কাজী আবুল কালাম সিদ্দীক
লেখক, সম্পাদক ও কলামিস্ট
এরদোগান অধ্যায়
গত কিস্তিতে আমরা তুরস্কের নিকট অতীত নিয়ে মোটাদাগে একটি ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেছি। পরবর্তী এক সময়ে আমরা তুরস্কের প্রাচীন ঐতিহ্য ও সোনালী ইতিহাস নিয়ে বিশদ আলোচনা করবো। ইনশাআল্লাহ।
প্রিয় পাঠক! একটি বিষয় লক্ষ করেছেন কি! সময়টা কিন্তু যাচ্ছে একপ্রকার এরদোগানময়। একদিকে এরদোগানের দেশ তুরস্ক ও ইউরোপীয় কয়েকটি দেশের মধ্যে উত্তেজনা তুঙ্গে। যার কারণে জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রিয়ার সঙ্গে তুরস্কের সৃষ্টি হয়েছে মারাত্মক ক‚টনৈতিক সংকট। আরেকদিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তুরস্কের প্রতি রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। তাদের কেউ কেউ খুবই আপন ভাবে এরদোগানকে। কেউ বা প্রাণের দুশমন মনে করে তাঁকে। সম্প্রতি পাঁচ সন্তান জন্ম দেয়ার প্রেরণাদায়ক বক্তব্য দেয়ায় এই প্রতিক্রিয়ায় এসেছে তীব্র তেজ। যাই হোক, বিষয়গুলো আমরা সামনে বিশ্লেষণ করবো। আপাতত, এই লোকটার সাথে একটু পরিচিত হয়ে নিই।
রজব তাইয়্যেব এরদোগান। ছোটবেলায় যে ছেলেটি রাজপথে লেবু বিক্রি করতো, কিন্তু ক্যারিশমা দিয়ে মন জয় করেছে জনগণের। কোস্টগার্ডের ছেলেটা নিজের দক্ষতা দিয়ে ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠা করলো ইসলামিক ধাঁচের দল এবং দুইবছরের মাথায়ই মানুষের মন জয় করে সেক্যুলার সরকারকে নামাতে সক্ষম হলো। তিনি মুসলিম বিশ্বের বিরাট জনগোষ্ঠীর কাছে ইসলামপন্থী নেতা হিসেবে পরিচিত আবার পশ্চিমাদের কাছে মডারেট নেতা হিসেবে স্বীকৃত। এরদোগানের তুরস্ক ‘নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন’ বা ন্যাটোর একমাত্র মুসলিম সদস্য।
এক সময়ে আধা পেশাদার হিসেবে ফুটবল খেলোয়াড় এবং ব্যবসায় শিক্ষায় স্নাতক ডিগ্রিধারী এরদোগান ১৯৯৪ সালে ইস্তাম্বুলের মেয়র নির্বাচিত হন। এ সময় তিনি দেড় কোটি লোকের এ শহরটির ট্রাফিক জাম এবং বায়ু দূষণ রোধে ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। যখন তার ইসলামঘেঁষা দলকে নিষিদ্ধ করা হয় তখন বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি এ সময় একটি ইসলামী কবিতা পাঠ করেন। সেই কবিতাটি ছিল এরকম- ‘মসজিদ আমাদের ব্যারাক, গম্বুজ আমাদের হেলমেট, মিনার আমাদের বেয়নেট এবং ঈমানদাররা আমাদের সৈনিক।’ এই কবিতার মধ্যে ধর্মীয় উসকানির গন্ধ পায় সেক্যুলার শাসকরা। তবে এরদোগান বারবারই এ কবিতা আবৃত্তি করেন।
দা ওয়াশিংটন ইন্সটিটিউটের তুরস্ক বিষয়ক গবেষক সোনার ক্যাগাপ্তে বলেন, এরদোগানের অর্থনৈতিক রেকর্ড এবং কর্তৃত্ববাদী মজলুম হিসেবে তার ইমেজই তাকে প্রেসিডেন্ট পদে জয় এনে দেয়। তুরস্কে কয়েক দশকের ঘনঘন সামরিক অভ্যূত্থান এবং দুর্বল জোট সরকারের পর স্থিতিশীল সরকার উপহার দেয়ার জন্য এরদোগানের প্রশংসা করা হয়।
তিনি শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর লাগাম টেনে ধরেছেন। নতুন ব্রিজ, বিমানবন্দরসহ অন্যান্য বৃহৎ প্রকল্পের মাধ্যমে তিনি এক সময়ের তলাবিহীন তুরস্ককে শক্তিশালী বাজারে পরিণত করেছেন। তার শাসনামলে সাধারণ তুর্কিদের আয় তিনগুণ বেড়েছে। মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরেছেন তিনি। সা¤প্রতিক সময়ে এরদোগান তুরস্কে সেক্যুলারদের প্রবর্তিত হিজাবের ওপর নিয়ন্ত্রণ শিথিল করেছেন। মদ বিক্রিতে কড়াকড়ি আরোপ করেছেন। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ছেলেমেয়েদের সহ-অবস্থান নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছেন।
এরদোগানের বর্তমান বিজয় কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এক সময়কার মুসলিম খেলাফতের নেতৃত্বদানকারী অটোমান সা¤্রাজ্যের অধিকারী তুরস্ককে ডিমুসলিমাইজকরণের প্রধান হোতা কামাল পাশার নেতৃত্বে তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার যে তকমা দেয়া হয়েছিল সে বৃত্ত থেকে বেরুতে একেপিকে অনেক মেধা-মনন খাটাতে হয়েছে। যদিও প্রথম থেকেই তুরস্কের সাধারণ জনগণ ধর্মনিরপেক্ষতাকে মেনে নেয়নি। তা সত্তেও কামাল পাশার নেতৃত্বাধীন প্রশাসনযন্ত্রের কবল থেকে ইসলামের পুনঃজাগরণের বিষয়টি ছিল কল্পনারও অতীত। সেই অসাধ্য কাজটিই সম্পাদন করতে পেরেছে একেপি। দলটি প্রমাণ করেছে, মেধা-মনন, আন্তরিকতা, অঙ্গীকারের প্রতি গভীর দৃঢ়তা, জনগণের সমর্থন এবং সাংগঠনিক দক্ষতা থাকলে লক্ষ্য অর্জন অসম্ভব নয়। একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা মেনে নিয়েই এরদোগান অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার নিরন্তর লড়াই চালিয়েছেন।
১৯৫৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ইস্তাম্বুলে জন্মগ্রহণ করেন এরদোগান। ছাত্রজীবনে এরদোগান ঘধঃরড়হধষ ঞঁৎশরংয ঝঃঁফবহঃ টহরহড়হ নামে একটি সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এ সংগঠন ছিল মূলত ইহুদিবাদ ও কমিউনিজমবিরোধী সংগঠন। এছাড়া, তিনি ১৯৬৯ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত কাসিমপাসা ক্লাবের সেমি-প্রফেশনাল ফুটবলার ছিলেন। ১৯৭৪ সালের ৪ জুলাই এমিন গুলবারানকে বিয়ে করেন। আহমেদ বুরাক ও নাজিমুদ্দিন বিলাল নামে দুই ছেলে এবং সুমাইয়া ও এরসা নামে দুই মেয়ের বাবা এরদোগান।
চলবে...
প্রথম পর্ব: তুরস্ক : উসমানি খেলাফতের সমাধি থেকে আজ (১)