|| মুহিউস সুন্নাহ আল্লামা মাহমূদুল হাসান ||
হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ পাকের তরফ হতে সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ এবং সর্বশেষ নবী। আসমানি কিতাবসমূহের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বজনীন কিতাব রাসূলে কারিমের ওপর অবতীর্ণ হয়। তাঁর উম্মতকে বলা হয় উম্মতে মুহাম্মাদী। এই উম্মতে মুহাম্মাদী দুই প্রকার। প্রথম প্রকার হচ্ছে উম্মতে ইজাবা অর্থাৎ যারা তাঁর নবী ও রাসূল হওয়াকে মনেপ্রাণে ও কাজেকর্মে মেনে নিয়েছে। দ্বিতীয় প্রকার হচ্ছে উম্মতে দাওয়া বা যারা তাঁর রাসূল ও নবী হওয়াকে মেনে নেয়নি।
যারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নবী-রাসূল হিসেবে মেনে নিয়েছেন, তাদেরকে তাঁর ওপর অবতীর্ণ আল্লাহপ্রদত্ত বিধিবিধান অনুসরণ করতে হয়। এরই নাম ইসলাম। রাসুলুল্লাহর অনুসরণ ছাড়া কেউ পুর্ণাঙ্গভাবে ইসলামে দাখেল হতে পারে না। এজন্য উম্মতে ইজাবার ওপর কিছু দায়দায়িত্ব আছে। উম্মতের ইজাবার কাজ হচ্ছে দাওয়াত ও তাবলিগের কাজ। এই কাজ পালন করতে গিয়ে চারটি মৌলিক দায়িত্বের প্রতি নজর দেয়া প্রয়োজন।
প্রথম দায়িত্ব হচ্ছে, যারা ইসলাম কবুল করেনি তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেয়া এবং ইসলামে দাখেল করে নেয়া।
দ্বিতীয় দায়িত্ব হচ্ছে, যারা ইসলাম কবুল করে সৌভাগ্যশীল হয়েছে তাদেরকে ইসলামের সুমহান আদর্শ শিক্ষা দেয়া এবং অন্যদেরও শিক্ষার ব্যবস্থা করা।
তৃতীয় দায়িত্ব হচ্ছে, শিক্ষা মোতাবিক অনুশীলন করা এবং করানো।
চতুর্থ দায়িত্ব হচ্ছে, যারা ইসলামি আমল-আখলাকের প্রতি উদাসীন তাদের সজাগ করা এবং পরিপূর্ণভাবে ইসলামি অনুশীলনে অনুপ্রাণিত করা।
এ দায়িত্বগুলো সুন্নত তরিকায় পালন করার সকল জ্ঞান আত্মস্থ করা সামর্থ অনুযায়ী সকল মুসলমানদের ওপর আবশ্যক। আর যারা ওলামা মাশায়েখ রয়েছেন, তাদের ওপর তো এই দায়িত্বগুলো বিশেষভাবে অর্পিত হয়েছে। কারণ তারা হচ্ছেন বিশ্বনবীর ওয়ারিশ বা উত্তরসূরী; তারা অর্থ-সম্পদের উত্তরসূরী নন। উত্তরসূরী হচ্ছে তাঁর সুন্নাহ ও আদর্শের।
বর্তমান বিশ্বে মুসলমানদের অবস্থা অত্যন্ত দুঃখজনক। সারাবিশ্বে নির্যাযিত ও অপদস্ত মুসলমানের সংখ্যা অগণিত। মুসলমানদের ঈমানী শক্তিও অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছে। যত দিন যাচ্ছে ততই দূর্বল হতে হতে মুসলমানদের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। এই অবস্থার পরিবর্তন ও পরিশোধনের জন্য ব্যক্তিপর্যায়ে চেষ্টা হচ্ছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আবার অনেক বিষয়ে সম্মিলিত প্রচেষ্টাও অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে ভালো কাজের আদেশ প্রদান, দাওয়াত ও নসিহত মোটামুটি সারাবিশ্বেই চালু রয়েছে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয় অত্যন্ত গভীরভাবে বিবেচনা করা প্রয়োজন।
