|| মাওলানা হেমায়েত উদ্দীন ||
'আকাবির' অর্থ বড় তথা মহান ব্যক্তিবর্গ। আর 'আসলাফ' অর্থ পূর্বসূরীগণ। একসঙ্গে আকাবির আসলাফ বলা হলে অর্থ হয় মহান পূর্বসূরীগণ।
শাব্দিক অর্থে শব্দদুটো সব ধরনের পূর্বসূরীদের অন্তর্ভুক্ত করলেও দ্বীনি ইলম ও আমলের ক্ষেত্রে অনুসরণ প্রসঙ্গে শব্দদুটোর উল্লেখ হলে দ্বীনি লাইনের হকপন্থী মহান পূর্বসূরীদেরই বোঝানো হয়ে থাকে। বয়সে নয় বরং ইলমে বড়দেরই বোঝানো হয়। আকাবির আসলাফ শব্দদুটোর মর্মকে এক শব্দে রিজালুল্লাহ দ্বারাও ব্যক্ত করা হয়ে থাকে। 'রিজালুল্লাহ'-এর শাব্দিক অর্থ হল আল্লাহর ব্যক্তিবর্গ অর্থাৎ, আল্লাহর দ্বীনের (বিশিষ্ট) ব্যক্তিবর্গ তথা ধর্মীয় মনীষীগণ- আম্বিয়া, সাহাবা, উলামা ও সুলাহা।
ইদানিং সোস্যাল মিডিয়ায় কিছু লোককে দেখা যাচ্ছে তারা আকাবির আসলাফের অনুসরণের প্রয়োজন অস্বীকার করছে। তারা এটাকে আকাবির পূজা বলে ট্রল করছে। অথচ আকাবির আসলাফের অনুসরণের প্রয়োজন কুরআন হাদিস দ্বারাই প্রমাণিত। কুরআন হাদিস বোঝার ক্ষেত্রে হেদায়েতের উপর টিকে থাকা এবং গোমরাহি থেকে বেঁচে থাকার জন্যই আকাবির আসলাফের অনুসরণ প্রয়োজনীয়। দ্বীনের অর্জিত জ্ঞান যে সহিহ তার নিশ্চয়তা লাভের জন্যই আকাবির আসলাফের অনুসরণ প্রয়োজনীয়।
কিতাবুল্লাহ তথা আল্লাহর কিতাব (তদ্রূপ তার ব্যাখ্যা হাদিস) বুঝতে হয় রিজালুল্লাহ তথা আকাবির আসলাফ থেকে অর্থাৎ যেভাবে রিজালুল্লাহ বুঝেছেন সেভাবে বুঝতে হয়। রিজালুল্লাহ তথা আকাবির আসলাফ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কুরআন হাদিস বুঝতে চাইলে হেদায়েত নয় বরং গোমরাহি আসতে পারে। এজন্যই সূরা ফাতেহায় হেদায়েতের দোয়া এভাবে করতে শিক্ষা দেয়া হয়েছে- "হে আল্লাহ! আমাদেরকে সেসব লোকের পথে চালাও যাদেরকে তুমি ইনআম দিয়েছ।" (এই ইনআমপ্রাপ্ত লোকরাই হলেন রিজালুল্লাহ তথা আকাবির আসলাফ। )। তাদের পথে চালাও অর্থাৎ তারা যেভাবে কুরআন হাদিস বুঝে চলেছেন সেভাবেই কুরআন হাদিস বুঝে চলার তাওফিক দাও। এই হল কিতাবুল্লাহ বোঝা রিজালুল্লাহ-এর আলোকে।
কুরআন হাদিস নিজে নিজে নয় উস্তাদের মাধ্যমে শিখতে হয়। আকাবির আসলাফ হলেন আমাদের উস্তাদ, উস্তাদদের উস্তাদ। কুরআন হাদিস বুঝার ধারা ও ধরন আকাবির আসলাফ থেকে আয়ত্ব করে সে মোতাবেক কুরআন হাদিসের সবকিছু বুঝতে হয়। একান্তই ফ্রি স্টাইলে বা নিজের মত করে কুরআন হাদিস বুঝতে গেলে বিভ্রান্তি আসতে পারে। যেমনটা দেখা গেছে অতীতের বহু মেধাবী লোকের ক্ষেত্রেও। এখনও দেখা যাচ্ছে না তা নয়। এজন্যই রাসূল সা. বলেছেন,
إنما العلم بالتعلم. (قال الحافظ في الفتح : أورده ابن أبي عاصم والطبراني من حديث معاوية وإسناده حسن. وأورده البخاري في صحيحه في كتاب العلم بلا إسناد.)
