সালমান তারেক শাকিল: ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে সমর ও সাংস্কৃতিক অঙ্গণে কাজ করেছেন অনেক আলেম। জামায়াতে ইসলাম আর নেজামে ইসলাম পার্টি পাকিস্তানি সরকারের পক্ষে কাজ করলেও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও দারুল উলুম দেওবন্দের অনুসারী অনেক আলেমই মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে ছিলেন। এদের মধ্যে জামিয়া হোসাইনিয়া আরজাবাদ মাদরাসার প্রিন্সিপাল আল্লামা মোস্তফা আজাদ, মাওলানা উবায়দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী, মাওলানা আবদুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী, মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসঊদ, হাফেজ ক্বারী ইউসূফ অন্যতম। বর্তমানে তাদের কেউ কেউ গুরুতর অসুস্থ, কেউ বা প্রবাসী।
জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সহ-সভাপতি মাওলানা মোস্তফা আজাদ মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি সশস্ত্রযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। তার বাবা ছিলেন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের অবসরপ্রাপ্ত সুবেদার মেজর। স্থানীয় যুবক, ছাত্রদের নিয়ে পাকিস্তানিদের প্রতিহত করতে গ্রামের মাঠে ট্রেনিং দিয়েছেন তিনি। গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী থানাধীন ধলগ্রাম ইউনিয়নের সাধুহাটি গ্রামের মাঠে ট্রেনিং সেন্টার খুলেছিলেন মোস্তফা আজাদের বাবা। মুক্তিযুদ্ধে তার যুদ্ধের এলাকা ছিল মেজর অব. জলিলের নেতৃত্বাধীন ৯ নং সেক্টর (বৃহত্তর খুলনা ও বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চল)।
মোস্তফা আজাদের ছেলে আরজাবাদ লালকুঠি বায়তুল ফালাহ জামে মসজিদ মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা জুলকারনাইন বিন আজাদ বাবার বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলেন, ‘একাত্তরে তিনি লালবাগ মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন। ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণও শুনেছিলেন। তিনি ও লালবাগ মাদ্রাসার কিছু শিক্ষার্থী রেসকোর্স ময়দানের সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন। বিভিন্ন জায়গায় হত্যা চলছিল, জুলুম নির্যান চলছিল। আমার আব্বা মাওলানা মোস্তফা আজাদ ২৫ মার্চ রাতেই গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেছিলেন।’
মোস্তফা আজাদ এখন ভীষণ অসুস্থ। বর্তমানে তিনি ভারতের চেন্নাইয়ে একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। মাওলানা জুলকারনাইন বলেন, ‘আব্বার দুটি কিডনিই ড্যামেজ হয়ে গেছে। বাংলাদেশের চিকিৎসকরা তাকে ভারতের নেওয়ার পরামর্শ দিলে তাকে সেখানেই নেওয়া হয়। তবে অনেক বেশি অর্থের কারণে ডায়ালাইসিস করা সম্ভব হয়নি। আব্বার সঙ্গে চেন্নাইতে আমার আম্মা, খালাত ভাই ও চাচা আছেন।’
আলেম মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে প্রথম কাজ করেন আলেম-সাংবাদিক মাওলানা শাকের হোসাইন শিবলী। তার ‘একাত্তরের চেপে রাখা ইতিহাস: আলেম মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে’ শীর্ষক গ্রন্থে উল্লেখ করেন, মাওলানা মোস্তফা আজাদ রাগে-ক্ষোভে মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট ছিঁড়ে ফেলেছেন। গ্রন্থে মোস্তফা আজাদ বলেন, ‘আমি একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। ৭১-এর নয় মাস পাকসেনাদের বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছি বহুবার। এটা আমার গর্ব। আমার অহঙ্কার। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ওসমানীর সার্টিফিকেট ছিল আমার কাছে। সেই প্রমাণপত্র আমি ছিঁড়ে ফেলেছি এ অফিসকক্ষে। টুকরো টুকরো করে ছিঁড়েছি। কখন ছিঁড়েছি? যখন দেশের হালচাল পাল্টে গেছে। অযোগ্যরা ক্ষমতার মসনদে বসতে শুরু করেছে। রাজাকাররা রাষ্ট্রীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের পদক নিচ্ছে।’
মাওলানা মোস্তফা আজাদ একসময় রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও বর্তমানে বেশি সক্রিয় তার পরিচালনাধীন আরজাবাদ মাদ্রাসা নিয়েই। ঢাকার অন্যতম বড় এই মাদ্রাসাটি তিনি প্রায় ৩৫ বছর ধরে পরিচালনা করছেন।
