আওয়ার ইসলাম : উপমহাদেশে দেওবন্দি মতাদর্শের সুন্নী ও রেজভি মতাদর্শের বিবাদ নতুন কিছু নয়। প্রায় শতাধিক কাল ধরে চলে আসছে এ আদর্শিক দ্বন্ধ। সম্প্রতি কওমি মাদরাসার সনদের স্বীকৃতি প্রদানের পর সুন্নী ও দেওবন্দিদের বিবাদ নতুন করে আলোচনায় দেশের মিডিয়ায়। ১১ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী কওমি শিক্ষা সনদের মান ঘোষণা করেন এবং ১৩ এপ্রিল সনদের মান প্রদান করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন জারির পর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে করেছে ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামআত সমন্বয় কমিটি’ নামক সুন্নী জামাত।
সাংবাদিক সম্মেলন, গণমাধ্যমে প্রেস রিলিজ পাঠানো এবং ১৭ ও ১৮ এপ্রিল দেশব্যাপী প্রতিবাদ কর্মসূচিসহ নানা রকম প্রতিবাদমূলক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে চট্টগ্রাম ভিত্তিক এ সংগঠনটি। তাদের এ প্রতিবাদের কারণ অনুসন্ধান করে আওয়ার ইসলাম টুয়েন্টিফোর ডটকম। তাদের পাঠানো প্রেস রিলিজে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামআত সমন্বয় কমিটি মিডিয়া সেলের পক্ষে মুহাম্মদ ফরিদুল ইসলামের স্বাক্ষর ও নম্বর দেয়া হয়েছে।
উক্ত নম্বরে যোগাযোগ করে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামআত সমন্বয় কমিটির সভাপতি বা সেক্রেটারির নম্বর চাওয়া হলে নানা টালবাহানার পর বলা হয় মিডিয়ায় কথার বলার জন্য আমি দায়িত্বপ্রাপ্ত। আমার সঙ্গে কথা বলুন। অগত্যা তার সঙ্গেই আলোচনা শুরু হয়। আলোচনার এক পর্যায়ে তিনি ফোন কেটে দেন। এরপর তাকে বার বার ফোন করা হয়েছে। তিনি হয়তো ব্যস্ততা দেখিয়ে কথা বলতে অস্বীকার করেছেন অথবা ফোন কেটে দিয়েছেন। অবশেষে তার কাছে এসএমএসের মাধ্যমে ফোন ধরার এবং অন্তত পক্ষে তার একটি ছবি চাওয়া হয়। কিন্তু তিনি তাতে কোনো সাড়া দেন নি। তাই বাধ্য হয়েই আমরা তার অসম্পূর্ণ ও ছবিছাড়া সাক্ষাৎকার প্রকাশ করছি। তার সাথে কথা বলেছেন, আওয়ার ইসলাম টুয়েন্টিফোর ডটকমের রিপোর্টার আবরার আবদুল্লাহ।
আওয়ার ইসলাম : আপনারা কওমি সনদের স্বীকৃতি প্রদানের বিরোধিতা করছেন কেনো?
ফরিদুল ইসলাম : বিগত দেড়শো থেকে দুইশো বছর থেকে দেওবন্দি ও ওহাবিরা তাদের প্রচলিত পদ্ধতিতে শিক্ষা দিয়ে আসছে। তারা সরকারের কোনো কারিকুলাম মানে না। সরকার কোনো নিয়ম ও শর্ত ছাড়াই তাদেরকে সনদ দিচ্ছে। এমনকি তাদের এসএসসি, এইচএসসি ও ডিগ্রির মান না দিয়ে সরাসরি মাস্টার্সের মান দিয়েছে। এটা অযৌক্তিক। আমরা এর বিরোধিতা করছি।
মাস্টার্সের সনদ প্রদান করে বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু তাদেরকে সনদের মান প্রদান করবে বোর্ড। এটাও অযৌক্তিক।
আওয়ার ইসলাম : তাহলে আপনারা কী চান মান না দেয়া হোক?
