|| মুহাম্মাদ সাইফুদ্দীন গাজী ||
শাইখুনা ওয়া শাইখুল ইসলাম মুফতী তাকী উসমানী হাফিজাহুল্লাহ’র বহুল আলোচিত ভাষণের পর্যালোচনা হওয়ার প্রয়োজনবোধ করি।
এটা নিছক শাইখের প্রতি মুগ্ধতা ও ভালোবাসা থেকে নয়, বরং ভাষণের অন্তর্নিহিত গুরুত্ব, গভীর তাৎপর্যের কারণেই এর পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ হওয়া উচিত মনে করি। এতে করে পাঠকের সামনে ভাষণের নির্দেশনা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠতে পারে এবং উম্মাহ আরও বেশি উপকৃত হতে পারে।
শাইখের ভাষণ ছিল বহুমাত্রিকতায় ভরপুর। এতে যেমন ছিল অভিভাবকসুলভ আর্তি, তেমনি ছিল উম্মাহর প্রতি গভীর মমত্ববোধ ও ভালোবাসা বহিঃপ্রকাশ। এতে যেমন আছে শরীয়তের স্বীকৃত ফতওয়া, ইতিহাসের গূঢ় দর্শন, নব্যফেরাউনের সম্মুখে সত্য উচ্চারণ, তেমনি আছে উম্মাহর করণীয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা। বিশেষকরে ফি]লিস্তিনসংকট নিরসনে কার্যকরি পদক্ষেপ কী হওয়া উচিত, তা নিঃসংকোচে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তিনি ব্যক্ত করেছেন। তিনি ফি]লিস্তিন সংকটে নানামুনির নানামতকে প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং শরীয়ত, সিয়াসত ইতিহাস ও বাস্তবতার নিরীখে প্রকৃত করণীয় তুলে ধরেছেন। ইত্যকার বিবেচনায় ভাষণটির ঐতিহাসিকতা অনস্বীকার্য, ইতিহাস বহুকাল তা স্মরণে রাখবে। যেকারণে তাঁর চরম নিন্দুকও এ ভাষণের প্রশংসা করতে বাধ্য হয়েছে।
যেহেতু কনফারেন্সের আলোচ্য বিষয় ছিল "আকসার মর্যাদা ও মুসলিমউম্মাহর করণীয়", সেহেতু শাইখের ভাষণের মূল প্রতিপাদ্য ছিল ফিলিস্তিন ও আকসা। তথাপি তার আলোচনায় উম্মাহর সার্বিক মুক্তি ও অন্যান্য অনেক বিষয় আলোচিত হয়েছে। বিজ্ঞ শ্রোতা-পাঠক তা উপলব্ধি করতে পেরেছেন। আমি কয়েকটি বিষয়ের প্রতি সুধীপাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি।
প্রসঙ্গ : ফি]লিস্তিন সমস্যার গুরুত্ব
শাইখের নিকট বর্তমান সময়ের সবচে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ফিলিস্তিন ও আকসা ইস্যু। শাইখ বিষয়টি অত্যন্ত সিরিয়াসলি নিয়েছেন। যুদ্ধ শুরুর প্রথম থেকেই শাইখ এ ইস্যুতে নানা উপলক্ষে কথা বলে আসছেন। পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে, বিভিন্ন মাজমায় কথা বলে, জুমুআপূর্ব আলোচনার মাধ্যমে ফিলিস্তিন সংকটের প্রতি সবার মনোযোগ আকর্ষণ করতে চেষ্টা করেছেন। গাজ্জাবাসীর বিপদে তিনি এতটাই