আলেম মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গবেষণায় নিয়োজিত মাওলানা শাকের হোসাইন শিবলী বলেন, ‘একাত্তরে ইসলামী দল ছিল তিনটি- জামায়াতে ইসলামী, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও নেজামে ইসলাম পার্টি। জামায়াতে ইসলামী ও নেজামে ইসলাম পার্টি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে। তবে একাত্তরে জামায়াতে ইসলামী মাঠে-ময়দানে যতটা সক্রিয় ছিল নেজামে ইসলামী ততটা নয়। সাংগঠনিকভাবে জামায়াতের চেয়ে নেজামে ইসলাম অনেক দুর্বল ছিল। ঢাকা ও চট্টগ্রামের হাতেগোনা চার-পাঁচটি শহরেই কেবল এর কার্যক্রম সীমাবদ্ধ ছিল। জমিয়ত ছিল স্বাধীনতার পক্ষে। তবে দলটির তৎকালীন পদত্যাগী সভাপতি পীর মুহসিন উদ্দিন দুদু মিয়া ছিলেন পশ্চিমাদের সহযোগী।’
একাত্তরে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে কাজ করেছেন মাওলানা আবদুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদি ও তার ছোটভাই মাওলানা উবায়দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী। ছোটভাই উবায়দুল্লাহ মুক্তিযুদ্ধের সাময়িক সার্টিফিকেট পেলেও মাওলানা আবদুল্লাহ কোনও সার্টিফিকেট গ্রহণ করেননি। ছোটভাইয়ের ওপরে আবদুল্লাহর বেশ অভিমান। কিছুটা রসিকতার সুরে তিনি বলেন, ‘উবায়দুল্লাহ নিজের সার্টিফিকেট সংগ্রহ করেছে। বড় ভাইয়ের কথা ভুলে গিয়ে..হাহাহা।’
আবদুল্লাহ সাঈদ জানান, বর্তমানে তিনি মিরপুরে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন। এছাড়া ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কাজ করছেন নানা প্রকল্পে। এর মধ্যে বিশ্বকোষ, তাফসীরগ্রন্থ আছে।
মুক্তিযুদ্ধে সাংস্কৃতিক ফ্রন্টে কাজ করার কথা উল্লেখ করে আবদুল্লাহ সাঈদ বলেন, ‘আমরা কাজ করেছি সাংস্কৃতিক ফ্রন্টে। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই ভারতে যাই। সেখান থেকে ফিরে বাংলাদেশের আলেমদের স্বাধীনতার পক্ষে একত্রিত করার চেষ্টা করি।’
কিছুটা ক্ষোভ প্রকাশ করেন এই আলেম মুক্তিযোদ্ধার ছেলে মারুফ বিন আব্দুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘আব্বার ডায়াবেটিস আছে। চোখের অবস্থাও বেশি ভালো না। তবে তার খোঁজখবর নিতে কেউ-ই আসেন না। এখন তো আবার লেখালেখির কারণে আওয়ামী লীগের লোকেরা তার উপর অসন্তুষ্ট। লেখালেখির কারণে তাকে অপছন্দ করে। চাচা মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট পাইছেন। আব্বার এখানে সমস্যা আছে।’ তবে এ নিয়ে আবদুল্লাহ সাঈদ কোনও মন্তব্য করতে নারাজ।
আবদুল্লাহ সাঈদের ছোটভাই মাওলানা উবায়দুল্লাহ সাঈদ। তিনি শব্দসৈনিক ছিলেন। তার সঙ্গে অনেক চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। বড় ভাই আবদুল্লাহ সাঈদ জালালাবাদী জানান, উবায়দুল্লাহ জালালাবাদি শ্যামলীতে নিজের বাড়িতে থাকেন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি আতাউল গণি ওসমানীকে সঙ্গ দিয়েছেন ঘনিষ্ঠভাবে।
মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগামী আলেম-মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম হাফেজ ক্বারী ইউসূফ এখন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। তার ছেলে ক্বারী আহমাদ বিন ইউসূফকে অনেকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। একাধিক আলেম জানান, ক্বারী ইউসূফ আজিমপুর ছাপড়া মসজিদ এলাকায় বসবাস করতেন। বেশ কিছু বছর ধরেই তিনি আমেরিকায় বসবাস করছেন।
মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ করেছেন মালিবাগ জামিয়া শরইয়্যাহ মাদ্রাসার প্রয়াত মহাপরিচালক মাওলানা কাজী মু’তাসিম বিল্লাহ। এছাড়া সারা দেশের অনেকে আলেমই মুক্তিযুদ্ধে নানাভাবে যুক্ত ছিলেন।
সরাসরি যুদ্ধ না করলেও স্বাধীনতার স্বপক্ষে যাদের ভূমিকা অগ্রগণ্য ছিল তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য শোলাকিয়া ঈদগাহের খতিব মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসঊদ। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘যুদ্ধের সময় আমি কিশোরগঞ্জের জামিয়া ইমদাদিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম। কোনও সশস্ত্রযুদ্ধে অংশ নিইনি। তবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে কাজ করেছি। পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছি। সাংগঠনিক কিছু কাজও করেছি। যুদ্ধের সময় আমি কিশোরগঞ্জের তাড়াইলে ছিলাম।’
-বাংলা ট্রিবিউন
এআর