প্রথমত, ব্যক্তিপর্যায়ে মন্দকাজের পরিবর্তন ও পরিশোধনের প্রচেষ্টা থাকলেও সমষ্টিগতভাবে যথাযথ কর্মসূচি নেই বললেই চলে। আর একথা সর্বজনস্বীকৃত যে, দুধের মধ্যে এক ফোটা বিষ পতিত হলে সে দুধের কোনো উপকারিতা থাকে না। মন্দ কাজ অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধির পরিণামে মুসলিম সমাজের সংস্কার ও সংশোধনী কর্মকাণ্ডের উপকারিতা ফলপ্রসূ হচ্ছে না। তাই এ বিষয়ে সংস্কারপন্থী চিন্তাশীলদের বিশেষ মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন।
দ্বিতীয়ত, ভালো কাজের প্রচারকারীদের সংখ্যা যত বৃদ্ধি পায় তার তুলনায় শতগুণ বৃদ্ধি পায় মন্দ প্রোপাগাণ্ডা। এর প্রধান কারণ সমস্ত অমুসলিমের তুলনায় মুসলমানদের সংখ্যা কম হওয়া এবং ভালো কাজের প্রচার কম হওয়া। দ্বিতীয় কারণ বলা যায়, খোদ মুসলমানরাই ব্যক্তিগত ও সামাজিকভাবে ইসলামের ব্যাপারে উদাসীন। যখনই উম্মাহ ইলমে দ্বীনের প্রতি শৈথিল্য প্রদর্শন করেছে তখনই বিভিন্ন ফিতনা ও গোমরাহি উম্মাহর মাঝে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। বিগত শতাব্দির অবিসংবাদিত আলেম ও দাঈ হযরত মাওলানা ইলিয়াস রহ. প্রতিষ্ঠিত তাবলিগ জামাতের মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহ কল্পনাতীত উপকার লাভ করেছে এবং এখনও করছে। আল্লাহ চাহে তো কিয়ামত পর্যন্ত মানুষ এর মাধ্যমে উপকৃত হতে থাকবে।
সাধারণ মানুষকে দ্বীনের সাথে জুড়ে রাখার জন্য তাবলিগের কাজ যে কত প্রয়োজন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ কাজের ফলাফল এত বাস্তব যে, এর প্রয়োজন বুঝানোর জন্য কোনো যুক্তি-তর্কের প্রয়োজন হয় না। তাই সর্বস্তরের সকল মুসলমানকেই এ মহতি কাজে জুড়ে থাকা একান্ত জরুরি। আর নিজের ঈমান-আমলের সঠিক হেফাজতের জন্যও তাবলিগি কাজের সাথে জুড়ে থাকা প্রয়োজন। নিজের অধীনস্তদেরকেও এ কাজে জুড়ে রাখার মেহনত করা। তাদের আগমনকে বরকত মনে করে তাদের কাজে সাহায্য করা। বিশেষ করে মসজিদের ইমাম সাহেব তাদের সাথে সমর্থনমূলক ও ভালো আচরণ করা। এতে মুসল্লিগণ সহজে কাজে জুড়বে বলে অধিক আশা করা যায়। যথাসম্ভব নিজেও শরিক হবে ও মুসল্লিদের শরিক হওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করবে। তাদের কোনো বিষয় অপছন্দনীয় মনে হলে মনে করতে হবে যে, তারা সাধারণ মানুষ। হয়ত এ ব্যাপারে তাদের সঠিক বিষয়টি জানা নেই। তাই ধৈর্য্য ও মহব্বতের সাথে সংশোধনের চেষ্টা করবে।
তাবলিগওয়ালা ভাইদেরও হযরত মাওলানা ইলিয়াস রহ. এর কথাটা মনে রাখতে হবে। তিনি প্রায়ই বলতেন, আমাদের এই মেহনতে যুক্ত সকলকে খুব ভালোভাবে বুঝতে হবে যে, তাবলিগ জামাতে বের হওয়ার উদ্দেশ্য শুধু অন্যের কাছে দাওয়াত পৌঁছানো নয়; বরং এর মাধ্যমে নিজের ইসলাহ ও সংশোধন এবং নিজের তালিম-তরিবয়তও উদ্দেশ্য।
হযরত মাওলানা ইলিয়াস রহ. তাঁর এই দাওয়াতি আন্দোলনের নিরাপদ ভবিষ্যত নিশ্চিত করার জন্য ইলম ও যিকিরের গুরুত্ব বিশেষভাবে উপলব্ধি করতেন। ফলে তিনিও তাঁর পূর্বসূরী বুযুর্গানে দ্বীনের ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে দাওয়াত ও তাবলীগের কর্মীদেরকে ইলম ও যিকিরের প্রতি মনোযোগী হওয়ার জোর তাগিদ দিতেন।
