আওয়ার ইসলাম : সন্ত্রাস ও উগ্রবাদ বৈশ্বিক হুমকিতে পরিণত হয়েছে। ইউরোপ আমেরিকা থেকে শুরু করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো কেউ সন্ত্রাস থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারছে না। আত্মঘাতী ও চোরাগুপ্তা হামলার শিকার হচ্ছে প্রায়শই। গতকালই ব্রিটিশ পার্লামেন্টের বাইরে ঘটেছে সন্ত্রাসী আক্রমণ। সম্প্রতি বাংলাদেশেও কয়েকটি আত্মঘাতি হামলা ও তার প্রয়াস চোখে পড়েছে। দীর্ঘদিন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টার পরেও উগ্রপন্থা ও উগ্র সংগঠনগুলোকে নির্মূল করা সম্ভব হচ্ছে না।
ভয়ের কথা হলো, উগ্র মতাদর্শে জড়িয়ে পড়ছে সমাজের সব শ্রেণীর তরুণ ও যুবক। এখানে যেমন রয়েছে দরিদ্র্য অসহায় পরিবারের সন্তান, তেমন রয়েছে সর্বাধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ধনীর দুলাল। আরও দুঃখজনক ব্যাপার হলো এর সাথে কোনো না কোনোভাবে জড়িয়ে যাচ্ছে ইসলাম ও মুসলমানের নাম।
দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে উগ্রপন্থার উত্থান ও মুসলিম তরুণদের তার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার কারণ অনুসন্ধান করেছেন বিশিষ্ট আলেম ও শিক্ষাগবেষক চট্টগ্রাম ওমর গণি এমইএস কলেজের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন। আওয়ার ইসলামের পক্ষে তার সঙ্গে কথা বলেছেন আতাউর রহমান খসরু।
শিক্ষাবিদ ও আলেম ড. আ ফ ম খালিদ মনে করেন, আত্মঘাতী হামলা একটি অগ্রহণযোগ্য পদ্ধতি। এর মাধ্যমে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, আত্মঘাতী বোমা হামলা করে ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রয়াস ও বিধি-বিধান প্রয়োগের ধারণাটি আমার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা যুদ্ধের ময়দানেও আত্মঘাতী বোমা হামলা গ্রহণযোগ্য নয়। রাসুলুল্লাহ সা. এর যুগেও বিষয়টি গ্রহণযোগ্যতা পায় নি। যেমন কোনো এক জিহাদে একজন মুসলিম খুব বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করছিলেন। লোকেরা তার ব্যাপারে রাসুল সা. বললো, লোকটা কী জান্নাতি? রাসুল সা. বললেন, লোকটা জাহান্নামি। পরে দেখা গেলো লোকটি আত্মহত্যা করেছে।
তিনি বিপথগামী তরুণদের প্রশ্ন করে বলেন, ‘যুবকদের কাছে আমার প্রশ্ন, এভাবে বোমা মেরে, চোরাগুপ্তা হামলা চালিয়ে কী ইসলামের বিধি-বিধান ও ইসলামি আইন ও শাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব? না এভাবে ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। ইসলামের দেঢ় হাজার বছরের ইতিহাসে এভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠার কোনো দৃষ্টান্ত নেই।’
তবে তিনি জিহাদের অস্তিত্ব ও গুরুত্ব স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘হ্যা, ইসলামে জিহাদ রয়েছে।জিহাদ ফরজ। তবে জিহাদ ফরজ হওয়ারও কিছু শর্ত রয়েছে। বোমা মেরে দিলেই বা বোমা মেরে কিছু মানুষ হত্যা করলেই তা ইসলামে বর্ণিত ফরজ বিধান জিহাদ হয়ে যায় না। এতে ইসলামের কোনো উপকার হচ্ছে না। বরং ক্ষতি হচ্ছে।’
[caption id="attachment_29572" align="aligncenter" width="709"] গতকাল বিট্রিশ পার্লামেন্টের বাইরে আক্রমণের পর নিরাপত্তা বাহিনীর এ্যকশন[/caption]
ড. খালিদ বিপদগামী মুসলিম তরুণদের মনস্তত্ব বিশ্লেষণ করেন এভাবে, ‘এটা অবশ্যই বিবেচ্য যে এসব যুবকগণ কেনো আত্মঘাতী হয়ে উঠছে। তাদের মনে এমন কী দুঃখ যে তারা সবকিছু পাওয়ার পরও নিজের জীবন বিসর্জন দিচ্ছে। অথচ মানুষের কাছে জীবন সবচেয়ে প্রিয়।’ উত্তরে নিজেই বলেন, ‘এর অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটি কারণ হলো, পৃথিবীব্যাপী মুসলমানের উপর অন্যায় ও অত্যাচার। অবিচার ও বৈষম্য। আজ মুসলিম সমাজের উপর জোরপূর্বক বিভিন্ন বিবর্তনমূলক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিচ্ছে। এসব অন্যায়ের প্রতিবাদেই যুব সমাজ উগ্রপন্থা বেছে নিচ্ছে এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য আত্মঘাতী হয়ে উঠছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার মনে হয়, কেবল জঙ্গি দমন, উগ্রবাদ দমন ও সন্ত্রাস বিরোধী কার্যক্রমের মাধ্যমেই এ সমস্যার সমাধান হবে না। জঙ্গিবাদ দমনে আইন ও অস্ত্র প্রয়োগের পূর্বে বিশ্ব নেতাদের অবশ্যই মুসলিম নির্যাতন ও নিপীড়ন বন্ধ করতে হবে।’