ফরিদুল ইসলাম : আমরা চাই তাদেরকেও মান দেয়া হোক। কিন্তু কিছু শর্তের আলোকে। আমরা তাদেরকে মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে চাই। যেমন, ধরেন বাংলাদেশে আলিয়া মাদরাসা রয়েছে। তাদেরকে যদি আলিয়া মাদরাসার অধীনে এবং সরকারি কারিকুলামের শর্তে সনদ দেয় আমাদের কোনো আপত্তি থাকবে না।
আওয়ার ইসলাম : প্রধানমন্ত্রী বলেছেন আরবি বিশ্ববিদ্যালয় কওমি মাদরাসার সনদ ইস্যু করবে। তাহলে তো আপনাদের আপত্তি থাকার কথা না?
ফরিদুল ইসলাম : আরবি বিশ্ববিদ্যালয় সনদ ইস্যু করলেও পরীক্ষা ও শিক্ষা কারিকুলামে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। সরকারের নিয়ন্ত্রণ না থাকলে সরকার কেনো তাদেরকে সনদ প্রদান করবে?
আওয়ার ইসলাম : আপনাদের প্রেস রিলিজে লিখেছেন কওমি মাদরাসা জঙ্গিবাদের সাথে জড়িত। আপনাদের হাতে কোনো প্রমাণ আছে?
ফরিদুল ইসলাম : সদ্য ফাঁসি দেয়া জঙ্গি নেতা মুফতি আবদুল হান্নান কওমি মাদরাসায় পড়েছেন। এছাড়া অতীতে যারা জঙ্গি হিসেবে ধরা পড়েছে তারাও কওমি মাদরাসায় পড়েছে বলে মিডিয়াতে প্রকাশ পেয়েছে।
আমরা মনে করি, কওমি মাদরাসার সনদের স্বীকৃতি দিলে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটবে।
আওয়ার ইসলাম : জঙ্গি নেতা শায়খ আবদুর রহমান ও আতাউর রহমান সানি তো আলিয়া মাদরাসার ছাত্র ছিলেন। এছাড়া এখন কলেজ ও ভার্সিটির অনেক শিক্ষার্থী জঙ্গি তৎপড়তার সাথে জড়িত?
ফরিদুল ইসলাম : আমাদের ধারণা, জঙ্গিদের যারা কওমি মাদরাসায় না পড়লেও মতাদর্শে বিশ্বাসী।
আওয়ার ইসলাম : আপনারা আলিয়া মাদরাসার সঙ্গে তুলনা করছেন কেনো? আলিয়ার অধীনে আসতে বলছেন কেনো?
সনদের মান গ্রহণে কওমি স্বকীয়তায় কোন ছাড় দেইনি: আল্লামা আহমদ শফী
ফরিদুল ইসলাম : আলিয়া মাদরাসা শিক্ষার্থীরা পাঁচটি ধাপ (জেডিসি, দাখিল, আলিম, ফাজিল, কামিল) মান পাবে আর এরা মাত্র পাঁচ বছর পড়ে মাস্টার্সের মান পাবে। সেটা কী করে হয়? বৈষম্য হচ্ছে না?
আওয়ার ইসলাম : মাত্র পাঁচ বছর? আপনি জানেন? আমি তো জানি, কওমি মাদরাসায় দশ বছর পড়লে দাওরায়ে উত্তীর্ণ হয়?
ফরিদুল ইসলাম : আমি জানি, দশ বারো বছর হয় মক্তব নাজেরা মিলে। এমনি পাঁচ বছর পড়েই এরা সনদ পেয়ে যাবে।
আওয়ার ইসলাম : আপনার কী মনে হয়, সরকার কোনো কিছু না জেনেই হুট করে সনদের স্বীকৃতি দিয়েছে? কেনো এমন করলো সরকার?
কওমি স্বীকৃতি ও তথাকথিত সুন্নিদের প্রতিবাদ; একটি পোস্টমর্টেম
ফরিদুল ইসলাম : হয়তো সরকারকে ভুল বোঝানো হয়েছে অথবা সরকার ভোটের রাজনীতির জন্য তাদেরকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
আওয়ার ইসলাম : আপনার মানববন্ধন ও প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদানের কর্মসূচি দিয়েছেন। যদি সরকার দাবি না মানে তাহলে কী করবেন?
