মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী। বিশিষ্ট আলেম ও শিক্ষাবিদ। পেশাদার সাংবাদিকতায় সম্পৃক্ত রয়েছে সুদীর্ঘ ত্রিশ বছর। দৈনিক ইনকিলাবের সিনিয়র সহকারী সম্পাদক। মিডিয়ার নানা বিষয়ে রয়েছে তাঁর অভিজ্ঞতালব্ধ চিন্তা-ভাবনা। সেসব বিষয়ে আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকমের বর্ষপূর্তি ক্রোড়পত্রের জন্য তার সাক্ষাতকার নিয়েছেন হাসান আল মাহমুদ
আওয়ার ইসলাম: একটি সমাজ বা দেশে গণমাধ্যমের প্রভাব কি?
উবায়দুর রহমান খান নদভী: একটি সমাজ বা দেশে গণমাধ্যমের প্রভাব অনেক বেশি। কারণ গণমাধ্যম হচ্ছে, মানুষকে সচেতন করার মাধ্যম। জনগণকে তথ্য দেয়া, জ্ঞান দেয়া, তাদের নিজেদের দর্শন সম্পর্কে,চিন্তাধারা সম্পর্কে জানানো এবং সমাজের যে অসঙ্গতি, সমাজ বিরোধী,রাষ্ট্র ও দেশ বিরোধী,মানবতা বিরোধী কাজকর্ম এগুলোর ব্যাপারে তথ্য তুলে ধরা, অনুসন্ধানী রিপোর্ট করা, মতামত দেয়া, দিক নির্দেশনা দেয়া, বিশ্লেষণ তুলে ধরা গণমাধ্যমের কাজ।
এজন্য বলা হয়, সংবাদপত্র সমাজের বিবেক। এক্ষেত্রে অনলাইন,প্রিন্ট এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া আছে। তো, একটি সমাজকে কিছু বলা, তাদের কোনো দিকে পরিচালিত করা, উজ্জীবিত করা, দিক-নির্দেশনা দেয়া, তাদের অনুপ্রাণীত করা সবকিছুই মিডিয়ার কাজ। মিডিয়ার গুরুত্ব সম্পর্কে বলে শেষ করা যাবে না। একটি দেশ ও সমাজের অগ্রগতি, উন্নতি, উৎকর্ষের জন্য অন্যান্য অনেক উপাদানের প্রয়োজন। এর মধ্যে তথ্য দেয়ার উপাদান হিসাবে গণমাধ্যম উল্লেখযোগ্য।
আওয়ার ইসলাম: বর্তমানে মুহূর্তেই ভিউ থেকে নিউজ হয়ে যাচ্ছে। মুহূর্তেই পৌঁছে যাচ্ছে সংবাদ। আগের তুলনায় বর্তমানের এই তাৎক্ষণিক সংবাদ হয়ে যাওয়াতে কিভাবে দেখেন?
উবায়দুর রহমান খান নদভী: বর্তমানে মুহূর্তেই সংবাদ হয়ে যাওয়াটা নিঃসন্দেহে অগ্রগতি। কারণ, আগের যুগে সংবাদ বা সংবাদপত্র,মুদ্রণ ব্যবস্থাপনা,প্রকাশনা ইত্যাদির গতি মন্থর ছিল। কিন্তু বর্তমানে ইলেক্ট্রনিক যুগ আর বিভিন্ন মাধ্যমের অগ্রগতি বিশেষ করে ইন্টারনেট হওয়ার পর এখন যে অনলাইন এবং এর দ্বারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ফলে মানুষ মুহূর্তেই সবকিছু জেনে যাচ্ছে, আর নিজের মত, চিন্তা, দর্শন অপরকে সহজে পৌঁছে দিচ্ছে। এখন যোগাযোগের মহাসড়কে বলা যায় পৃথিবীটা একটি গ্রাম। সারা পৃথিবী একটা গ্রামের মত।
এখানে এই গ্রাম হওয়া বা দূর কাছে চলে আসা এর পিছনে সবচে বড় ভূমিকা তথ্য প্রযুক্তি উন্নয়নের। আর এরই ফসল হচ্ছে আজকের অনলাইন সংবাদপত্র। একটি ঘটনা ঘটার সাথে সাথেই সংবাদ হয়ে যাচ্ছে, এই সংবাদ থেকে আবার সঙ্গে সঙ্গে পর্যালোচনাও হয়ে যাচ্ছে। অথবা একটা ভিউ; এই ভিউটাই এক মুহূর্তে নিউজ হয়ে যায়। এই কাজটা করার জন্য পিছনে শুধু একজন লোক দরকার। এবং সেটা প্রফেশনাল সাংবাদিক বা পেশাদার যারা সংবাদকর্মীর কাছেই সীমাবদ্ধ নয়। প্রতিটি মানুষ এখন তার নিজের ভিতর নিজেই একজন চিন্তাবিদ,নিজেই একজন অনুভূতি প্রবণ। নিজেই একজন সাংবাদিক। কাজেই অনলাইন মিডিয়ার কারণে বর্তমানে সংবাদ জগতটি বিস্তৃত রূপ ধারণ করেছে। যা আমাদের সমাজকে এগিয়ে নেয়ার জন্যে খুবই সহায়ক হতে পারে।
আওয়ার ইসলাম: গণমাধ্যমে আলেমদের উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধিতা করেন কি না? করলে কেন?