কাতর ও অস্থির হয়ে পড়েছেন, গাজ্জাবাসীর সাহায্য-সহযোগিতা করার জন্য বিভিন্ন সংগঠন সংস্থা ও সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেই চলেছেন। তাদের জন্য প্রত্যেক নামাযের পর তিনি দুআ করেন ও করান। ফজরে কুনূতে নাযিলার পড়ার প্রতি বিশ্বমুসলিমের উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন।
যারা গাজ্জাবাসীর দুর্ভোগ সম্পর্কে সম্যক অবগত এবং ভাতৃত্ব ও মানবিক অনুভূতি যাদের পূর্ণ সুস্থ ও জাগ্রত, তারা ফিলি]স্তিনি ভাইবোনদের এহেন করুণ পরিস্থিতিতে স্থির থাকতে পারে না। তার মন অস্থির হবে, চক্ষু সজল হবে, হস্ত মুষ্ঠিবদ্ধ হবে এবং কিছু করার জন্য সে বেকারার হয়ে পড়বে। শাইখুল ইসলামের মধ্যে তা পূর্ণ মাত্রায় লক্ষ করা গেছে। তিনি হৃদয় থেকে এ সমস্যার গভীরতা উপলব্ধি করেছেন এবং অভিভাবক সূলভ কর্তব্য সম্পাদন করতে চেষ্টা করেছেন।
শাইখুল ইসলাম এ যুদ্ধকে হামাস-ইসরাইল যুদ্ধ মনে করেন না। বরং মুসলিম উম্মাহ ও কুফফার শক্তির সিদ্ধান্তমূলক লড়াই মনে করেন। কারণ, আকসা কেবল হামাসের নয়, বরং সমগ্র মুসলিম উম্মাহর পবিত্র কেবলা। এক্ষেত্রে হা]মাস কেবল মুসলিম উম্মাহর প্রতিনিধিত্ব করছে। হামাসের এ লড়াই নিঃসন্দেহে শরঈ জিহাদ এবং হা]মাস প্রকৃত মুজাহিদ। কাজেই হা]মাসকে সাহায্য করা সমগ্র মুসলমানের ওপর ফরজ।
তিনি মনে করেন, এযুদ্ধেই ফি]লিস্তিন সমস্যার সসাধান করে নিতে হবে। এটাই এ সমস্যা উত্তরণের মহাসুযোগ। মুসলিম উম্মাহ যদি স্ব স্ব সাধ্যানুসারে সহযোগিতা করে, তা হলে এসমস্যা এবারই সমাধান হতে পারে এবং আকসা উদ্ধার হতে পারে। এক্ষেত্রে বিলম্ব করা, নিস্ক্রিয় থাকা বা উদাসীনতার পরিচয় দেওয়া চরম আত্মঘাতি প্রমাণিত হতে পারে এবং আকসা অনির্দিষ্টকালের জন্য পূর্ণ হাতছাড়া হতে পারে।
এক্ষেত্রে তিনি যেমন শরীয়তের ফতওয়া ও ইতিহাস-দর্শন হাজির করেছেন, তেমনি তিনি ব্যক্তিগত গভীর চিন্তা, অন্তর্দৃষ্টি, আল্লাহর প্রতি রুজু ও ইস্তিখারার ফলাফল পেশ করেছেন; উদ্ভূত নতুন সমস্যার সমাধানে যার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। আর বাস্তবিকই তিনি একজন অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ।
তিনি বলেছেন, ‘আমি আমার অন্তরকে ভালোভাবে যাচাই করে, তারপর আল্লাহর দিকে রুজু করে এবং তাঁর কাছে দুআ ও ইস্তিখারা করে আমি উপলব্ধি করতে পেরেছি- ইতিহাসে কিছু মুহূর্ত এমন আসে, যদি সে মুহূর্তে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করা হয়, তা হলে শত শত বছর সে ভুলের মাশুল গুণতে হয়। প্রসিদ্ধ উক্তি আছে-