উগ্রবাদ বৈশ্বিক হুমকি হয়ে ওঠার কারণও বিশ্লেষণ করেন এ শিক্ষাবিদ গবেষক। তার মতে, ‘স্বাধীন মুসলিম দেশের উপর আক্রমণ করে তা ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। ইরাকের আক্রমণ যে ভুল তথ্য তথা মিথ্যে অজুহাতে হয়েছিলো তা আমেরিকান কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেছে। এটা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। একজন মানুষ অন্য মানুষের উপর আক্রমণ করলে যদি সন্ত্রাস হয়, তবে স্বাধীন দেশের উপর যখন অন্য দেশ আক্রমণ করে তা কেনো সন্ত্রাস নয়? এটা অবশ্যই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। স্বজাতির উপর অবিচার ও অত্যাচার এবং তাদের এমন দুর্দশা মুসলিম যুবকদের ক্ষুব্ধ করে তুলছে।’
উগ্রবাদের ব্যাপারে বাংলাদেশের আলেমদের কঠোর অবস্থান স্পষ্ট করে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মূল ধারার এবং শীর্ষ স্থানীয় কোনো আলেম এ কাজকে সমর্থন করেন না। তাদের পরিচালিত কোনো প্রতিষ্ঠানে জঙ্গিবাদ প্রশ্রয় পায় না। তারা মনে করেন, এভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা যায় না। ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে হলে অবশ্যই তা করতে দাওয়াত, তালিম ও মানুষকে বোঝানের (জনসমর্থন তৈরির) মাধ্যমে। কোনো আতঙ্ক সৃষ্টি করে ইসলাম কায়েম করা যায় না। ইসলামের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের মাধ্যমে এবং সাহাবাদের জীবন থেকে দৃষ্টান্ত গ্রহণ করেই ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে হবে।’
‘ইসলাম প্রচার, প্রসার আর প্রতিষ্ঠা যাই বলি না কেনো তা সম্ভব হয়েছিলো ইসলাম প্রচারকদের চারিত্রিক মাধুর্য, ইসলামের উদারতা, ইসলামের সৌন্দর্য, ইসলামের কল্যাণকামিতা ও ইসলামের অন্তর্নিহিত শক্তির মাধ্যমে।’
ড. খালিদ বিশ্বব্যাপী উগ্রবাদের উত্থানে মিডিয়ার ভূমিকার সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, ‘মিডিয়ায় জিহাদকেই সন্ত্রাস ও উগ্রতা হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করছে। এতে তরুণ প্রজন্ম আরও বেশি বিভ্রান্ত হচ্ছে। তাদেরকে সহজেই বোঝানো যাচ্ছে যে, কুরআনে বর্ণিত জিহাদেই তোমরা অংশগ্রহণ করছো। আসলে জিহাদ ও সন্ত্রাসকে গুলিয়ে ফেললে হবে না। জিহাদ রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোর মাধ্যমে কিছু শর্ত সাপেক্ষে ফরজ হয়। আবার কখনো ফরজে কেফায়া ও ওয়াজিব হয়। বোমা মারলেই জিহাদ হয়ে যায় না। জিহাদের সুনির্দিষ্ট কিছু কাঠামো আছে। কাঠামো মানলে জিহাদ অন্যথায় তা সন্ত্রাস বলে বিবেচিত হবে।’
[caption id="attachment_29573" align="aligncenter" width="653"] আস্কোনায় আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিহত নারী[/caption]
তিনি চলমান উগ্রবাদের স্বরূপ ও ফলাফল সম্পর্কে বলেন, ‘জিহাদের নামে আজ যা কিছু হচ্ছে তাতে প্রকারান্তে মুসলমানেরই ক্ষতি হচ্ছে। বিপদে পড়ছে। কোনো কোনো দেশে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না, কোথাও এয়ারপোর্টে আলাদা জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হচ্ছে, তাদের প্রতি সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। এগুলো ইসলাম প্রচারের পথে বড় অন্তরায়।’