উবায়দুর রহমান খান নদভী: গণমাধ্যমে আলেমদের প্রয়োজনীয়তা তো আমি অবশ্যই অনুভব করি। কেন করি বললে বলব, কারণ এটা বাস্তব,তাই করি। আসলে শুধু সংবাদ মাধ্যম বা মিডিয়ায় আলেমদের প্রয়োজনীয়তা নয়; পৃথিবীতে সবচে বেশি প্রভাবশালী মাধ্যম যেটি তা হল, মানুষকে কিছু বলা। এই বলাটি কিন্তু আলেমরাই বেশি বলেন। আমরা মুসলিম বিশ্বে দেখি, যেখানে প্রায় দুইশো কোটি মানুষ। আমাদের জন্য আল্লাহ প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করেছেন। এই নামাযের জন্য প্রত্যহ পাঁচবার আযান হচ্ছে। আরবি ভাষায় ‘নাবী’ শব্দের অর্থ হল নিউজম্যান। বা যাকে আমরা জার্নালিস্ট বলি, নিউজ এডিটর বলি। আরবি ভাষায় নিউজ শব্দকে বলা হয় ‘নাবাউন’। এ জন্য আরব দেশগুলোতে নিউজ এজেন্সিকে বলে ওকালাতুল আনবা।
তাইলে ইসলামের নাবী এবং রাসূল শব্দগুলো মাধ্যম। যিনি আল্লাহর বাণী মানুষের কাছে পৌঁছিয়ে দেন। কাজেই একজন আলেম তিনি তো রাসূলের নায়েব। রাসূলের প্রতিনিধি। তার জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কাজই তো হল গণমাধ্যমে কাজ করা। বাংলাদেশে চিন্তা করে দেখেন, যদি পাঁচ-ছয় লাখ মসজিদ হয়, আনুষ্ঠানিক হোক বা অনানুষ্ঠানিক মসজিদ হোক। এখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযে সকাল-সন্ধায় ,জুমায় বা যে কোনো ওকেশন উপলক্ষে মানুষকে কুরআন-হাদিসের তালিম দেয়া হচ্ছে। জনগণকে তাদের জীবনবোধ,লাইফস্টাইল শেখানো হচ্ছে। এ কাজগুলো তো আলেমরা করছেন। কাজে আলেমরাই গণমাধ্যমের সবচে বড় কর্মী। এটাই হচ্ছে আসল মিডিয়া। একটা টেলিভিশনে হয়তো দশ কোটি লোক দর্শক নেই। একটা রেডিওর আওতায় হয়তো বারো কোটি লোক নাই। কিন্তু এ মসজিদগুলির আওতায় বাংলাদেশের বলা চলে ষোলো কোটি মানুষই আছেন । নারীরা নারীর মত,শিশুরা শিশুর মত,অমুসলিমরাও তাদের মত তাদের স্থানে থেকে উপকৃত হচ্ছে, এই আলেম উলামাদের ইসলাম প্রচার,ওয়াজ-মাহফিল,তাবলিগ,বই-পুস্তক সবকিছুই মাধ্যম এবং বৃহত্তম মাধ্যম বলা চলে।
কাজেই আলেম ওলামাদের বৃহত্তম গণমাধ্যম আছে। আর বিশেষত যদি এ মিডিয়ার ব্যাপারে বলি, তাহলে বলব এতে আলেমদের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। এ মিডিয়াতে যদি মানুষকে কোনো জ্ঞান বা তথ্য দেয়া হয়, তাহলে ইসলামিক জ্ঞান বাদ যাবে কেন! আমি মনে করি মুদ্রণ,অনলাইন,ইলেক্ট্রনিক সবধরণের মিডিয়ায় আলেম উলামাদের যথাসম্ভব অগ্রসর হয়ে ভূমিকা রাখা জরুরি । এটা এ দেশে কম ছিল নানা কারণে। কিন্তু ইদানিং বাড়ছে এবং ভবিষ্যতে সমাজে যেমন আলেমদের ভয়েস সবচে বেশি কার্যকর এবং সর্ব সময় তারা কাজ করেন, তেমনি মিডিয়াতেও তারা কাজ করবেন।
আওয়ার ইসলাম: ইসলামকে যারা ভালোবাসেন এবং যারা ইসলামকে গণমাধ্যমে তুলে ধরতে চান, তাদের জন্য মিডিয়া কমপ্লেক্সের প্রয়োজনীয়তা আছে কি না?
