মাওলানা হাবিবুর রহমান মিসবাহ। এই সময়ের আলোচিত তরুণ ওয়ায়েজ। সারাদেশে প্রতিবছর ছয় শতাধিক মাহফিল করেন। যাত্রাবাড়ীতে মারকাজুত তাকওয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার নামে প্রতিষ্ঠা করেছেন ভিন্নধর্মী মাদরাসা। আলেমদের কাছে ইতোমধ্যেই সারা ফেলেছে মাদরাসাটি। ২০০৬ সালে দক্ষিণবঙ্গের বিখ্যাত বরিশাল মাহমুদিয়া মাদরাসা থেকে দাওরায়ে হাদিস শেষ করেন। ইফতা পড়েন এ মাদরাসাতেই।সমকালিন বিষয়াবলি, তারুণ্য, কওমি স্বীকৃতি এবং ওয়াজ মাহফিরের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সম্প্রতি মারকাজুত তাকওয়ায় বসে তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আওয়ার ইসলামের নির্বাহী সম্পাদক রোকন রাইয়ান। সঙ্গে ছিলেন, হাসান আল মাহমুদ ও উবায়দুল্লাহ সাআদ।
আওয়ার ইসলাম: স্যোশাল মিডিয়ার কারণে তারুণদের মধ্যে এখন মারাত্মক অস্থিরতা কাজ করছে। এসব নিয়ে আপনি একবার ঘোষণা দিয়েছিলেন তরুণদের নিয়ে বসবেন। সেটা পিছিয়ে গেল কেন?
মাওলানা হাবিবুর রহমান মিসবাহ: ফেসবুকের ব্যাপারটা তো আসলে কারো একার হাতে নেই। এ ব্যাপারে আমি কয়েকজন সমমনা বন্ধুদের সাথে আলাপ করেছিলাম যাদের মধ্যে কেউ কেউ রাজনীতি করেন আবার কেউ করেন না। যাদের মধ্যে প্রতিনিধিত্ব করার মতো গুণ আছে। সেখানে আমি একটা প্রস্তাব দিয়েছিলাম ফেসবুকে আমাদের চিন্তাশীল কিছু তরুণ ও ওলামা আছেন যাদের নতুন প্রজন্ম ফলো করেন তাদের নিয়ে একটা সিক্রেট গ্রুপ থাকবে। যেখানে বিভিন্ন বিষয়ে ফেসবুকে কোনো ইস্যুতে আলোচনা হলে আমরা গ্রুপে আলোচনা না করে কেউ কোনো পোস্ট দেব না, কারো পক্ষেও না বিপক্ষেও না। মূলত ফেসবুকে যারা বিতর্কিত বা আক্রমণাত্মক পোস্ট দেয় তারা বড়দের ইঙ্গিত পেয়েই যখন কোনো পোস্ট পায় কিছু বাড়িয়ে কমিয়ে লিখে থাকে। সেক্ষেত্রে আমরা আলোচনা করে পোস্ট দেব। এই যেমন ফয়জুল করীম সাহেব হুজুরের তাবলীগ সংক্রান্ত বক্তব্য, কওমী মাদরাসার স্বীকৃতি, কওমি মাদরাসার বিরুদ্ধে যারা বক্তব্য দিচ্ছেন, সাম্প্রতিক সময়ে কাসেম বিন আবুবাকার এই সমস্ত ব্যাপারে একটা দিক নির্দেশনা আসতো গ্রুপ খেকে। কিন্তু সেটা করা সম্ভব হয়নি। আমার বিশ্বাস মাওলানা মামুনুল হক ভাইসহ অন্যরা যেটা শুরু করেছিল চেতনায় দারুর উলুম দেওবন্ধ সেটা চালু থাকলে তরুণদের অনেক উপকার হতো। আমাদের বড় সমস্যা কোনো প্লাটফর্ম শেষ পর্যন্ত টিকে না।
আওয়ার ইসলাম: এইযে সংগঠন সহজে হয়ই না আবার দাঁড়াতেই ভেঙ্গে যায় এটার কারণ কী?