لمحوں نے خطا کی، صدیوں نے سزا پائی ۔
‘মুহূর্ত করেছে ভুল,
শতবর্ষ গুণেছে মাশুল।’
ইতিহাসে এমন কিছু মুহূর্ত আসে, যখন হিম্মত ও সাহসিকতার, ত্যাগ ও কুরবানীর সর্বোচ্চ পারাকাষ্ঠা দেখিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। যদি সেই সঠিক সিদ্ধান্ত যথাসময়ে নিতে বিলম্ব করা হয়, তাহলে শত শত বছর ধরে তার ক্ষতি ও গ্লানির বোঝা বয়ে বেড়াতে হয়। আমি মনে করি, এখন মুসলিম উম্মাহ ইতিহাসের সেই যুগসন্ধি অতিক্রম করছে।
মুসলিম উম্মাহর প্রথমকিবলা ও ফি]লিস্তিন সমস্যা নিয়ে তিনি কতটা নিমগ্ন, এ উক্তি তার উজ্জ্বল প্রমাণ।
স্মরণ রাখতে হবে, যেকোনো সংকটে মুমিনের বাহ্য চেষ্টা-প্রচেষ্টা যেমন কার্যকর, তেমনি তার মনোযোগ, চিন্তাফিকির ও দুআ অত্যন্ত ফলদায়ক। এজন্যই তো মুনকার প্রতিরোধে সামর্থহীনতার মুহূর্তে ‘ফাবিকালবিহী’র একটি স্তর রাখা হয়েছে। "ইত্তাকূ ফিরাসাতাল মুমিন" বলে মুমিনের অন্তর্দৃষ্টি সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে।
বস্তুত, বর্তমান সময়ে ফি]লিস্তিন ইস্যু উম্মাহর প্রধান জাতিয় সমস্যা। উম্মাহর কোনো সদস্য এত্থেকে গাফিল ও নিস্ক্রিয় হতে পারে না। যেকোকোনো উপায়ে আকসামুক্তির এ জিহাদে শরীক হওয়া জরুরি।
এ প্রসঙ্গে তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন : আমি একজন তালিবে ইলম হিসাবে আরজ করতে চাই, বিশ্বের সমস্ত মুসলমানদের ওপর এ অর্থে জি]হাদ ফরজ- তারা নিজ নিজ সামর্থানুসারে সাধ্যমত হা]মাস ও গাজ্জাবাসীকে সাহায্য সহযোগিতা করবে।"
কাজেই আসুন ছোটখাট বিষয় নিয়ে ঝগড়াবিবাদ না করে ফিলিস্তিন সমস্যাকে গুরুত্ব দিই। আকসা ও গাজ্জাবাসীর প্রতি মনোনিবেশ করি। স্বামর্থানুসারে কিছু করার চেষ্টা করি। অন্তত দুআ ও অশ্রুর মাধ্যমে এ জিহাদের শক্তি সরবরাহ করি!
প্রসঙ্গ : চলমান যুদ্ধ ও ফিলিস্তিন সংকট নিয়ে কতক সংশয়ের অপনোদন
শাইখুল ইসলাম তাঁর ভাষণে তিনটি, বরং ৪টি বড় বিভ্রান্তির অপনোদন করেছেন, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
এক. আন্তর্জাতিক মহলের যুদ্ধবন্ধের প্রস্তাবের মর্ম কি? হামাস কি তার ন্যায় যুদ্ধ বন্ধ করবে?
দুই. ফি]লিস্তিন সংকটের সমাধান কি? দ্বি-রাষ্ট্র ও সহাবস্থান, নাকি একক ফিলি]স্তিন রাষ্ট্র?
তিন. হামা]সের কার্যক্রম কি সন্ত্রাসী তৎপরতা?
চার. হা]মাস কি ফি]লিস্তিনীদের প্রতিনিধিত্ব করে? নাকি ওরা জনবিচ্ছিন্ন সংগঠন?
