-ভীতি সৃষ্টি করব। (আল কুরআন) মহান আল্লাহ তাআলা অন্যত্র ইরশাদ করেন, আর আল্লাহ এমন সৈন্যবাহিনী দিয়ে তোমাদের সাহায্য করেছেন, যা তোমরা কখনো দেখনি। সূরা আলে ইমরানের ১৩ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন উভয়দলের পরিচয় তুলে ধরে বলেছেন, এদের মধ্যকার একটি দল আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম করে আর অপর দল ছিল কাফের। (আল কুরআন)
বদর যুদ্ধ ছিলো মুসলিম ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। কেননা তা-ছিলো পরবর্তীতে মক্কা বিজয়ের হাত ধরে হিন্দ থেকে কনস্টান্টিনোপল পর্যন্ত কালিমার পতাকা উড্ডীন করার পবিত্র সোপান। এ যুদ্ধে প্রতিজন মুসলিম সিপাহিই অসীম শৌর্যবীর্য প্রদর্শন করেন।বিশেষ করে দুই কিশোর-মুয়াজ,মুয়াওয়াজ- এর কীর্তগাঁথা গোটা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলো। কারণ তাদের কোমল হাতেই হয়েছিলো উম্মতে মোহাম্মদীর ফেরাউন খ্যাত আবু জাহেলের মর্মান্তিক মৃত্যু।
এ-যুদ্ধে কাফেরদের ৭০ জন নিহত আর ৭০ জন বন্দী হয়। বিপুল পরিমাণ মালে গণীমত মুসলমানদের হস্তগত হয়। মুসলমানদের মধ্য থেকে ১২ কিবা ১৩ জন শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করেন।
পবিত্র কোরআনে এ-যুদ্ধকে ইয়াওমুল ফুরকান তথা সত্য-মিথ্যার প্রভেদকারী হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এ-যুদ্ধ ইতিহাসের কোন অংশ নয়, বরং তা নিজেই সৃষ্টি করেছিলো যুগান্তকারী ইতিহাস।
বদরের শিক্ষায় প্রতিবছর ১৭ রমজান ফিরে আসে। সেই সাথে নিয়ে আসে বদর-দিবসের অভুলনীয় চেতনার মহান বার্তা। বদর আমাদের কি শেখায়!! বদর আমাদের শিখায়, অন্যায়ের কাছে কখনো মাথানত নয়। নিজেদের শক্তি-সামর্থ যতই কম হোকনা কেনো। কাফের শক্তিকে কখনোই বিনা চ্যালেঞ্জে ছেড়ে দেওয়া যাবে না।
আমরণ একত্ববাদের ধ্বজাধারী হয়ে মূর্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাতে হবে। হোক তা যে যুগেই, যে কোন রুপেই। তাগুতের সকল অপশক্তির মোকাবেলায় সর্বদা দৃঢ় মনোবল নিয়ে প্রতিরোধ গড়তে হবে।
যদি সব অপশক্তি আর তাদের দেশীয় দোসররা মিলে কোন মুসলিম ভূখণ্ডের উপর আক্রমণ করে তাহলে হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে নিজেদের ভাইদের রক্ষা করতে, বোনদের ইজ্জত-আবরুর হেফাজত করতে।
আসুন আমরা বদরের পবিত্র চেতনাকে বক্ষে ধারণ করি। অন্যয়ের বিরুদ্ধে চিরসংগ্রামী হয়ে উঠি। আপন কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলি হীনমন্নতার লজ্জাজড়িত ভার। জগজ্জোড়া হয়ে উঠি নতুন এক অপ্রতিরোধ্য শক্তি। তাহলেই একদিন বিশ্ব হাসবে আমাদের হাসিতে। অন্যায় পালিয়ে যাবে দূর, বহুদূর।।
এসএস/