মাওলানা হাবিবুর রহমান মিসবাহ: আমরা যদিও বলি চিন্তার ঐক্য চাই মূলত সবাই কোনো একটা গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছি। যে কারণে দশজন মানুষ আবেগে একটা কথা বললেও নিজেদের সীমানায় গেলে হয়তো তাদের মুরুব্বি বা বন্ধুবান্ধবের থেকে চাপ আসে। মোট কথা এটাকে দলান্ধতা বলতে পারেন। এক্ষেত্রে আমার পরামর্শ হলো আমাকে অবশ্যই মুরুব্বি মানতে হবে পাশাপাশি চিন্তার একটা ঐক্যও থাকতে হবে। সঠিকটাকে সঠিক বলা, অনেক সময় সঠিকটাও সরাসরি বলা যায় না কৌশল অবলম্বন করতে হয়। যখন আমরা একত্রে বসব তখন রাজনৈতিক বিতর্কিত বিষয়ে আলোচনা হবে না। আমরা বসব ইস্যু ছাড়া। একবার বসেও ছিলাম তখন আমি বলেছিলাম আমাদের এখানে কোনো পদ পদবি থাকবে না।
আওয়ার ইসলাম: পরে সেটা আর এগোয়নি কেন?
মাওলানা হাবিবুর রহমান মিসবাহ: এটা আমার ব্যক্তিগত ব্যস্ততাসহ বিভিন্ন কারণে এগোয়নি। মূলত ব্যস্ততা একটা অযুহাত জাতীয় উপকারের জন্য আমি ব্যস্ততা রেখেও প্রস্তুত ছিলাম কিন্তু শুরুতে সবার যে আগ্রহটা ছিল সেটাতেও ভাটা পড়ে যায়। কেউ কেউ মন্তব্য করেছিল মিসবাহ সাহেব মনে হয় কিছু একটা করবে, মিসবাহ সাহেব মনে হয় দল করবে, এরকম একটা সন্দেহ কাজ করায় অপবাদ থেকে বাঁচার জন্য আমি চুপ হয়ে গেছি।
আওয়ার ইসলাম: ফেসবুকে যেসব অসংলগ্ন কথাবার্তা হয় , বকাবকি বা ধারণাপ্রসুত গালাগালি হয়- দেখা যায় এতে অধিকাংশ মাদরাসা ছাত্রও জড়িত এটা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়?
মাওলানা হাবিবুর রহমান মিসবাহ: আমি মনে করি এটা প্রত্যেকটি মাদরাসা থেকে উপযুক্ত নির্দেশনা দিলে শতভাগ না হলেও নিরান্নব্বই ভাগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এমনিতে তো মাদরাসা মোবাইল চালোনোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে তারপরেও চলে। বিশেষ করে প্রাইভেট মাদরাসাগুলো ছাত্র ধরে রাখার জন্য এখন ছাড় দিচ্ছে। দেখা যাচ্ছে তারা অবাধে মোবাইল ব্যবহার করছে। কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকছে না। তারা কিছু দেখলেই অন্যায় মনে করে ঝাপিয়ে পড়ছে।
আওয়ার ইসলাম: আপনিও তো প্রাইভেট মাদরাসা পরিচালনা করছেন? অভিযোগটা আপনাকেউ করতে পারি।
মাওলানা হাবিবুর রহমান মিসবাহ: হ্যাঁ আমিও প্রাইভেট মাদরাসা করেছি। তবে উদ্দেশ্য আছে। প্রাইভেট মাদরাসাও যে কড়াকড়িভাবে পরিচালনা করা যায় সেটা স্পষ্ট করতেই আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। আলহামদুলিল্লাহ আমার মাদরাসায় কোনো ছাত্রের মোবাইল নাই। আমি যে ভালোভাবে পরিচালনা করতে পারছি তা নয় এরচেয়েও ভালো ভালো কিছু প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান আছে অবশ্যই। কিন্তু আমি সবদিক থেকে একটা নিয়ন্ত্রণের ভেতর রাখি ছাত্রদের। আমলের ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেয়া হয় না এখানে। যে কারণে এত অল্প সময়ে মারকাজুত তাকওয়া খ্যাতি পেয়েছে।
আওয়ার ইসলাম: নতুন নতুন প্রাইভেট মাদরাসা হচ্ছে প্রায়ই- এটা কীভাবে দেখবেন?
