আওয়ার ইসলাম: গাজীপুর ও টাঙ্গাইলে তিনটি জঙ্গি আস্তানায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে সন্দেহভাজন ১১ জঙ্গি নিহত হয়েছে। শনিবার ভোর থেকে পরিচালিত অভিযানে গাজীপুর সদরের লেবুবাগানে দুজন, পাতারটেকে সাতজন এবং টাঙ্গাইল সদরের কাগমারা এলাকায় দুজন নিহত হয়। তাদের মধ্যে নিউ জেএমবির সমন্বয়ক জঙ্গি আকাশও রয়েছেন বলে পুলিশ জানিয়েছে। -ঢাকাটাইমস
জঙ্গিবিরোধী অভিযানে এক দিনে এতজন নিহত হয়নি এর আগে। গত ২৬ জুলাই কল্যাণপুরে ‘জাহাজ বিল্ডিং’ নামের বাড়ির একটি ফ্ল্যাটে পুলিশের অভিযানে মারা যায় নয়জন।
গাজীপুরের লেবুবাগানে পরিচালিত অভিযানের ব্যাপারে র্যাবের গণমাধ্যম শাখার মুখপাত্র মুফতি মাহমুদ খান জানান, কয়েকজন জঙ্গি বাড়িটিতে অবস্থান করছে এমন তথ্যের ভিত্তিতে ভোরে বাড়িটি ঘিরে ফেলে র্যাব ও পুলিশ। পরে সকাল আটটার দিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি দল বাড়িটিতে অভিযান শুরু করে। দরজা ভেঙে একটি কক্ষে ঢোকার চেষ্টা করলে জঙ্গিরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। র্যাব ও পুলিশও পাল্টা গুলি চালায়। এতে দুই জঙ্গি ঘটনাস্থলেই মারা যায়।
নিহত দুজন হলেন, রাশেদ মিয়া ও তৌহিদুল ইসলাম। তাদের বাড়ি নরসিংদীতে। রাশেদ এইচএসসি পরীক্ষায় পাস করার পর ঢাকায় আসেন। আর তৌহিদুল ডুয়েটের ছাত্র।
অভিযানের পর ঘটনাস্থল থেকে একে-টোয়েন্টি টোয়েন্টি বোরের একটি রাইফেল, তিনটি চাপাতি, বিপুল পরিমাণ গুলি, বোমা তৈরির সরঞ্জাম, ল্যাপটপ উদ্ধার করা হয় বলে র্যাবের এই কর্মকর্তা জানান।
স্থানীয় লোকজন জানান, একতলা ওই বাড়ির মালিকের নাম আতাউর রহমান। তিনি সপরিবারে ঢাকায় থাকেন। মাস দুয়েক আগে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর বাড়িটিতে তিনটি পরিবারকে ভাড়া দেন তিনি।
টাঙ্গাইলের অভিযানের ব্যাপারে র্যাব-১২ এর কমান্ডার মহিউদ্দিন ফারুকী জানান, সকাল সাড়ে ১০টার দিকে টাঙ্গাইল পৌর এলাকার কাগমারা গ্রামে তিনতলা একটি বাসায় জঙ্গি আস্তানার খবর পেয়ে অভিযান চালায় র্যাব। এ সময় র্যাবের গুলিতে দুই জঙ্গি নিহত হয়।
স্থানীয় লোকজনের বরাত দিয়ে র্যাবের এই কর্মকর্তা জানান, কয়েক মাস আগে এই বাসায় ভাড়া নেয় তিন যুবক। তাদের বাড়ি বগুড়ায় বলে স্থানীয়রা জানায়। তারা জঙ্গি কর্মকাণ্ডে জড়িত এমন তথ্যের ভিত্তিতে বাড়িটিতে অভিযান চালানোর সময় দুজন নিহত হয়। তারা কোন জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত র্যাবের এই কর্মকর্তা তা জানাননি।
শনিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে র্যাবের সদস্যরা সদর উপজেলার কাগমারায় আজাহার উদ্দিনের বাড়িতে অভিযান চালায়। এ সময় ‘আল্লাহ আকবার’ ধ্বনি দিয়ে জঙ্গিরা গুলি ছোড়ে র্যাবের দিকে। র্যাবও পাল্টা গুলি চালালে দুই জঙ্গি নিহত হয়। এ সময় র্যাবের দুই সদস্যও আহত হন বলে দাবি করেছেন র্যাব ১২-এর কমান্ডার ও এডিশনাল ডিআইজি শাহাবুদ্দিন খান।
সকাল ১০টায় শুরু হওয়া অভিযান শেষ হয় বেলা তিনটার দিকে। প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টার এ অভিযানের বিষয়ে বিকেল চারটার দিকে টাঙ্গাইল প্রেসক্লাবে ব্রিফিং করে র্যাব। এ সময় র্যাব-১২-এর কমান্ডার ও এডিশনাল ডিআইজি শাহাবুদ্দিন খান জানান, ওই ভবনের কক্ষ থেকে একটি পিস্তল, একটি রিভলবার, ১০টি চাপাতি, পাঁচ রাউন্ড গুলি, দুটি ল্যাপটপ ও নগদ ৬৪ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়।
