বুধবার, ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ।। ২২ মাঘ ১৪৩১ ।। ৬ শাবান ১৪৪৬


সময় থাকতে আখেরাতের পাথেয় সংগ্রহ করতে হবে

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার
সংগৃহীত

মাওলানা আহমাদ লাট, ভারত

একজনের মানুষের যাত্রা শুরু হয় জন্মের পর থেকে। কিন্তু সেই জীবনের শেষ কবে হবে সেই সংবাদ আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না। এ কথার পর ভিত্তি করে আমি আপনাদেরকে নবী হজরত সুলায়মান আলাইহিস সালামের সময়ের একটি ঘটনা বলতে চাই! তাকে আল্লাহ তায়ালা যেমন নবুওয়ত দান করেছিলেন, তেমনি তাকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বাদশাহিও দান করেছিলেন। নবী সুলায়মান দুনিয়ার কোনো গতানুগতিক বাদশাহ ছিলেন না। বরং সারা দুনিয়ার মাখলুকের ওপরও বাদশাহি করার শক্তি আল্লাহ তাঁকে দান করেছিলেন। বাতাসের ওপর ছিল তাঁর বাদশাহি। পানির ওপর ছিল রাজত্ব। পশু-পাখিদের ওপর ছিল কর্তৃত্ব। জিনদের ওপর ছিল নবী সুলায়মান আলাইহিস সালামের ক্ষমতা।

একদিন নবী সুলায়মান বসা ছিলেন তাঁর শাহি দরবারে। এ সময় দরবারে একটি লোক বসা ছিল। একটু পর নবী সুলায়মানের দরবারে এলো এক আগন্তুক। আগে থেকে বসা লোকটির দিকে আগন্তুক লোকটি চোখ বড় বড় করে তাকাচ্ছিল। একটু পর আগন্তুক চলে গেল। তখন আগে থেকে বসা লোকটি হজরত সুলায়মান আ.কে বললেন, হে আল্লাহর নবী! আপনাকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা অনেক ধরনের শক্তি ও ক্ষমতা প্রদান করেছেন। তিনি আপনাকে একটি সিংহাসন দিয়েছেন। সে সিংহাসনে বসে আপনি সকালবেলা রওয়ানা হয়ে সারা পৃথিবী ঘুরে চলে আসেন। আপনি দয়া করে সিংহাসনকে আদেশ করেন সে যেন বাতাসের ওপর ভর করে আমাকে পৃথিবীর শেষ প্রান্তে রেখে আসে। এ কথা বলার পর সেই লোকটি আবার নবী সুলায়মানকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর নবী! ওই লোকটি কে? যে কিছুক্ষণ আগে এসে আবার চলে গেল। নবী সুলায়মান তখন  লোকটিকে বললেন, আগন্তুক লোকটি হলেন, মৃত্যুর ফেরেশতা হজরত আজরাইল আলাইহিস সালাম। লোকটি মনে মনে কতটা ভীত হলে আবার নবী সুলায়মানকে বললেন যে, লোকটি আমার দিকে এমনভাবে তাকালো যে, দেখে আমার ভয় করছে। ভয়ে আমার লোমকূপ দাঁড়িয়ে গেছে। গলা শুকিয়ে গেছে। আমার গা কাঁপছে! আমাকে দ্রুত দুনিয়ার শেষ প্রান্তে পাঠিয়ে দেন। তখন সুলায়মান আলাইহিস সালাম লোকটির আবেদনে সাড়া দিয়ে বাতাসকে হুকুম করলেন লোকটিকে যেন দুনিয়ার শেষ প্রান্তে নিয়ে যায়।

বাতাসের বেগে লোকটি সেখানে পৌঁছে দেখে আগন্তুক লোকটি সেখানে দাঁড়িয়ে আছে, যাকে হজরত নবী সুলায়মান আ. আজরাইল বলে পরিচয় দিয়েছিলেন। তখন সে লোকটি ছদ্মবেশি আজরাইলকে বললেন, ভাই! আমি তো নবী সুলায়মানের দরবারে ছিলাম। সেখানে আপনিও এসেছিলেন। তখন আমার দিকে এমন করে তাকাচ্ছিলেন কেন? তখন মৃত্যুদূত আজরাইল আ. জবাব দিলেন, তোমার দিকে এভাবে তাকাচ্ছিলাম আশ্চর্য হয়ে যে, তোমার মৃত্যুর সময় উপস্থিত, অথচ তুমি তখনও নবী সুলায়মানের দরবারে বসে আছো। অথচ তোমার মৃত্যুর স্থান তো পৃথিবীর শেষ প্রান্তে ছিল। হাজার হাজার মাইল দূরে। কিন্তু আমি তোমার জান কবজ তো নবী সুলায়মানের দরবারে করতে পারবো না। কারণ, এখানে তো আল্লাহ তায়ালা আমাকে তোমার প্রাণ নিতে বলেননি। যেখান থেকে নিতে বলছেন সেখানে তো তুমি হাজির ছিলে না। এজন্য আমি খুব অবাক হয়ে তোমার দিকে তাকিয়েছিলাম।