মাওলানা হাবিবুর রহমান মিসবাহ: মাদরাসা বৃদ্ধি পাওয়াটা খারাপ নয়। কেজি স্কুল, প্রাইমারি স্কুল এবং শিক্ষার্থী তুলনায় মাদরাসা আরো হওয়া চা্ই। কিন্তু ব্যাপার হলো যাদের ভালো কোনো মাদরাসায় শিক্ষকতা করার যোগ্যতা নাই তাদের মাঝে নামকাওয়াস্তে একটা মাদরাসা খুলে নামের আগে মুহতামিম লাগানোর প্রবনতা লক্ষ্য করা যায় এটা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এক্ষেত্রে বোর্ডগুলো ভূমিকা রাখতে পারে। বোর্ড-এর নিয়ন্ত্রিত নীতিমালা থাকা দরকার।
আওয়ার ইসলাম: আপনার আশেপাশে অনেক বড় মাদরাসা আছে, সেখানে শিক্ষকতায় না গিয়ে আপনিও নতুন মাদরাসা করেছেন, কারণ কী?
মাওলানা হাবিবুর রহমান মিসবাহ: আমি প্রথমে নারায়ণগঞ্জে কাসেমুল উলুম মাদরাসার মুহাদ্দিস ছিলাম। ওখানে বেদাতিদের সাথে একটা সমস্যা হওয়ায় চলে আসি ঢাকায়। ঢাকায় হাদিউল উলুম নামে একটা মাদরাসায় শিক্ষকতা শুরু করি। কিন্তু কিছুদিন পর মাদরাসাটা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর আরেকটা মাদরাসায় আমাকে পরিচালক করা হয়। কিন্তু আমার কাছে মাদরাসা নিয়মতান্ত্রিকভাবে চলছিল না। অধিকাংশ প্রাইভেট মাদরাসাতেই আপনি দেখবেন সপ্তাহে একদিন ক্লাস করে বছর শেষে ছাত্ররা ইফতার সনদ পেয়ে যায়। বড় মাদরাসাগুলো বড় বড় ওলামায়ে কেরামরে তত্ত্বাবধানে নিয়মতান্ত্রিকভাবেই চলছে। প্রাইভেট মাদরাসা যে নিয়মতান্ত্রিকভাবে চালানো যায় জন্যই মারকাযুত তাকওয়ার প্রতিষ্ঠা। এছাড়া আমার মাদরাসা করার কোনো ইচ্ছে ছিল না। কারণ আমি জানি মাদরাসা পরিচালনা করা কতটা কষ্টের। আমার কোনো ব্যংক ব্যালেন্স নেই, বাড়ি নেই। মাদরাসার পিছনেই আমার যতো পরিশ্রম। মাদরাসার কঠোরতার কারণে ছাত্র সংখ্যা কিছুটা কম হলেও আমার মাদরাসা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য সফল বলে আমি মনে করি।
আওয়ার ইসলাম: এখানে কোনকোন বিভাগ আছে?
মাওলানা হাবিবুর রহমান মিসবাহ: উর্দূ থেকে মেশকাত, হিফজ এবং তাখাসসুস ফিল ইফতা বা ফতোয়া বিভাগ আছে। সামনে আমরা একটি তাখাসসুস খুলতে চাচ্ছি। তাখাসুস ফিল বয়ান।
আওয়ার ইসলাম: কওমি মাদরাসায় তো প্রতি সপ্তাহে একদিন বয়ান শেখানো হয়। বয়ান নিয়ে আলাদা বিভাগ খুলতে চাচ্ছেন কেন?