উবায়দুর রহমান খান নদভী: যারা ইসলামকে ভালোবাসেন, ইসলামের শুভাকাঙ্খী,ইসলামকে যারা গণমাধ্যমে তুলে ধরতে চান তাদের জন্য মিডিয়া হাউজ,মিডিয়া কমপ্লেক্স দরকার। ছোট আকারে প্রাইভেট মিডিয়াই হোক। যারা এ কাজে আছেন তাদের উচিত নিজ নিজ সাধ্যমত দক্ষতা অনুপাতে অর্জন করা এবং সে ব্যবস্থা করা।
আওয়ার ইসলাম: অনলাইন সাংবাদিকতাকে কিভাবে দেখেন?
উবায়দুর রহমান খান নদভী: এটা অভিনব এবং বিস্ময়ের বিষয়। আমিতো সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত। এখন অনলাইন মিডিয়া দ্বারা সংবাদপত্র মানুষের হাতে হাতে চলে গেছে। সামান্য উদ্যোগ নিয়ে এখন মিডিয়ার মালিক হতে পারে। সারা বিশ্বে মিডিয়ার যে একটা প্রবাহ শুরু হয়েছে এটাকে পজিটিভভাবে ব্যবহার করে মানুষের কাছে মনুষ্যত্বের বাণী,ধর্মের বাণী পৌঁছে দেয়ার জন্য উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। অনলাইন মিডিয়াকে ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করি।
আওয়ার ইসলাম: অনলাইন পত্রিকার ভিড়ে আওয়ার ইসলামকে কিভাবে দেখেন এবং কিভাবে দেখতে চান?
উ র খা নদভী: অনলাইন পত্রিকা এ দেশে খুব দ্রুত এবং অনেক পরিমানে হয়ে গেছে। এমন কোনো নাম নাই, যে নামটা খালি। মনে হচ্ছে যে, প্রতিটি শিক্ষিত লোকেরই একটি করে অনলাইন আছে। জড়িত অথবা মালিক। এ ক্ষেত্রে কোয়ালিটি সম্পন্ন মিডিয়ার প্রয়োজন। মেধা এবং অধ্যবসায় ছাড়া, যোগ্যতা,দক্ষতা ছাড়া ভালো একটা মিডিয়া কেউ তৈরী করতে পারে না। এ হিসাবে দেশে হাতে গোনা কয়েকটি মিডিয়া আছে, যেগুলো মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এর মধ্যে নবাগত হিসাবে আওয়ার ইসলাম অতুলনীয়। এর নামকরণ যখন হয়, তখন আমি চিন্তিত ছিলাম যে, পত্রিকাটা একমুখী হয়ে যায় কি না। কিন্তু পরে যখন এর উদ্যোক্তা এবং কর্মীদের পারমরমেন্স দেখতে পাই, তখন বুঝলাম, শুধু ইসলাম না ইসলামের সাথে জীবন-জগত, তথ্য বিনোদন, রুচিশীল ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ের সমন্নয় ঘটেছে। দিনে দিনে তাদের মধ্যে যে সৃষ্টিশীলতা এবং রুচিশীলতা পরিলক্ষিত হচ্ছে তা অবশ্য প্রমাণ করার বিষয়। আওয়ার ইসলাম নিয়ে আমি খুব আশাবাদি এবং বেশ সন্তুষ্ট। ভবিষ্যতে আওয়ার ইসলামকে আরো গাতিশীল ও বিচিত্রমুখী হিসেবে দেখতে চাই। পাশাপাশি আমি মনে করি, পাঠকদের কাছে আরো বেশি গ্রহণযোগ্য হবে যদি বর্তমানে এতে যে বিষয়গুলো বাছাই করা হয় এর মধ্যে আরো চিন্তা-ভাবনার করে বিভিন্ন বিষয় যুক্ত করলে। কোন্ কোন্ দিক এমন আছে যেগুলো আমরা যুক্ত করছি না, সেগুলোকেও সংযুক্ত করতে হবে। এখানে কিছু টকশো, কিছু মতবিনিময় সামাজিকভাবে মানুষের সাথে কথাবার্তা বলে জনগণকে এতে সম্পৃক্ত করা , ভিডিও ব্যবহার করা যায় কি না। এমনকি আওয়ার ইসলাম অনলাইন টিভিতেও যেতে পারে। অনলাইন টিভির চাহিদা সারা বিশ্বে এখন সর্বোচ্চ। মানুষ স্বাভাবিক চ্যানেলগুলোর গতবাঁধা পোগ্রাম দেখতে চায় না। ছোট্র ছোট্র ফুটেজ দেখতে চায়। যেগুলো সারা বিশ্বে খুব দ্রুত পৌঁছতে পারে। এজন্য আওয়ার ইসলাম যদি অনলাইন,প্রিন্টের পাশাপাশি ভিডিও ভার্সনে যায় তাহলে আমার মনে হয় দ্রুত জনপ্রিয়তাও লাভ হবে, মানুষের চাহিদাও পূরণ হবে।