হযরত মাওলানা ইলিয়াস রহ.-এর জীবনের শেষ সময়ে নিযামুদ্দীনে প্রচুর লোক আসত। সে সময়ে তিনি অসুস্থতার কারণে জোর আওয়াজে কথাও বলতে পারতেন না। তবুও তিনি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে উপস্থিত পুরো জামাতের উদ্দেশ্যে হেদায়াতি বয়ান করলেন। সে বয়ানে তিনি বলেছিলেন, আপনারা যদি ইলমে দ্বীন এবং যিকরুল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ গুরুত্ব না দেন তাহলে আপনাদের সমস্ত মেহনত-মোজাহাদা বেকার হয়ে যাবে। ইলম ও যিকির হল এই মেহনতের দুটি ডানা, যা ছাড়া সে আকাশে উড়তে পারবে না। যদি দ্বীনের ইলমই না থাকে তাহলে তো ইসলাম এবং ঈমান রসম ও নামসর্বস্ব হয়ে যাবে। আর আল্লাহর যিকির ছাড়া যদি ইলম হয় তবে তা সরাসরি জুলুমাত ও অন্ধকার। আর যদি ইলমে দ্বীন ছাড়া যিকিরের আধিক্য হয় তবে তাতেও খতরা রয়েছে।
হযরত মাওলানা ইলিয়াস রহ. এর আরেকটা কথা খুবই প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলতেন, আমাদের এই দাওয়াত ও তাবলিগের কাজে জড়িত সবারই জানা উচিত যে, তাবলীগের জন্য বের হওয়ার সময়গুলোতে ইলম ও যিকিরের প্রতি খুব বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। ইলম ও যিকিরের উন্নতি ছাড়া দ্বীনের তারাক্কি সম্ভব নয়। আর এ কথাও স্মরণ রাখতে হবে যে, ইলম ও যিকিরের পূর্ণতা তখনই হাসিল হবে যখন এই রাস্তার বড়দের সাথে সম্পর্ক রাখা হবে এবং তাদের হেদায়েত ও নেগরানি গ্রহণ করা হবে। আম্বিয়ায়ে কেরাম আলাইহিমুস সালামের ইলম ও যিকির অর্জিত হত আল্লাহ তাআলার হেদায়েত ও তত্ত্বাবধানে। হযরত সাহাবায়ে কেরামের ইলম ও যিকির সম্পন্ন হয়েছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নেগরানি ও দিকনির্দেশনায়। এরপর প্রত্যেক যুগেই আহলে ইলম ও আহলে যিকির যেন নবী আলাইহিস সালামের খলিফা ও প্রতিনিধি। এ কারণে ইলম ও যিকিরের ক্ষেত্রে আহলে ইলমদের থেকে বেশি বেশি সোহবত নিতে হবে। এ বিষয়টি আরো গভীরভাবে বুঝতে হলে ইলিয়াস রহ. এর আরেকটি কথায় নজর দিতে হয়।
তিনি বলতেন, ইলম ও যিকির এখনও পর্যন্ত আমাদের মুবাল্লিগদের আয়ত্তে আসেনি। এজন্য আমার বড় চিন্তা হয়। আমার কাছে এর সমাধান হলো, এ লোকদেরকে আহলে ইলম ও আহলে যিকিরের কাছে পাঠানো। যাতে তারা তাদের তত্ত্বাবধানে তাবলিগের কাজ করে আবার তাদের ইলম ও সোহবত দ্বারা উপকৃত হয়।
সবশেষে তাবলিগি ভাইদের উদ্দেশ্যে একটি কথাই বলতে চাই, আমরা যারা এই মহতি মেহনতে যুক্ত রয়েছি, আমরা যেন অবশ্যই তাবলিগি নিয়মের পাবন্দি করি। পানাহার থেকে শুরু করে যাবতীয় খরচাপাতি সব কিছু নিজে বহন করি। বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে দাওয়াত খেতে যাওয়া অত্যন্ত ক্ষতিকর। এতে সময়ের প্রভূত অপচয় হয়। উপরন্তু অনেকের চোখে বাধে ও সমালোচনার পথ সুগম হয়, তাই এ বিষয়ে খুব সতর্ক থাকা উচিত। তাবলিগি কাজের আসল স্থান হলো মসজিদ।
তাই মসজিদের আদব রক্ষা করা খুবই জরুরি। বিশেষত অনেক মসজিদ ও কমিটিদের তরফ থেকে দ্বীনি কাজ পরিচালিত হয়ে থাকে, তাদের কাজে যেন ব্যাঘাত না হয়। সুষ্ঠু-সুন্দর কাজের জন্য প্রয়োজনে তাদের থেকে আগেই অনুমতি নিবে। আল্লাহ আমাদেরকে পূর্ণাঙ্গভাবে ইসলামের খেদমত করার তওফিক দান করুন। আমীন।
বয়ান থেকে অনুলিখন: রিদওয়ান হাসান
কেএল/