মাওলানা হাবিবুর রহমান মিসবাহ: সপ্তাহে একদিন বয়ান শিখে যদি বয়ান করা যেতো তাহলে তো সব ছাত্র শিক্ষকই বয়ান করতে পারতো। মূলত বিষয়টা আমি অনেক আগেই ভেবেছি কিন্তু প্রকাশ করিনি। আমি চাচ্ছিলাম বড়দের থেকে শুরু হোক কেননা তরুণ কাউকে দিয়ে কিছু শুরু হলে অনেক সময় সমালোচনায় পড়তে হয়। বাংলাদেশের অন্যতম একজন শীর্ষ আলেম, গ্রান্ড মুফতিও বলতে পারেন, আল্লামা দেলোয়ার হোসেন সাহেবের নিকট এটার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করার পর থেকেই বিষয়টি সামনে এনেছি।
দেশের সব মানুষ মাদরাসায় কিংবা তাবলীগে বা কোনো হক্কানী পীরের দরবারে যায় না কিন্তু এলাকার ওয়াজ মাহফিলে উপস্থিত হয়। এখন আমি বছরে কমবেশি এক কোটি মানুষের সামনে ওয়াজ করি। আমার ভেতর যদি জানার বা বলার ভুল থাকে তাহলে মানুষও ভুল শিখবে সেজন্য আমাকেও তো সঠিকটা জানতে হবে। এজন্যই নতুনরা যাতে শিখতে পারে তাই তাখাসসুস ফিল বয়ান চালু করার কথা ভাবছি। সমাজ পরিবর্তনে, সমাজের শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় ওয়াজের ভূমিকা অতুলনীয়। আইন করে মানুষকে যে কাজ থেকে ফেরানো যায় না ওয়াজ শুনার দ্বারা সেটা হয়ে যায়। মূলত শুদ্ধ ভাষায় সাবলীলভাবে কুরআন এবং হাদিসের সঠিক আলোচনা যাতে করতে পারে সে জন্যই একটা প্রশিক্ষণমূলক এই কোর্সের প্রয়োজন।
আওয়ার ইসলাম: আগে যেমন ওয়াজ শুনে মানুষের মাঝে ব্যপক পরিবর্তন হতো এখন সেরকমটা হচ্ছে না, কারণ কী?
মাওলানা হাবিবুর রহমান মিসবাহ: আগেই বলছি তাহকীকবিহীন আলেম নন, ওলামায়ে কেরামের সোহবতও নেই শুধুমাত্র সুরের উপর নির্ভর করে ওয়াজের ময়দানে আসায় সমস্যটা হচ্ছে। আলোচনায় বানোয়াট বেআমলি কথা বলা, ব্যবসা বা সুনামের উদ্দেশে ওয়াজের আয়োজন করা আরো বিভিন্ন কারণে মাহফিল অনুযায়ী হেদায়েতের সংখ্যা কম।
আরেকটা বিষয় বলি, ওয়াজের সুনির্দিষ্ট কিছু উপকার রয়েছে যেগুলোকে অস্বীকার করার উপায় নেই। যেমন মামলা বা গুলির ভয় দেখিয়ে মানুষকে মাদক বা চুরি ছিনতাই থেকে বিরত রাখা সম্ভব নয়। কিন্তু ওয়াজের মাধ্যমেই তা সম্ভব।
আওয়ার ইসলাম: একটা অভিযোগ আছে- ভালো বা গ্রহণযোগ্য আলেমদের সহজে দাওয়াত করতে না পেরেই আয়োজকরা যাকে তাকে দাওয়াত করেন।
মাওলানা হাবিবুর রহমান মিসবাহ: না, এটা মানতে পারলাম না। কারণ বাংলদেশে অসংখ্য আহলে হক ওলামায়ে কেরাম আছেন একজনকে না পেলে আপনি আরেকজনকে নিতে পারেন মূলত সবাই সুর খোঁজে। সবাই সুরের পাগল। আর যদি অভিযোগটি সত্যি ধরে নেই তাহলে আমাদের কোর্সটি সেক্ষেত্রে ফায়দা দিবে। ভালো আহলে হক আলোচক খুঁজে পেতে সাহায্য করবে।
আওয়ার ইসলাম: আরেকটা অভিযোগ আছে ওয়ায়েজদের ব্যাপারে- চুক্তি হাদিয়া নেয়া। এ ব্যপারে কী বলবেন?