বহুলোক এ বিষয়গুলোতে বিভ্রান্তির শিকার। বিশেষকরে বহু মুসলিম সরকারপ্রধান, রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবি, চিন্তাবিদ এমনকি বহু আলিম সেলিব্রিটিও এ বিভ্রান্তিতে পড়ে আছে। শাইখ সেই ৪টি বিভ্রান্তি ও সংশয়ের অপনোদন করেছেন এবং বিষয়তিনটি স্পষ্ট করেছেন। এতে যেমন তাঁর বিচক্ষণতা ও দূরদর্শীতার প্রমাণ মেলে, তেমনি তার আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক চিন্তার স্বচ্ছতা প্রতিভাত হয়।
প্রথমত, আন্তর্জাতিক মহল ও বিভিন্ন পক্ষ থেকে উভয়পক্ষকে যুদ্ধবন্ধের আহ্বান করা হচ্ছে, যদি মার্কিন ভ্যাটোর কারণে তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। শাইখ বলেন, উভয়পক্ষকে যুদ্ধবন্ধের আহ্বান সঠিক নয়। বরং আহ্বান হওয়া উচিত ইসরাইলের বর্বর বোমা হামলার, যা স্পষ্ট যুদ্ধাপরাধ, হামাসের যুদ্ধ বন্ধের নয়।
হামাস কেন যুদ্ধ বন্ধ করবে? হামাস তো ন্যায্য অধিকার আদায়ের লড়াই করছে। তারা তাদের শত্রুকর্তৃক অধিকৃত ভূমি উদ্ধারের লড়াইয়ে নেমেছে। জন্মগত অধিকার ও ইসলামের দলীলের ভিত্তিতে হামাস স্বাধীনতাযুদ্ধে রয়েছে। এক ইঞ্চি জায়গাও শত্রুকবলিত থাকাকালে এ জি]হাদ অব্যাহত থাকতে হবে। ই]সরাইল চাইলে হামাসের সাথে লড়াই করুক। তবে তাকে সাধারণ নিরীহ মানুষের ওপর বর্বর বিমান হামলা বন্ধ করতে হবে। প্রস্তাব হওয়া উচিত এটি- হা]মাসের ন্যায়সংগত জি]হাদ বন্ধের নয়। বরং সবার উচিত হামা]সকে তাদের ভূমি উদ্ধারে এবং আকসা মুক্তকরণে সাহায্য করা।
এ প্রসঙ্গে শাইখের বক্তব্য পরিস্কার- তিনি বলেছেন : "আমাদের দাবি হলো, গা]জ্জার ওপর ইস]রাইলের বোমাহামলা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে, হা]মাসের স্বাধীনতাযুদ্ধ বন্ধ নয়। হা]মাসের জানবাজ লড়াকু মুজা]হিদরা তাদের জন্মগত অধিকার ও ইসলামের আলোকে সমগ্র ফি]লিস্তিনভূমি ইস]রাইলের দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত করার যুদ্ধে নেমেছে। এ যুদ্ধ থামিয়ে দেওয়ার যুদ্ধ নয়। এ যুদ্ধ অমিমাংসিতভাবে শেষ করার যুদ্ধ নয়। এটি ততদিন অব্যাহত থাকতে হবে এবং থাকা উচিত, যতদিন না পূর্ণ ফি]লিস্তিনভূমি ইস]রাইলের কব্জা থেকে মুক্ত হবে।
"যদি ইস]রাইল সাধারণ নাগরিকদের ওপর বোম্বিং বন্ধ করে খোলাখুলি যুদ্ধের ময়দানে হামাসের মোকাবেলা করতে চায়, তা হলে মোকাবেলা করুক। হা]মাস লড়াই করতে প্রস্তুত। যতক্ষণ পর্যন্ত ওদের একটি ট্যাঙ্ক ও একটি সৈন্যও অবশিষ্ট থাকবে, ততদিন হা]মাসের প্রতিরোধযুদ্ধ অব্যাহত থাকবে।"
দ্বিতীয়ত, ফি]লিস্তিন সঙ্কটের সমাধান অনেকেই দ্বি-রাষ্ট্র নীতি মেনে নেওয়াকে মনে করেন। এবং ই]য়াহুদিদের সাথে সহাবস্থান ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে চলাকে একটি যৌক্তিক ও নিরপেক্ষ সমাধান মনে করে তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন। বস্তুত ইতিহাস সম্পর্কে অসচেতনতা এবং ইয়া]হুদিচরিত্র সম্পর্কে জ্ঞানহীনতাই এ প্রস্তাবের অন্যতম কারণ।