শহরের পৌর এলাকা কাগমারায় মির্জাবাড়ি মাঠের কাছে তিনতলা ওই ভবনে র্যাবের অভিযানের পর বাড়িটি ঘিরে রাখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।
র্যাব জানান, পরে ঢাকা থেকে বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দল আসার পর ওই ভবনে ঢোকেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। তবে নিহত জঙ্গিদের পরিচয় এখনো কেউ নিশ্চত করতে পারেনি।
এদিকে গাজীপুর মহানগরীর হাড়িনাল ও নোয়াগাঁও এলাকায় দুটি জঙ্গি আস্তানায় র্যাব, কাউন্টার টেররিজম ইউনিট, সোয়াত, ডিবি ও জেলা পুলিশের অভিযানে জেএমবির ঢাকা অঞ্চলের সমন্বয়ক আকাশসহ নয়জন নিহত হয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে আগ্নেয়াস্ত্র, ধারালো অস্ত্র, গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়েছে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল জানান, জঙ্গিবিরোধী সফল অভিযান পরিচালনা করেছে আইনর্শঙ্খলা রক্ষাকারী বাজিনী। এ জন্য তিনি তাদের ধন্যবাদ জানান।
শনিবার হাড়িনালে র্যাবের ওই অভিযান চলার সময় এর দেড় কিলোমিটারের মধ্যে নোয়াগাঁওয়ের আফারখোলা পাতারটেক এলাকায় আরেকটি আস্তানায় অভিযান পরিচালনা করে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট, সোয়াত ও জেলা পুলিশ।
গোপন সংবাদে জঙ্গি আস্তানার খবর পেয়ে সকাল ১০টার দিকে নগরের জয়দেবপুর থানার নোয়াগাঁও পাতার টেক এলাকার একটি দোতালা বাসা ঘিরে ফেলে গাজীপুর পুলিশ।
এর আগে ভোর ছয়টার দিকে হাড়িনাল পশ্চিমপাড়া লেবুবাগান এলাকায় আতাউর রহমানের একতলা বাড়িতে অভিযান শুরু করে র্যাব। সেখানে দুই জঙ্গি নিহত হওয়ার খবর নিশ্চিত করেন র্যাবের মুখপাত্র মুফতি মাহমুদ খান।
শনিবার দুপুর ১টা ৪৫মিনিটে মুফতি মাহমুদ খান সাংবাদিকদের জানান, কিছুদিন আগে দুজন জেএমবি দম্পতি আটক হয়েছিল। র্যাব তাদের কাছ থেকে জানতে পারে গাজীপুরে ও এর আশপাশের এলাকায় বেশ কয়েকটি জেএমবি গ্রুপ সক্রিয়। তারা নাশকতা করার পরিকল্পনা করছিল এবং তাদের নাশকতা করার সামর্থ্যও ছিল। আটক দম্পতির কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে ভিত্তিতে আমরা গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াই।
মুফতি মাহমুদ বলেন, আতাউর রহমানের ভাড়া বাড়িতে যে কক্ষে জঙ্গিরা থাকত, সেই কক্ষের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। র্যাব সদস্যরা তাদের দরজা খুলতে বললে জঙ্গিরা গুলি চালায়। এ সময় র্যাবও পাল্টা গুলি চালায়। ঘটনাস্থল থেকে একটি একে-২২রাইফেল, একটি পিস্তল, একটি ল্যাপটপ ও বিভিন্ন ধরনের সামগ্রী উদ্ধার করা হয়।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বাড়ির মালিক র্যাবকে জানিয়েছেন, নিহত দুই জঙ্গি রাশেদ মিয়া এবং তৌহিদুল বাড়ির মালিককে তথ্য দিয়েছিল যে, রাশেদ মিয়া এসএসসি পাস করে ভর্তির চেষ্টা করছে এবং তৌহিদুল ডুয়েটে অবস্থান করছে।
অভিযানে এক জঙ্গির জাতীয় পরিচয়পত্র উদ্ধার করা হয়েছে এবং সেই পরিচয়পত্র থেকে একজনের পরিচয় প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত করা গেছে।