মাওলানা হাবিবুর রহমান মিসবাহ: এটা আমার একার মতে কাজ হবে না তবে আমি মনে করি হাদিয়া নেয়া জায়েজ আছে। যারা নাজায়েজ বলে তাদের কাছে মূলত শক্তিশালী দলিল নাই। ইমাম আবু হানিফা রহ. বলেছিলেন দীনি কোনো কাজের হাদিয়া নেয়া জায়েজ নেই কিন্তু পরবর্তী ওলামায়ে কেরাম বলেছেন, দীনের বৃহত স্বার্থে এটা জায়েজ। এ ব্যপারে বাংলদেশের শীর্ষ ওলামায়ে কেরামেরও ফতোয়া আছ। আরেকটা বিষয় হলো চুক্তি। আমার ব্যাপারেও একটা অপবাদ ছড়ানো হচ্ছে- আমি চুক্তি করি। মূলত ওয়াজের বিনিময়ে আমার কোনো চুক্তি বা চাহিদা নেই, আপনি আমার দাওয়াতী দরখাস্ত ফরম দেখতে পানে। এখানে স্পষ্ট লেখা আছে ওয়াজের বিনিময়ে কোনো চুক্তি নেই তবে আমার যাওয়া আসা আমার সফরসঙ্গী ড্রাইভার খরচ বাবদ হাদিয়া দিতে হবে সেক্ষেত্রে আযোজকদের ইচ্ছা অনুযায়ী দিবে এবং সেটা কত দিবে তা দরখাস্তে উল্লেখ্য করতে হবে। পাশাপাশি দাওয়াত লেখার সময় যাতায়াত খরচ বাবদ কিছু টাকা অগ্রিম দিতে হবে। এটা এজন্য করি অনেক সময় আয়োজকরা বিভিন্নভাবে প্রতারণা করে থাকে। তবে হ্যাঁ শর্তাবলীর মধ্যে এটা্ও লেখা আছে যদি কোনো কারণে মাহফিল না হয় বা আমি মিস করি তাহলে নিজ দায়িত্বে অগ্রিম দেয়া টাকা ফেরত দেই। আমি প্রতিদিন গড়ে দুটি করে বছরে প্রায় ছয়শ মাহফিল করি। দরখাস্ত আসে দুই হাজারেরও বেশি। সেক্ষেত্রে সবাইকে তো আর সময় দেয়া সম্ভব না। যারা আমাকে না পায় তারাই মূলত বদনাম করে থাকে। অনেক সময় প্রচণ্ড অসুস্থতা থাকে মানুষ মাত্রই অসুস্থ হতে পারে কিন্ত আয়োজকরা এটা মানতে চায় না। গত বছর দেখেছি বিভিন্ন জায়গায় মাহফিলের পোস্টারে আমার নাম ব্যবহার করেছে অথচ আমাকে দাওয়াতই দেয়া হয়নি এই ধরনের কিছু কারণেও বদনাম হয়।
আওয়ার ইসলাম: আপনার বড় ভাই মাওলানা হাফিজুর রহমান সিদ্দিকও খুব পরিচিত ওয়ায়েজিন। দুজনের কণ্ঠ ও ওয়াজের ধরন একই মনে হয়। আপনি কি তার সুর নকল করেন? বা সুর নকল করাটা কি ঠিক?
মাওলানা হাবিবুর রহমান মিসবাহ: আসলে আমরা একই মায়ের পেটের ভাই সেই হিসেবে আমাদের সুরের মাঝে একটা মিল আছে। তাই বলে আমি তারটা নকল করি এমন না। আমরা দুই ভাই প্রায় একই সময়ে আলোচনা শুরু করি, এক সাথেই রিহার্সেল করতাম সেজন্য কিছুটা মিল আছে। তারপরেও দুজনের আলোচনা এক সাথে শুনে দেখবেন দুজনের কথা বলার ভঙ্গিতে যথেষ্ট পার্থক্য আছে। এরপরেও বলতে চাই আমার জানা মতে বর্তমানে আমার ভাইয়ের সুরটাই বেশি নকল করা হয় এক্ষেত্রে কেউ যদি নিজের পরিচিতি বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে করে থাকে তাহলে সেটা জায়েজ হবে না সেটা হারামের পর্যায়ে চলে যাবে। আর সাধারণত এমনটাই হয়ে থাকে। অনেককে তো দেখি হুবহু ভাইয়ার কথা, আচরণ, অঙ্গভঙ্গি পুরোটাই নকল করে এটা নিন্দনীয়।
আওয়ার ইসলাম: হেলিকপ্টারে ওয়াজ করতে যাওয়া নিয়ে একটা সমালোচনা শোনা যায়। বলা হয় অনেক কষ্ট করে ওয়াজের টাকা কালেকশন করেন আয়োজকরা, এ কারণে হেলিকপ্টার ব্যবহার অনুচিত?