ইতিহাসের নিরীখে এ জমীন মুসলমানদের। কতক মুনাফিকের বিশ্বাসঘাতকতা এবং বৃটেন-আমেরিকার ষড়যন্ত্রে মুসলমানের গোদের ওপর ইস]রাইল নামক বিষফোঁড়া বসিয়ে দিয়েছে। ফি]লিস্তিনিদের ভুমি দখল করেই তারা রাষ্ট্রগঠন করেছে। এর সাথে ধর্মবিশ্বাসের নানা মিথ ও মিথ্যা যুক্ত করে পুরো ফি]লিস্তিন দখলে তারা মরিয়া হয়ে ওঠেছে।জাতিসংঘের দ্বি-রাষ্ট্র প্রস্তাব ই]সরাইল প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা পুরো ফি]লিস্তিন দখল করে একক ইয়া]হুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধপরিকর, অথচ জায়গাটা পুরোই মুসলমানদের। যারা এমন আগ্রাসী উচ্চাভিলাষী বর্বর দখলদার ইয়া]হুদিদের সাথে নিজের জমীনে সহাবস্থান ও বন্ধুত্ব সম্পর্কের বুলি আওড়ান, তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। ইয়া]হুদিদের উচ্চাভিলাষী একক ইয়া]হুদিরাষ্ট্রের বিপরীতে একক মুসলিম ফিলি]স্তিন রাষ্ট্রই একমাত্র সমাধান। নতুবা এ ভূখণ্ডে মুসলিমরা একদমই টিকতে পারবে না, যা ইতিমধ্যে পরিস্কার হয়ে গেছে। বিগত পঁচাত্তর বছর ধরে ফি]লিস্তিনিদের বেশিরভাগ জমীনই ওরা গ্রাস করে নিয়েছে। বাকিটা গ্রাস করার গোপন চক্রান্তের মুহূর্তে হা]মাস জীবনবাজি রেখে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে নেমেছে। একক ফি]লিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই এর টেকসই সমাধান।
সেই যোক্তিক ও বাস্তবোচিত কথাই ধ্বনিত হয়েছে শাইখুল ইসলামের ভাষণে। তিনি বলেছেন : "বিভিন্ন সরকারের পক্ষ হতে এবং অনেক শান্তিকামী লোকদের পক্ষ হতে বিভ্রান্তির শিকার হওয়ার কারণে ফি]লিস্তিনে দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান প্রস্তাব করা হচ্ছে। অর্থাৎ সেখানে দুই রাষ্ট্র কায়েম হওয়াকে সমাধান মনে করা হচ্ছে। ইস]রাইলের অধিকৃত অঞ্চল নিয়ে ইস]রাইল রাষ্ট্র, অবশিষ্ট অঞ্চল নিয়ে ফি]লিস্তিন রাষ্ট্র। এটা সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিকর প্রস্তাব। এ প্রস্তাব কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা তা সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করছি।"
তৃতীয়ত, হামা]সকে পশ্চিমারা টেরোরিষ্ট এবং তাদের কার্যক্রমকে সন্ত্রাসী তৎপরতা আখ্যা দিয়ে আসছে। পশ্চিমা প্রভাবিত মুসলিম শাসকগোষ্ঠীও তাদের অনুগামী। বহু সাধারণ মানুষ তাদের প্রোপাগাণ্ডার শিকার।
শাইখুল ইসলাম হাফি. এর শক্ত খণ্ডন করে বলেছেন : "হা]মাস একটি রাজনৈতিক শক্তি। এটা নিছক যুদ্ধবাজ গোষ্ঠী নয়। আমার আক্ষেপ লাগে, কতক মিডিয়ায় ওদেরকে 'যুদ্ধকামী গোষ্ঠী' আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। অথচ এরা সকলে মুজা]হিদ, পবিত্র জিহা]দে রত। ...
