শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
কাল যাত্রাবাড়ী মাদরাসায় মজলিসে দাওয়াতুল হকের ইজতেমা শেখ হাসিনা ভারতে বসে দেশের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছেন: মজলিস মহাসচিব ডেঙ্গুতে এক সপ্তাহে ৩১ জনের মৃত্যু, আক্রান্ত ৬২৩০ মসজিদে নববীর আদলে হবে আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ: ধর্ম উপদেষ্টা খাগড়াছড়ি প্রেস ক্লাবের সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত নতুন নির্বাচন কমিশনকে বিগত কমিশন থেকে শিক্ষা নিতে হবে: মুফতী ফয়জুল করীম লালপুরে যুবলীগ নেতার বিরুদ্ধে জমি দখল ও বাড়ি ভাংচুরের অভিযোগ জনতার চেয়ারম্যান সৈয়দ তালহাকে সুনামগঞ্জ ৩ আসনে জমিয়তের প্রার্থী ঘোষণা কুরআন-হাদিসের ভিত্তিতেই হতে হবে সংস্কার: বায়তুল মোকাররমের খতিব ইসলামী সঙ্গীত সম্রাট আইনুদ্দীন আল আজাদ রহ.-এর বাবার ইন্তেকাল

নাচ-গান আর শিরকিতে কাটে শাহ আলী’র বৃহস্পতিবারের রাত

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

হাসান আল মাহমুদ
প্রতিবেদক, আওয়ার ইসলাম

দেড় হাত লম্বা মোমবাতি জ্বালিয়ে জলচকি সামনে রেখে বসে আছে জট বাঁধা বাবরির লালসালু পরা এক বাবা। কাছে বসে আলতো করে জিজ্ঞেস করলাম- এখানে কী করছেন বাবা? ধ্যান করি আর মাইনষের মনের বাসনা পূরণ করি।

ক্যামতে কিভাবে বাবা? শাহ আলী বাবার মাধ্যমে, মাইনষে আহে আর আমরা বাবার শিস্যরা বাবার কাছে কইলে বাবা কবর থেকেই তা পুরা কইরা দেন।

মৃতবাবা কবর থেকে কিভাবে পূরণ করেন? এ প্রশ্ন রাখলে লালসালুর বাবা থথমত খেয়ে রাগ করেন। বাবার রাগের কারণে তার পাশ ঘেঁষে বসা মুরিদরা তেড়ে বলে ওঠে 'ওই ছোকরা! তুমি কি বুঝবা এসবের!! আমি প্রস্থান করি সে কর্ণার থেকে।

[caption id="" align="alignnone" width="960"] এই ছবির ব্যক্তিকে আলী রা. বলে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়[/caption]

আরেক কর্ণারে এসে দেখি অনেক মহিলা বাবা। তাদের মুরিদ আবার পুরুষ। সবাই ব্যস্ত নিজ নিজ মুরিদ নিয়ে। উৎসুক দৃষ্টিতে হেঁটে হেঁটে দেখে যাচ্ছিলাম। ঠিক এমন সময় এক মহিলা বাবার ডাক এলো 'এই ছেলে এখানে আসো, বসো'। তাকিয়ে দেখি এ মহিলা বাবার চেম্বার খালি। সুবোধ বালকের মত কাছে এসে দূরত্ব বজায় রেখে মহিলা বাবার পাশে বসে পড়ি। তোমাকে তো এখানে আরেক দিন দেখে ছিলাম? না! আমি এখানে আজই এসেছি মা। আমার 'মা' শব্দ বলাতে মহিলা বাবা একটু নাখোশ নিয়ে বললো 'আমি মা নই, বা...বাবা আমি'। নারী কখনো বাবা হতে পারে নাকি!? পারে, পারে। সবি পারে। এ বলে ধ্যানে ডুব দেন। তারপর নতুন সুরে কথা পাড়লেন, তুমি অনেক বড় লোক হবা বলে আবার একটু ধ্যানে মগ্ন হয়ে বললেন, দেখি তোমার হাতটা। আমার হাত দেখে বলা শুরু করলেন পাগলামি কথাবার্তা। আমি এবার একটু কৌশলী হলাম। অভিনয় একটু আধটু পারি। শুরু করি অভিনয়। জিজ্ঞেস করি ক্যামতে কিভাবে বড় লোক হব? বাবা ধ্যানমগ্ন হলেন। তারপর বললেন, হুম, বড় লোক হতে পারবা। আগে বলো তুমি কী কর? ভার্সিটি পড়ি। আরবী পড়েছো? না। বাবা ধ্যান করলেন। তারপর তার ব্যাগ থেকে একটা ছবি বের করে আমার সামনে মেলে দিয়ে বললেন, এঁকে চেনো? জ্বে না। পড়ো, পড়ে দেখো তাতে কি নাম লেখা? হজরত আলী রাযি: লেখা। হু, ঠিকই ধরেছো। ইনিই শেরে খোদা হজরত আলী। হায়রে ভন্ডামি! তারপর আরবীতে মানুষের আকৃতিতে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ লেখার একটা ক্যালিগ্রাফি বের করে বললেন- ইনি কে জানো? জ্বে না। ইনি হজরত শাহ আলী বাবা। তারপর অনেক বাবার নাম এক দমে উল্লেখ করে বললেন আমার সাথে সব বাবার সাক্ষাত হয়। মানুষের বাসনা পূরণ করার জন্য বাবার কাছে যার নাম বলি তার বাসনা পূরণ হয়। দেও হাদিয়া দেও, তোমার জন্য (শাহ আলি) বাবার কাছে আরজি করি। এমন ঘটনাগুলো প্রতিনিয়তই ঘটে আমাদের এই বাংলাদেশর বিভিন্ন মাজারে।