অর্থাৎ, ছাত্র হয়ে ইলম অর্জন করলে সেটাই ইলম। (ইবনে আবী আসিম, তাবারানী ও বোখারী) হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি রহ. ফাতহুল বারীতে বলেছেন, "ছাত্র হয়ে ইলম অর্জন করলে সেটাই ইলম।"-এর অর্থ হচ্ছে-
ليس العلم المعتبر إلا المأخوذ من الأنبياء وورثتهم على سبيل التعلم.
অর্থাৎ, কেবল সেই ইলম গ্রহণযোগ্য যা আম্বিয়ায়ে কেরাম ও তাদের উত্তরসূরীদের থেকে (অর্থাৎ উলামায়ে কেরাম থেকে, আকাবির আসলাফ থেকে) ছাত্র হয়ে অর্জন করা হয়।
অন্য এক রেওয়ায়েতে এসেছে- হযরত ইবনে মাসঊদ রা. বলেন,
لا يزالُ الناسُ بخيرٍ ما أخَذواالعِلْمَ عن أكابِرِهِمْ
অর্থাৎ, মানুষ যতক্ষণ তাদের আকাবির থেকে ইলম্ অর্জন করবে ততক্ষণ তারা কল্যাণের মাঝে থাকবে। (আস-সিলসিলাতুস সহীহাহ: ২/৩১০। সনদ সহীহ।)
তবে হ্যাঁ, একথাও উল্লেখ্য যে, আকাবির আসলাফকে অনুসরণ করার অর্থ আদৌ এ নয় যে, তাদের কেউ ভ্রান্ত হলেও বা ভুল করলেও তার অনুসরণ করতে হবে। তেমনটা করা হলে সেটা হবে আকাবির আসলাফের অনুসরণে ইফরাত তথা বাড়াবাড়ি। সেটা পরিত্যাজ্য। তদ্রূপ সমূলেই আকাবির আসলাফের অনুসরণকে বর্জন করা হচ্ছে তাফরিত তথা ছাড়াছাড়ি। সেটাও পরিত্যাজ্য। বস্তুত আকাবির আসলাফের অনুসরণের ক্ষেত্রে ইফরাত তাফরিত নয়, বাড়াবাড়ি ছাড়াছাড়ি নয়, বরং ভারসাম্য রক্ষা করে চলাই আহলে হকের আদর্শ। এই ভারসাম্যের সঙ্গে আকাবির আসলাফের অনুসরণকে যারা আকাবির পূজা আখ্যায়িত করছে, তারা মূলত কুরআন হাদিসের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে আকাবির আসলাফ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বেচ্ছাচারিতা চালিয়ে যাওয়ার পথকে নিষ্কণ্টক করতে চাইছে। কিংবা যারা এরূপ স্বেচ্ছাচারিতা চালিয়েছে তাদেরকে রক্ষা করতে চাইছে। হ্যাঁ, পূর্বসূরীরা ভুল মত পথে থাকা সত্ত্বেও তাদের অনুসরণের দোহাই দিয়ে যারা বিদআত কুসংস্কার ও ভ্রান্তি চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের সেই অনুসরণের বিরুদ্ধে বলুন। সেরূপ অনুসরণকে আকাবির পূজা বা পূর্বসূরীদের পূজা বললে বলতেও পারেন। কিন্তু ভারসাম্যের সাথে যারা পূর্বসূরী আহলে হকের অনুসরণ করছেন তাদের অনুসরণকে আকাবির পূজা বলে সমূলে আকাবির আসলাফের অনুসরণকে ট্রল করলে সেটা হবে কুরআন হাদিসকেই ট্রল করা, কুরআন হাদিসের বিরুদ্ধে বলা।
এনএ/