ফরিদুল ইসলাম : সরকার আমাদের দাবি না মানলে বৃহত্তর কর্মসূচি দিতে বাধ্য হবো।
আওয়ার ইসলাম : আপনারা তো ইসলামপন্থী দল তাহলে এক ধারার মাদরাসার সনদের স্বীকৃতি প্রদানের প্রতিবাদে রাস্তায় নামলেন কেনো?
ফরিদুল ইসলাম : আমরা প্রতিবাদ করছি, কারণ এক দেশে সরকার স্বীকৃতি দুই রকম মাদরাসা ব্যবস্থা থাকতে পারে না। আমাদের দাবি, তাদেরকে আলিয়া মাদরাসার সাথে একীভূত করে সনদের মান দেয়া হোক।
সরকার স্বেচ্ছায় হোক অথবা সরকারকে ভুল বোঝানোর মাধ্যমে হোক স্বীকৃতির ঘোষণা হয়ে গেছে এবং প্রজ্ঞাপনও জারি করা হয়েছে। এখন তো আর ঘরে বসে থাকা যায় না। কর্মসূচি না দিলে সরকারের ভুল ভাঙ্গবে না।
আওয়ার ইসলাম : আপনারা কেনো মনে করছেন, কওমি মাদরাসার শিক্ষা কারিকুলাম পরিবর্তন করা দরকার?
ফরিদুল ইসলাম : কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীরা বর্তমান পৃথিবী সম্পর্কে কোনো খবর রাখে না। তাদের আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান পড়ানো হয় না। এসব বিষয়ে তাদের কোনো জ্ঞানও নেই।
আর তাদেরকে সরাসরি মাস্টার্সের মান দেয়া হচ্ছে। পৃথিবীর কোথাও কি এমন দৃষ্টান্ত রয়েছে?
আওয়ার ইসলাম : ভারত ও পাকিস্তানে কওমি সনদের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে এবং সেটা সরাসরি মাস্টার্স।
ফরিদুল ইসলাম : না এটা একটা ভুল প্রচার। পাকিস্তানে দরসে নিজামি পড়ানো হয়। দরসে নিজামিতে ৭ বছর পড়ে শিক্ষার্থীরা আলিয়া ধারায় চলে যায়। পরীক্ষা দিয়ে মান নেয়।
কওমি সনদের স্বীকৃতি বাতিলে সুন্নী জামাতের কর্মসূচি ঘোষণা
আওয়ার ইসলাম : বাংলাদেশের কওমি মাদরাসায়ও তো দরসে নিজামি পড়ানো হয়?
ফরিদুল ইসলাম : এদেরটা দাওরা না? এরা দরসে নেজামি পড়ায় না। দরসে নেজামি আমরা আমাদের কিছু কিছু মাদরাসায় পড়াই। তারা দরসে নেজামি পড়ে আলিয়ায় চলে যায়।
আওয়ার ইসলাম : আপনি কী জানেন বিষয়টা? বাংলাদেশের কওমি মাদরাসায় দরসে নিজামি পড়ানো হয় না, পাকিস্তানে পড়ানো হয়?
ফরিদুল ইসলাম : আমরা পাকিস্তানে আমাদের যেসব আলেম আছে তাদের কাছ থেকে বিষয়টা ভালো করে জেনেছি। পাকিস্তানে দাওরার কোনো সরকারি মান নেই। তবে বেসরকারিভাবে কোনো কোনো স্কুল কলেজে পড়ার সুযোগ পায়।
আওয়ার ইসলাম : আচ্ছা যাক, দারুল উলুম দেওবন্দের দাওয়ার ছাত্রদের এমএ-এর মান দেয়া হয়েছে এবং তারা আলিগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করতে পারে- আমরা এমনটাই জানি?
ফরিদুল ইসলাম : এটা সম্পূর্ণ ভুল তথ্য। সরকারকে ভুল তথ্য দেয়া হয়েছে।
আওয়ার ইসলাম : আপনারা আলিয়া মাদরাসার সঙ্গে একীভূত করার কথা বলছেন, কিন্তু সরকার ও সাধারণ মানুষের অভিযোগ হলো, সেখানেও জঙ্গি তৈরি হচ্ছে এবং তা শিবিরের মূল ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত?
এ কথার এ পর্যায়ে কল এসেছে বলে তিনি লাইন কেটে দেন।