মাওলানা হাবিবুর রহমান মিসবাহ: এ ব্যপারে অনেকে বলে মাদরাসার ছাত্ররা এক দু টাকা কালেকশন করে বক্তা এসে একত্রে সব টাকা নিয়ে যায়। আমি বলবো এটা ঠিক নয় কেননা এভাবে কালেকশন করে বড় অংকের টাকা আসে না। আয়োজকরা অনেক সময় দু একজন আলোচক ঠিক করে তাকেই নেয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে। তখন দেখা যায় সময় স্বল্পতা সত্তেও আয়োজকদের চাহিদার কারণে হেলিকপ্টারে যেতে হয়। আর এটার ব্যবস্থা করে তার ভক্তরা। এছাড়া মনে করি কোনো বক্তাই বিলাসিতার জন্য হেলিকপ্টারে নিতে উৎসাহ দেয় না। তবে হ্যাঁ কাছাকাছি কোথাও মাহফিল হলে হেলিকপ্টার ব্যবহারে ওলামায়ে কেরামদের সতর্ক থাকতে হবে। সর্বোপরি কোথাও যদি বিমান রিজার্ভ করেও ওলামায়ে কেরামকে যেতে হয় সেক্ষেত্রে আমি মনে করি ওলামায়ে কেরামের শানই বৃদ্ধি হবে এবং ওলামায়ে কেরামের শান উঁচু থাকাই উচিত। কেউ যদি এটার বিরোধিতা করে তবে সেটাকে প্রতিহিংসাই বলবো।
ওয়াজের সুনির্দিষ্ট কিছু উপকার রয়েছে যেগুলোকে অস্বীকার করার উপায় নেই। যেমন মামলা বা গুলির ভয় দেখিয়ে মানুষকে মাদক বা চুরি ছিনতাই থেকে বিরত রাখা সম্ভব নয়। কিন্তু ওয়াজের মাধ্যমেই তা সম্ভব।
আওয়ার ইসলাম: কওমি মাদরাসার স্বীকৃতিকে কীভাবে দেখছেন?
মাওলানা হাবিবুর রহমান মিসবাহ: আসলে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত পাকিস্তানে কওমি মাদরাসার স্বীকৃতি আছে সেখানকার প্রেক্ষাপট কিন্তু ভিন্ন। ভারতে দেওবন্দের সনদ নিয়ে অন্যান্য ভার্সিটিতে ভর্তির সুযোগ আছে বাংলাদেশেও এশিয়ান ইউনিভার্সিটিসহ কয়েকটা ভার্সিটিতে দাওরার সনদে ভর্তি হওয়ার সুযোগ ছিল বা আছে। আর পাকিস্তানে রাষ্ট্রীয়ভাবে মাদরাসা শিক্ষা গুরুত্বের সঙ্গে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। আমাদের দেশে কিন্তু ব্যপারটা সম্পূর্ণই ভিন্ন। সরকারি নিয়ন্ত্রণ বা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে কওমি মাদরাসার স্বকীয়তা নষ্টের একটা শংকা থেকে যায়। তবে যেহেতু দেশের শীর্ষ ওলামায়ে কেরাম সম্মিলিতভাবে স্বীকৃতির পক্ষে কাজ করছেন সেজন্য স্বীকৃতির উপর আস্থা রাখতে চাই। শুধুমাত্র ব্যক্তিগতভাবে আমি স্বীকৃতির পক্ষে না।
আওয়ার ইসলাম: কওমি মাদরাসার সিলেবাস সংশোধনের প্রয়োজন আছে কিনা?
মাওলানা হাবিবুর রহমান মিসবাহ: এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। যুগের চাহিদাকে আমাদের অবশ্যই পূরণ করতে হবে। সেজন্য কিছু সংযোজন বিয়োজন হতে পারে। যেমন আগে কওমি মাদরাসার ছাত্ররা বাংলা ভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে পারেতো না এখন কিন্ত সেটা হচ্ছে। এরকম প্রয়োজনীয় বিষয়ের সংযোজন হতে পারে তবে সেটা বেফাক বা ওলামায়ে কেরামের তত্ত্বাবধানেই হতে হবে।
আওয়ার ইসলাম: অনেক আলেম বলেন ‘আমরা কওমি মাদরাসায় ডাক্তার ইঞ্জিয়ার তৈরি করি না বরং আলেম তৈরি করি’ বিষয়টি আপনার কাছে কেমন মনে হয়?