প্রশ্ন হতে পারে, এ সংকট সমাধানের উপায় কী? উপায় সম্পর্কে লেখক ও গবেষক ড. আ ফ ম খালিদ বলেন, ‘আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের বিশাল একটি অংশ স্কুল, কলেজ ও ভার্সিটিতে পড়ে। আমাদের জাতীয় শিক্ষা কারিকুলামে ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা রয়েছে এসএসসি পর্যন্ত। এরপরও একজন শিক্ষার্থী এম এ পর্যন্ত সাত বছর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণ করে। সেখানে ইসলামি শিক্ষার কোনো অংশ নেই। এসএসসি পর্যন্ত যা কিছু পড়ানো হয় তার পুরোটাই বলতে গেলে ব্যক্তিগত জীবনে ইসলামের নৈতিক শিক্ষা সংক্রান্ত। ফলে তারা জানতে পারে না কোনটা হালাল, কোনটা হারাম, কোনটা সত্য ও কোনটা মিথ্যা। তাই আমাদের তরুণ জনগোষ্ঠিকে সহজেই ইসলামের নামে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। তরুণ প্রজন্মকে ইসলামের নামে ছড়ানো বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা করতে হলে জাতীয় শিক্ষা কারিকুলামে পরিপূর্ণ ইসলামি শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।’
এ ব্যাপারে তিনি আরও বলেন, ‘সরকারের মনে হয়েছে, আধুনিক যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য আইসিটি বিষয়টি পড়া দরকার। সরকার তা জাতীয় শিক্ষা কারিকুলামে যুক্ত করেছেন। সরকার মনে করলো স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদ্যয়ের ইতিহাস এ প্রজন্মের তরুণদের জানা দরকার, সরকার তা অনার্স পযন্ত সব সাবজেক্টে বাধ্যতামূলক করলো। একইভাবে তরুণ প্রজন্মকে ইসলামের নামে প্রচারিত বিভ্রান্তির হাত থেকে বাঁচাতে হলে শিক্ষার সর্বোচ্চ স্তর পযন্ত ইসলামি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। আজ সমাজে যারা জঙ্গিবাদের সাথে জড়িয়ে পড়ছে, উগ্রপন্থা বেছে নিচ্ছে তাদের অধিকাংশই ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখা পড়া করে নি। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে ধর্মীয় শিক্ষা উগ্রবাদ ছড়াচ্ছে না; বরং ধর্মীয় শিক্ষার অভাবে কুশিক্ষাই উগ্রবাদকে উস্কে দিচ্ছে।’
‘জাতীয় পর্যায়ে ইসলামি শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারলে তরুণ প্রজন্ম এ ধ্বংসযাত্রা থেকে বাঁচতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস। শুধু উগ্রপন্থা নয়; ইসলামি শিক্ষার অভাবে যেসব তরুণ নৈতিক ও মানবিক জীবন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, যারা সমাজে চুরি, ছিনতাই, সন্ত্রাস করছে, ইভটিজিং করছে তারাও উন্নত জীবন গড়ার সুযোগ পাবে। যারা ধর্মের সঠিক ব্যাখ্যা না জেনে নাস্তিক্যবাদের দিকে পা বাড়াচ্ছে, পত্র-পত্রিকা ও ব্লগে ইসলামের বিরুদ্ধে বিষেদাগার করছে তারা মুক্তির পথ পাবে যদি জাতীয় শিক্ষা কারিকুলামে ইসলামকে সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ রূপে তুলে ধরা যায়।’
ড. খালিদ মনে করেন, মুসলিম উম্মাহর অভিভাবক উলামায়ে কেরাম উগ্রবাদের ব্যাপারে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘আমার মনে হয়, এ ক্ষেত্রে আলেম উলামা ও পির মাশায়েখের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা সমাজের মানুষ ধর্মীয় বিষয়ে তাদের উপরই আস্থাশীল। তবে আলেম সমাজকে অবশ্যই সরকারের সাথে দ্বন্ধে না গিয়ে পারস্পারিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে কাজ করতে হবে। সেটাই বেশি ফলপ্রসূ হবে। যেমন, জাতীয় পাঠ্যপুস্তকের পরিবর্তনের বিষয়টি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে উলামায়ে কেরাম সেসব দাবি জানিয়েছিলেন তিনি কিন্তু তা রেখেছেন। একইভাবে এ ইস্যুতে যদি তাকে বোঝানো যায় যে, এটা নিছক ইসলামের স্বার্থেই। এখানে কোনো রাজনীতি নেই। তাহলে আশা করি তিনি বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন।’
এছাড়া আলেমগণ সভা, সেমিনার, আলোচনা সভা ও লেখালেখির মাধ্যমে সরকার, জনগণ ও তরুণ প্রজন্মের সামনে ইসলাম ও ইসলামি শিক্ষার স্বরূপ তুলে ধরতে পারেন। সচেতনতা তৈরি করতে পারেন; ওয়াজ, মাহফিল ও মসজিদের খুৎবায়ও তারা গণসচেতনতার কাজ করতে পারেন বলে তিনি মনে করেন।
-এআরকে