[caption id="" align="alignnone" width="960"] চলছে নৃত্য[/caption]

গেল বৃহস্পতিবার রাজধানী ঢাকার মিরপুর এক নম্বরে অবস্থিত হজরত শাহ আলী রহঃ মাজারে এমনই ঘটনার সম্মুখীন হই। মাজারের দক্ষিণমুখী সুবিশাল গেট দিয়ে প্রবেশ করতেই দেখা গেল মাজারের খোলামেলা প্রশস্ত চত্বরজুড়ে মুরিদান নিয়ে নারী-পুরুষ অনেক বাবার অবস্থান। প্রত্যেকেই এসেছে নিজ নিজ অঞ্চলের (ছোটখাটো) মাজার থেকে। শাহ আলী বাবার শিস্য বলেই এরা নিজেদেরকে দাবি করে। বাবার সাথে তাদের সাক্ষাত ঘটে নাকি ধ্যানের জগতে। মানুষের নানান আরজি, বাসনা পূরণ করার শক্তি রাখে বলে দাবি করে এসমস্ত ছায়া বাবারা। ঘটনার প্রথমটি কালীগঞ্জ থেকে আসা পুরুষ বাবা ও দ্বিতীয়টি কাঁচপুর থেকে আসা মহিলা বাবার সাথে। পুরুষ বাবা ও মহিলা বাবা নিজদের পৈত্রিক সূত্র ধরেই নাকি পেয়েছে মাজারকেন্দ্রিক এমন ব্যবসা।

[caption id="" align="alignnone" width="960"] মহিলা বাবা[/caption]

প্রতিদিন নিজ নিজ অঞ্চলে ধোঁকা আর তামাশার এমন ব্যবসা করলেও সপ্তাহের একদিন হাজিরা দেন রাজধানীর মিরপুর শাহ আলী মাজারে। মাজার কমিটি থেকে তাদের টাকায় কেনা অনুমোদিত জায়গা নিয়ে এখানে প্রতারণার দোকান খোলে।

মহিলা বাবা থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে শাহ আলী মাজারের দিকে যাই। মাজারের গেটের সামনে দেখা গেল মোমবাতি বাবাকে। এ বাবার সামনে বড়সড় এক চ্যাপটা ভান্ডে নানান নারী-পুরুষ নিজ হাতে মোমবাতি জ্বালিয়ে বাবার হাতে টাকা গুজে দিয়ে বাসনা পূরণ করার আবেদন করে। বাবা সিগারেটে সুখ টান মেরে ধ্যানমগ্ন থাকেন। তার পাশেই বসা আগরবাতি বাবা। এ বাবার সামনে আগরবাতি জ্বালিয়ে রেখে যায় হাদিয়াসহ।

[caption id="" align="alignnone" width="960"] মোমবাতি বাবা[/caption]

