-
মুহিউস সুন্নাহ আল্লামা মাহমূদুল হাসানআমীর, মজলিসে দাওয়াতুল হকমুহতামিম, জামিয়া মাদানিয়া যাত্রাবাড়ী
হাদিসে শরিফে শবে বরাতের বিশেষ ফয়েয ও বরকতের কথা উল্লেখ রয়েছে। এ বরকত হাসিল হয় আমলের মাধ্যমে। তাই এটি হলো আমলের রাত, ইবাদতের রাত। অতীব পরিতাপের বিষয় যে, আমরা জযবার কারণে অনেক সময় উপকারের নিয়তে অপকার করে নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হই। অনেক সময় শরিয়ত এবং সুন্নতের সীমারেখা অতিক্রম করে বসি।
এ রাতে যাদের ভাগ্যে কল্যাণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে, যাদের দোয়া মঞ্জুর করা হবে, তারা বড়ই ভাগ্যবান। তারা মহান আল্লাহর প্রিয় বান্দা। যারা তাদের সাদৃশ্যতা অবলম্বন করে তাদের আশেপাশে থাকে, তাদের সঙ্গে উঠাবসা করে মহাব্বত ও শ্রদ্ধা রাখে, আল্লাহ পাক তাদের বঞ্চিত করেন না বলে ঘোষণা করেছেন।
রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দিকে ইঙ্গিত করে হাদিসে কুদসিতে উল্লেখ করেন, তারা পূণ্যশীল জামাতের সহযাত্রী, তাদের বঞ্চিত করা হবে না।
আসলে আমাদের এমন যোগ্যতা নেই যে, আল্লাহপাকের শান অনুযায়ী কোনো আমল এই রাতে তার দরবারে পেশ করব। তাহলে আমরা আল্লাহর রহমত এবং মাগফিরাতের অধিকারী কিভাবে হতে পারি? হতে পারি এভাবে যে, এ রাতে আমরা আল্লাহর প্রিয়জনদের সাদৃশ্য অবলম্বন করব, তাদের সঙ্গে বসব, তারা যা করে তাই করব।
এ রাতের ফজিলতের কথা হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে, অন্যান্য রাতে আল্লাহ পাক শেষ রাতে বান্দাকে ক্ষমা করার জন্য, বিপদমুক্ত করার জন্য এবং হালাল রিযিক প্রদানের জন্য আহ্বান করেন, আর এ রাতে প্রথম থেকেই আহ্বান জানাতে থাকেন। ফেরেশতাদের আগমনও প্রথম রাত থেকেই শুরু হয়ে যায়, তারা মানুষের জন্য আল্লাহর দরবারে কল্যাণের দোয়া করতে থাকে। হাদিসে পাকে আছে, শবে বরাতে অসংখ্য অগণিত ফেরেশতার আগমন ঘটে।
হযরত জিবরাঈল আ. পাখির ঝাঁকের ন্যায় অসংখ্য ফেরেশতাকে নিয়ে পৃথিবীতে আগমন করেন এবং সমগ্র পৃথিবীতে বিচরণ করেন। তারা ইবাদতে নিমগ্ন মানুষের নাম-ঠিকানা ও আমলসমুহের সূচিপত্র তৈরি করে মহান আল্লাহপাকের দরবারে জমা দিয়ে থাকেন।
আল্লাহ পাক মানুষের জীবন-মৃত্যুর আগে-পরের সব কিছু জানা সত্ত্বেও কেন ফেরেশতাদের এ রিপোর্ট দান করার ব্যবস্থা? এর রহস্য তিনিই ভালো জানেন। তবে মানব সৃষ্টির প্রথম পর্যায়ে ফেরেশতাদের ধারণা ছিল যে, মানব জাতি পৃথিবীতে ফেতনা-ফাসাদের মাধ্যমে চরম বিপর্যয় সৃষ্টি করবে, আল্লাহর নাফরমানিতে সমগ্র পৃথিবীতে জটিলতার সৃষ্টি হবে। এরা আল্লাহ পাকের ইবাদত এবং দাসত্বের যথাযথ হক আদায়ে ব্যর্থ হবে। তারা এ ব্যাপারে