পরে বিকাল ৪টার দিকে মরদেহগুলো উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠান র্যাবের সদস্যরা।
এদিকে, র্যাবের অভিযানের পর বেলা ১০টার দিকে নোয়াগাঁওয়ের আফারখোলা পাতারটেক এলাকার একটি দোতলা বাড়িতে অভিযান শুরু করে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ, পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট, যার সঙ্গে ছিল সোয়াত। ঘটনাস্থলে ছুটে যান গাজীপুর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ, ডিবি (ডিসি) মনিরুল ইসলামসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
বিকাল চারটার দিকে অভিযান শেষে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার ছানোয়ার হোসেন সেখানে সাতজনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেন। নিহত অপর সদস্যদের পরিচয় জানা যায়নি। তাদের বয়স ১৭ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে বলে জানান ছানোয়ার। ঘটনাস্থলে থেকে তিনটি আগ্নেয়াস্ত্র এবং দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করা হয়।
র্যাব ও পুলিশের দুই অভিযানের খবরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালও গাজীপুরে যান। পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মোখলেসুর রহমান ও জাবেদ পাটোয়ারী এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, এখানে যারা ছিল, সবাই জঙ্গি গ্রুপের সঙ্গে জড়িত। তাদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়ার পর তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। এ সময় পুলিশ পাল্টা গুলি ছুড়লে ঘটনাস্থলে আকাশসহ সাতজন মারা যান। ঘটনাস্থল থেকে আগ্নেয়াস্ত্র, চাপাতি এবং গুলি উদ্ধার করা হয়েছে।
আনসারুল্লা বাংলা টিমের প্রধান বরখাস্ত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হকের কোনো সন্ধান পাওয়া গেছে কি না- জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘মেজর জিয়া বা লেফটেন্যান্ট জিয়া আমাদের কাছে ফ্যাক্টর না। কেউ পার পাবে না। আমরা সব ধরনের প্রচেষ্টা নিচ্ছি।’
যে বাড়িতে পুলিশের অভিযান চলে, তার মালিক সৌদি প্রবাসী সোলেমান সরকার। তার ভাই কালীগঞ্জ উপজেলার জাঙ্গালিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার আরবি শিক্ষক ওসমান গণি বাড়িটি দেখাশোনা করেন।
তিন মাস আগে তার কাছ থেকে তিন যুবক বাড়ির দোতলা ভাড়া নেন। ওই তিনজন জঙ্গি বলে ধারণা পুলিশের।
দুটি স্থানে অভিযান ও গোলাগুলির ঘটনায় এলাকায় দেখা দেয় উদ্বেগ ও আতঙ্ক। গাজীপুরবাসীর মুখে মুখে সারা দিনের আলোচনার বিষয় র্যাব ও পুলিশের জঙ্গি নির্মূল অভিযান। অনেক এলাকাবাসী এ ধরনের অভিযানকে স্বাগত জানিয়ে বলছেন, কোনো ধরনের সন্ত্রাস ও নাশকতা শান্তিপ্রিয় মানুষ হিসেবে তারা পছন্দ করেন না। অনেক স্থানীয় অধিবাসী ভিড় জমায় ঘটনাস্থলে, তাদের দিনভর উৎসুক দৃষ্টি ছিল অভিযানকে ঘিরে।
গুলশান ও শোলাকিয়ায় হামলার পর গত দুই মাসে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের কয়েকটি জঙ্গি আস্তানায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে জঙ্গি নেতা তামিম চৌধুরী, মেজর জাহিদসহ বেশ কয়েকজন জঙ্গি নিহত হয়।
আরআর