"যে কারণে পশ্চিমারা ওদেরকে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়েছে। অথচ আসল সন্ত্রাসী হলো ইস]রাইল, যারা পঁচাত্তর বছর থেকে ফি]লিস্তিনে নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়ে আসছে।"
চতুর্থত, হা]মাসকে পশ্চিমারা ফিলি]স্তিনের প্রতিনিধি মনে করে না। এমনকি আরবের বেশিরভাগ শাসকগোষ্ঠীর একই ধারনা। বরং তারা ফাতাহ ও মাহমুদ আব্বাসকে ফি]লিস্তিনের বৈধ রাজনৈতিক প্রতিনিধি মনে করে। পশ্চিমের পোষ্য মাহমুদ আব্বাসও নিজেকে ফি]লিস্তিনের একমাত্র বৈধ প্রতিনিধি দাবী করে আসছেন। তিনি হামা]সের প্রতিনিধিত্ব অস্বীকার করে বিবৃতিও দিয়েছেন।
শাইখুল ইসলাম সেটাও খণ্ডন করেছেন এবং বলেছেন : "হামা]স সমগ্র ফিলি]স্তিন ভূখণ্ডের মুখপাত্র। কাজেই "হা]মাস একটি জনবিচ্ছিন্ন সংগঠন, এরা ফিলি]স্তিনের প্রতিনিধিত্ব করে না"- এ জাতিয় বিভ্রান্তিকর কথাবার্তা থেকে সকলের বিরত থাকা উচিত।"
বাস্তবেও তাই। গত নির্বাচনে হা]মাস বিজয়ী হয়েছিল এবং সরকার গঠনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। কিন্তু পশ্চিমা ষড়যন্ত্রে হামা[স ফি]লিস্তিনের শাসন ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত হয়। পশ্চিমারা তাদের পুতুল মাহমুদ আব্বা]সকে পশ্চিমতীরের শাসনক্ষমতায় বসিয়ে দেয় এবং পুরো ফি]লিস্তিনের প্রতিনিধি হিসাবে স্বীকৃত দেয়। এরপর থেকে বাহ্যত ফি]লিস্তিনের দু অংশে দু পক্ষের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
বাস্তবে পুরো ফি]লিস্তিনে হামা[সের শাসন চলছে। সবার মন ও মস্তিষ্কের ওপর হা]মাসের রাজত্বই। এ যুদ্ধকালীন সময়ে বিষয়টি একেবারে দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে গেছে। এত দুর্ভোগ দুঃখ কষ্টের পরেও হামা]সের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। সবাই হামাসকে নিয়ে গর্বিত। ওরা আবু উ]বায়দা ও ইসমা]ঈল হানি[য়াকে হিরো এবং মাহমুদ আব্বা]সকে ভিলেন মনে করে। বর্তমানে পশ্চিমতীরেও কার্যত ফাতাহর কোনো প্রভাব নেই। লোকেরা সেখানে ইস]রাইল ও তার দালালদের বিরুদ্ধে মিছিল করছে। দলে দলে মানুষ গোপনে জি]হাদে যোগ দিচ্ছে। ফাতাহ সরকার কিছুই করতে পারছে না। এসব প্রমাণ করে হা]মাসই ফিলি[স্তিন ভূখণ্ডের আসল শাসক, যেভাবে তারা সেখানকার সবার হৃদয়রাজ্যের রাজা। শাইখুল ইসলামের ভাষণে সেকথাই ধ্বনিত হয়েছে।
শাসকদের সমালোচনা কীভাবে করতে হয়, তার একটা অনুসরণীয় ধারণা পাওয়া যায় শাইখুল ইসলাম মুফতী তাকী উসমানী হাফি. ভাষণে। তিনি দৃঢ়তার সাথে বলেছেন, শাসকের ভুলত্রুটির সমালোচনা করা শাসিতের অধিকার। শাসকের ভুলত্রুটি হলে তাদের বোঝানো দায়িত্বশীল নাগরিকের কর্তব্য।