মাজারের বিল্ডিং লাগোয়া রয়েছে এক বিশাল বড়সড় প্রাচীণ গাছ। গাছের গোড়ায় সাইনবোর্ডে লেখা শিরনি গাছ। স্থানীয় এক মাজারভক্ত জানায়, গাছের বয়স নাকি শাহ আলী বাবার বয়সী। সে যাই হোক, এ গাছকে নিয়ে চলছে চরম শিরকি কাজ। বিকৃত মানসিকতার লোকদের এ গাছের গোড়ায় সিজদাও করতে দেখা গেল।

মাজারে ঢুকে দেখা গেল আরো ভয়াবহ অবস্থা। মাজারের সিলিং ধরে কেউ কাঁদার ভান ধরে কেঁদে যাচ্ছে। চুমু খাচ্ছে। মোনাজাত ধরে বাবার কাছে নানান আরজি করছে। কেউ সরাসরি বাবার সিজদায় পড়ে আছে। মাজারের পাশের রুমগুলোর প্রত্যেকটায় মাজার বরাবর জানালা রয়েছে।
রুমগুলোতে শুধু মহিলারাই অবস্থান নেয়। কথা হয় গাজীপুর থেকে আসা জরিমন বিবির সাথে। এখানে কেন আসছেন? জানালো , সে তার এক মহিলা বাবার সাথে এসেছেন। প্রায় বৃহস্পতিবারেই নাকি তিনি আসেন। কেন আসেন? জিজ্ঞেস করলে জানায় বাবার ফয়েজ নিতে। তিনি তো মৃত? মৃত থেকে কোনো উপকার হাসিল করা যায় না জানালে সে জানায়, তার বাবা জানে সব।

[caption id="" align="alignnone" width="960"] নারী-পুরুষের যৌথ ধ্যান[/caption]

মাজার থেকে বেরিয়ে চত্বর পেরিয়ে অপর বিল্ডিংয়ে যাই। সেখানে দেখা গেল এক যুবতী গান গেয়ে গেয়ে নাচছে। আর উপভোগ করছে উপস্থিত শত দর্শক। মাজারের চত্বরে আবার এসে দেখি কোণায় কোণায় জমে ওঠেছে অবস্থান নেয়া বাবাদের মজমা। চলছে গান। গানে গানে ছড়াচ্ছে শিরকি কথাবার্তা। এক নর্তকী সুরে সুরে বলছে-

পানিত্তলে মোম বাতি
বাওবাতাসে নিভে না
বাবার নামে হালকা দিলে
অজু গোসল লাগে না!

মোল্লা মুনশি নমাজ পড়ে
মারেফত ত জানে না
বাবার নামে হালকা দিলে
সতর ঢাকন লাগে না!'

সবাই তার সাথে
সাথে হুহ হুহ! করছে।

মাজার প্রাঙ্গণের সর্বত্র মজমায় মজমায় চলছে বাজনাসহ এসব উদ্ভট গানের সাথে জিকির। নারী-পুরুষের অবাধ মিলনে এসব হালকায় যখন চরম অবস্থা বিরাজ করে, তখন নারীদের গায়ের কাপড় খুলে যেতে থাকে! এমন সময় কোনো কোনো নারী সুর করে বলে,

আইছি নেংটা, যাইবো নেংটা
কাপড় দিয়া করি কী?
গানের সুরে কখনো শুনা যায়-
আল্লাহর ধন নবীরে দিয়া
আল্লাহ গেছেন খালি হইয়া
নবীর ধন বাবারে দিয়া
নবী গেছেন খালি হইয়া!

আরেক কর্ণারে এসে দেখি এক উলঙ্গ বাবা। তাকে ঘিরে উৎসুক দর্শক। একজনকে দেখলাম বাবার উলঙ্গ রানে মাথা ঝুঁকিয়ে সেজদা করছে। ভদ্রগোছের এক ব্যক্তির মুখ থেকে বেরুলো 'নাউযুবিল্লাহ’।