মাওলানা হাবিবুর রহমান মিসবাহ: আমি মনে করি এটা একপেশে কথা। আজকে আমাদের ফতোয়া বিভাগের ছাত্রদের বিদায়ী অনুষ্ঠান হয়েছে সেখানেও বলেছি যার যে যোগ্যতা বা গুণ আছে সে সেটাই করবে। সবাইকে মসজিদ মাদরাসার খেদমত করতে হবে তা নয়। যার লেখালেখির যোগ্যতা আছে সে তা করবে। যার সাংবাদিকতার যোগ্যতা আছে সে সাংবাদিকতা করবে।আমি যদি রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন করতে চাই তাহলে সব ক্ষেত্রেই আলেম লাগবে। আলেম ইঞ্জিয়ার লাগবে, আলেম ডাক্তার লাগবে, আলেম ব্যংকার লাগবে। সর্ব ক্ষেত্রেই আমাদের যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। আমার একটা স্বপ্ন আছে কওমি মাদরাসার এমন একটা সিলেবাস প্রণয়ন করা যেখানে একই সাথে আলেম হবে, ডাক্তার হবে, ইঞ্জিয়ারও হবে।
আওয়ার ইসলাম: আলেমদের সাংবাদিকতা, সাহিত্য, লেখালেখি কীভাবে দেখবেন?
মাওলানা হাবিবুর রহমান মিসবাহ: আমি মনে করি এটা অবশ্যই দরকার। যেমন আওয়ার ইসলাম আছে বলে আজকে আওয়ার ইসলামের মাধ্যমে আমার কথাগুলো সবার কাছে তুলে ধরছি। অন্যেরা তো আমাদের কথা প্রকাশ করবে না। লেখালেখির ক্ষেত্রে আমি বলবো কেউ যদি প্রেমের উপন্যাসও লিখে এবং সেটা হয় খারাপ দিকটার কুফল দেখিয়ে তার থেকে বিরত রাখার উদ্দেশ্যে তাহলে আমি বলবো এটা অবশ্যই দরকার।
আওয়ার ইসলাম: আপনার একটি ফেসবুক পোস্টে আল্লামা আহমদ শফী সাহেবকে নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল, কারণ কী?
মাওলানা হাবিবুর রহমান মিসবাহ: আসলে কিছু লোক আছে উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে বক্তব্য বিকৃত করে ধুম্রজাল সৃষ্টি করে। আমি এমন কোনো কিছু লিখিনি যার জন্য সমালোচনা হতে পারে। আমি আমার বক্তব্যের ব্যপারে কখনো বিতর্ক সৃষ্টি হলে আমার কিছু মুরুব্বি আছে চট্রগ্রামের আল্লামা শাহ মোহাম্মদ তৈয়্যব সাহেব ওনাদের মতো বড়দের পরামর্শ নেই। ইদানিং কোনো বক্তব্যে তাদের অমত পাইনি। এর আগেও আল্লামা নুর হোসাইন কাসেমী সাহেবকে নিয়েও আমার একটা বক্তব্যের অপপ্রচার হয়েছিল। মূলত এরা সমালোচনা করার জন্যই এসব করে থাকে।
আওয়ার ইসলাম: ফেসবুকারদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন
মাওলানা হাবিবুর রহমান মিসবাহ: ফেসবুকারদের উদ্দেশ্যে বিশেষ করে এ কথাটি বলতে চাই- যারা ছাত্র তাদের জন্য আমার উপদেশ বা পরামর্শ হলো বিতর্কিত কোনো মন্তব্য বা লেখালেখি করবে না। কোনো কিছু যাচাই বাছাইবিহীন বলবেন না। বড় কেউ যদি লিখেও তবুও না। উপকারী দিক নিয়ে ভাবুন ও লিখুন।
পরাধীনতার শিকলে বন্দী পাহাড়ী শিশুদের শিক্ষা
পদক-পুরষ্কার নিয়ে আক্ষেপ নেই, আমি নাম যশ খ্যাতির জন্য লিখিনি’
এসএস