তবে সে অধিকার প্রয়োগ করার ধরণ ও ব্যাকরণ কী হবে, তাও তিনি উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন- "তানকীদ ও সমালোচনা করা নিশ্চয় আমাদের অধিকার। আমরা অবশ্যই একথার আদিষ্ট, যে বিষয়টিকে আমরা হক মনে করবো, তা শাসকশ্রেণীর কাছে পৌঁছে দেব।
"তবে বিষয়টি 'মুখাসামাত' তথা তর্ক-বিতর্কের আবহে বাদী-বিবাদীর রীতিতে নয়, বরং 'মুফাহামাত' তথা তাদের বোঝানো ও নসীহতের আবহে হওয়া উচিত। কারণ, আমাদের দীন সকল মুসলিমের জন্য নসীহত তথা কল্যাণকামিতার আদেশ করেছে। "আননুসহু লিকুল্লি মুসলিম" এর মধ্যে "আননুসহু লি উলিল আমর"ও রয়েছে। আহলে ইলমগণ সে দিকে লক্ষ্য রেখেই দায়িত্ব পালন করবে।"
ওই ভাষণে শাইখ নিজেই সমালোচনার সুন্দর দৃষ্টান্ত স্থাপন করে দেখিয়েছেন। শাসকদের সমালোচনা করতে গিয়ে বলেছেন : মুসলমানদের ওপর এহেন জুলম ও নির্বিচার হত্যা সত্ত্বেও, যেখানে মাসুম শিশু ও নারীর রক্তাক্ত বিভৎস ও ভয়ার্ত চেহারা সহ্য করার মত নয়, এতদসত্ত্বেও মুসলিম সরকারগুলোর পক্ষ হতে আশানুরূপ পদক্ষেপ লক্ষ করা যায়নি। কেবল মৌখিক নিন্দাবিবৃতি ও সামান্য ত্রাণসামগ্রি পাঠানো ছাড়া তেমন কোনো কার্যকরি পদক্ষেপ দেখা যায়নি। আমরা সরকারগুলোর ত্রাণতৎপরতার প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা জানানোর পাশাপাশি আফসোসের সাথে বলতে বাধ্য হচ্ছি, আমাদের শাসকগোষ্ঠী যে ধরণের সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করার প্রয়োজন ছিল, তা এখনো তারা করে দেখাতে পারেনি।"
একদিকে তিনি শাসকদের নিন্দাবিবৃতি ও যৎসামান্য ত্রাণতৎপরতার শোকরিয়া ও প্রশংসা করেছেন, অপরদিকে এক্ষেত্রে তাদের আরও পূর্ণ দায়িত্ববান হতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। শাসকদের বর্তমান তৎপরতা ফি]লিস্তিন সমস্যার সমাধানে পর্যাপ্ত নয়, এটা তিনি পরিস্কার করেছেন। ফিলি]স্তিনিদেরকে সামরিক সহায়তাও দিতে হবে। তবে এর অর্থ এই নয়, প্রকাশ্যে ফিলি]স্তিনীদের পক্ষে ইস]রাইলের ওপর বোমা হামলা করবে। বর্তমান বিশ্ব রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যা প্রায় অসম্ভব। বরং হতে হবে গোপনে কৌশলে এবং ছাড় ও সহযোগিতামূলক।
নিজ দেশের কোনো নাগরিক সেখানে যেতে চাইলে তাকে বাধা দিবে না। পার্শ্ববর্তী দেশগুলো ত্রাণ ও জনশক্তি পৌঁছানোর রুট হিসাবে ব্যবহারে অন্যদের সুযোগ দিবে। এক্ষেত্রে তিনি ইসমাইল হানিয়ার সাথে সহমত পোষণ করেছে।
হানিয়া বলেছেন : "আমরা চাই না, আপনারা আমাদের পক্ষে সেখানে হামলা করুন। আমরা চাই আপনারা গা]জ্জাবাসীকে যথাসাধ্য সাহায্য করুন এবং এতে কোনোরূপ ত্রুটি করবেন না।"
তাছাড়া কনফারেন্সের ১০দফা ঘোষণায় সেধরণের সহযোগিতার কথা উল্লেখ আছে।
কেএল/