শাহ আলি মাজারে অনেক লোকই আসে আমার মত এসব তামাশা দেখতে। নাউযুবিল্লাহ বেরিয়ে আসা লোকটি সেরকমই একজন। কথা বলে জানা গেল তিনি সেখানকার স্থানীয়। মাজারের চত্বর পেরিয়ে পশ্চিম পাশে গিয়ে দেখা গেল জটবাঁধা মুরিদানসহ অনেক বাবা। প্রত্যেকর হাতে সিগারেট। বাবার সুখটান দেয়ার সাথে সাথে মুরিদরাও সুখটান দেয়। আরেকটু ভেতরে গিয়ে দেখা গেল অন্ধকারে নারী-পুরুষের বিশ্রিকর অবস্থান। মাজারের পশ্চিম দিকে রয়েছে পাকঘর। সেখানে বিশাল খাঞ্জি ভর্তি দেশি মুরগি চোলা হচ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম এগুলো কোত্থেকে আসে? বাবার কেরামতি বলে জানায় এক খাদেম। পাকঘরের পশ্চিমে রয়েছে পুকুর। পুকুর পাড়ে চলছে গাঁজার আসর। বৃহস্পতিবার রাতের ১০টা থেকে রাত দুইটা পর্যন্ত অবলোকন করি মাজার ও তার আশপাশের এসব নানান বিব্রতকর চিত্র। রাত যত বাড়ে মাতলামি তত বাড়ে। এ মাতলামি চলতে থাকে নাকি ফজর পর্যন্ত।

কিন্তু এর শেষ কোথায়? জানতে চাওয়া হয় মাজারে দায়িত্ব পালনরত এক পুলিশের কাছে। (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) তিনি বলেন, 'এর কোনো শেষ নেই। প্রত্যেকটা মাজারের সাথে জড়িয়ে আছে এলাকার প্রভাবশালী, বিভিন্ন শ্রেণির নেতা। মাজারের টাকার বৃহৎ অংশ যায় তাদের পকেটে। বাকিগুলো খায় মাজার কমিটি ও অন্যান্যরা।

[caption id="" align="alignnone" width="960"] কবরে ফুলের স্তুপ[/caption]

মাজারের সাথে যেহেতু জড়িয়ে আছে অনেকের অর্থনৈতিক সম্পর্ক, তাই শেষ থাকার কোনো 'প্রশ্নই' আসতে পারে না'।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, হজরত শাহ আলী রহঃ ফোরাত তীরের বোগদাদ হতে এই উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারের জন্য আসেন। তাঁর পীরের নির্দেশে তিনি ঢাকার মিরপুরকে ইসলাম প্রচারের ঘাটি হিসেবে বেছে নেন। বর্তমান মাজারস্থলে একটি জরাজীর্ণ মসজিদ ছিল। তিনি মসজিদটিকে আবাদ করেন। এখানেই তিনি ইবাদাত করেন আর নৌকাযোগে ইসলাম প্রচারে বের হন। ঘটনাচক্রে তিনি ১৫৭৭ সালে ইন্তেকাল করলে এখানেই তাতে সামধি করা হয়। পরর্তীতে স্বার্থান্বেষী, অর্থলোভী এক শ্রেণির মানুষরা বাংলাদেশের অন্যান্য ওলী-বুযুর্গদের কবরের ন্যায় এ কবরেও মাজার গড়ে তোলে ব্যবসার ধান্ধা শুরু করে।

মাজারের চরম শিরকি কাজ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয় রাজধানী ঢাকার বায়তুল মা'মুর মাদরাসা কমপ্লেক্স মিরপুর-১১ এর শিক্ষক মুফতি আকীদুল ইসলাম এর কাছে। তিনি বলেন, 'ইসলামে মাজারের কোনো অবস্থান নেই। মাজারকে যদি সেজদা কুফুরি না হত কিংবা জায়েয হত তাহলে সর্বাগ্রে সকল নবীর নবী বিশ্বনবী সৃষ্টিকূল সম্রাট হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের কবরে সেজদার হিড়িক পড়তো। মাজারে টাকা দেয়া যদি জায়েয হত, তাহলে বিশ্বনবী সা. সহ সকল নবী, সাহাবাদের কবরগুলোতে টাকার পাহাড় গড়ে ওঠতো।

তিনি বলেন, বাংলাদেশর সরকার একজন মুসলিম। মুসলিম হিসেবে, আল্লাহর একত্বববাদে বিশ্বাসী হিসেবে সরকারের করণীয় হচ্ছে সকল ওলী-বুযুর্গদের কবরকে শিরিকমুক্ত, মাজারমুক্ত রাখা'।

আরআর


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