আল্লাহপাকের দরবারে আবেদন-নিবেদনও পেশ করেছিল। অথচ এই মানুষের মধ্যেই আছে মাকামে বেলায়েত এবং রিসালাতের যোগ্যতার অধিকারী নবী-ওলীগণ। আল্লাহপাকের সৃষ্টির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তাদের মাধ্যমেই সফল হবে। তারাই হবে আল্লাহপাকের গৌরব ও কৃতিত্বের পাত্র। হাদিসে পাকে আছে, এ রাতে আল্লাহ পাক মানুষকে নিয়ে ফেরেশতাদের সম্মুখে গৌরববোধ করেন। এজন্যই হয়ত ফেরেশতাদের মাধ্যমে তাদের অবস্থান নির্ধারনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে।
অপর এক হাদিসে রয়েছে যে, ফেরেশতারা আল্লাহ পাককে মানুষের ইবাদত, আমল-আখলাক সম্পর্কে অবহিত করে বলে যে, তারা তাদের কৃত গোনাহ-খাতার জন্য অশ্রুসিক্ত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করছে। জাহান্নাম থেকে মুক্তি এবং জান্নাত লাভের জন্য মোনাজাত করছে। তখন আল্লাহ পাক ফেরেশতাদের সাক্ষী রেখে উপস্থিত সব মানুষের প্রতি ক্ষমা ঘোষণা করেন।
[শবে বরাত: না বাড়াবাড়ি, না ছাড়াছাড়ি]
আল্লাহ পাক সমবেত সবারই প্রতি ক্ষমা ঘোষণার ফলে ফেরেশতারা বলেন, ‘হে আল্লাহ! অমুক লোকটা তো এমনিতেই তাদের সঙ্গে বসে আছে। তার প্রতি ক্ষমা ঘোষণা হেতু কী?’ তখন আল্লাহ বলেন, ‘আমার প্রিয় বান্দার সাহচর্যে যারা থাকে আমি তাদের সম্মানার্থে ওদেরকেও ক্ষমা করে থাকি। যারা তাদের সহকর্মী হয়, তাদেরও বঞ্চিত করা হয় না।’
এই রাতে আমরা সবাই আল্লাহর কাছে আবেদন-নিবেদন করব এবং অশ্রুসিক্ত হয়ে আল্লাহর প্রিয়জদের পাশে থেকে তার দরবারে এভাবে প্রার্থনা করব, হে আল্লাহ! আমরা অপরাধী, তোমার দরবারে পেশ করার মতো কোনো যোগ্যতা আমাদের নেই, তবে আমরা তোমাকে, তোমার প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি, অন্তরে রয়েছে তোমার প্রতি অনুরাগ, জাহান্নামের ভয়, জান্নাত লাভের কামনা, তোমার করুণার কোনো শেষ নেই, তুমি করুণা করে আমাকে মানুষরূপে সৃজন করেছ, লক্ষ-কোটি নেয়ামতদানে বাধিত করেছ।
আর মহান এ রাতে তোমার দরবারে তোমার প্রিয়জনদের সঙ্গে বসে মোনাজাতের সুযোগ দিয়েছ। হে রাহমানুর রাহীম! তুমি দয়া করে আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমার সন্তান-সন্তুতি, আমার পরিবার-পরিজন, আমার দেশ ও দেশবাসী এবং সব উম্মতকে তুমি ক্ষমা করে দাও। তোমার ওলী-বুজুর্গদের তুফাইলে, তাদের বরকতে দয়া করে তোমার গোলাম বানিয়ে নাও। জীবিত এবং মৃত সবাইকে ক্ষমা করে দাও। তোমার বিশেষ রহমতের অধিকারী বানাও। অতীতের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি, আর বর্তমান ও ভবিষ্যতে সিরাতে মুস্তাকিমের ওপর কায়েম দায়েম থাকার জন্য মোনাজাত করছি।
অনুলিখন : মাওলানা রিদওয়ান হাসান