হে আমার ভাইয়েরা! জন্মের পর থেকে দুনিয়ার আগের জীবনটা শুরু হয়। কিন্তু মৃত্যু কখন কোথায় কীভাবে হবে, সেটা দয়াময় আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেন না। কুরআনে কারিমে আল্লাহ পাঁচটি জিনিসের কথা বলেছেন কেয়ামত কবে হবে সেটা একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই জানেন। বৃষ্টি কবে হবে সে কথাও একমাত্র আল্লাহ তায়ালা ছাড়া কেউ আগে থেকেই বলতে পারবে না। নারীদের গর্ভে কী আছে, তা শুধু আল্লাহ তায়ালাই জানেন। কোনো অন্তর জানে না, কোনো মানুষ জানে না যে, সে আগামীকাল কী করবে। সে কোথায় মারা যাবে।

জন্মের পর থেকে মানুষের জীবন শুরু হলেও সে কখন মারা যাবে এটা কেউ জানে না। এজন্য আমাদের উচিত, আল্লাহ তায়ালাকে স্বীকার করা। যেভাবে তাঁকে স্বীকার করতে বলেছেন আল্লাহ তায়ালা সেভাবেই স্বীকার করা। কেউ যদি অন্তর দিয়ে আল্লাহর হক আদায় করার মাধ্যমে তাঁকে স্বীকার করে, তখন তাঁর জন্য আমলের সমস্ত দরজা, রাস্তা, শাখা-প্রশাখাগুলো খুলে যায়। যখন বান্দা আমল করতে থাকবে, নিখুঁতভাবে সে আমলগুলো আদায় করতে থাকবে, অর্থাৎ আল্লাহ যেভাবে চান সেভাবে আমল করতে থাকবে। তখন তাঁর জন্য আখেরাতের বন্দেগি প্রস্তুত করতে থাকবেন। যার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই, শেষ নেই।

শেখ সাদী রহ.-এর একটি কবিতার লাইন উল্লেখ করছি। যার অর্থ হলো,  দুইটি জিনিস মানুষকে প্রতিনিয়ত প্রলুব্ধ করতে থাকে। একটি হলো, তার রিজিক। রিজিক যার যেখানে আছে সে সেখানে যাবে। আরেকটা হলো, তার কবর। যেখানে তার মৃত্যু লেখা আছে, সেখানে সে যাবেই। ওই লোকটা সুলায়মান আলাইহিস সালামের কাছে সুপারিশ করে তার মৃত্যুর স্থানে ঠিক সময়েই উপস্থিত হয়ে গেছে।

হে আমার ভাইয়েরা!  কে কবে মারা যাবে এটা কেউ জানে না। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যে আমাদেরকে এ পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন, দুনিয়াতে আমরা অনেক কিছু দেখি। বিভিন্ন ধরনের মিল কারখানায় অনেক কিছু উৎপাদন হয়। কারখানা যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত প্রোডাক্টশন হতেই থাকে। কারখানার বিশেষত্ব হলো, চালু থাকলে উৎপাদন বাড়বেই। মহান আল্লাহ যে মাথা থেকে পা পর্যন্ত একটা শরীর বানিয়েছেন। আর এটাকে আমরা শরীর না বলে যদি এর অপর নাম আমরা মেশিন দিই। তাহলে বলতে হবে জন্মের পর থেকে এর উৎপাদন চলছেই। হয়তো এখানে আমরা গুনাহের প্রোডাক্টশন করছি অথবা নেকির প্রোডাক্টশন চালাচ্ছি। আর এর ধারা অব্যাহত থাকবে ততক্ষণ যতক্ষণ দেহে প্রাণ আছে। এই শরীর নামক মেশিন যদি মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের তরিকা অনুযায়ী চালু রাখা হয়, তাহলে শরীরের প্রতিটি অঙ্গের মাধ্যমে নেক উৎপাদন হতে থাকবে। আর যদি শরিয়তের বাইরে গিয়ে চালু এই মেশিন চলতে থাকে, তাহলে তো শরীরের প্রতিটি অঙ্গ থেকে গুনাহ উৎপাদন হতে থাকবে একেবারে মৃত্যু অবধি। কারখানা বন্ধ হলে যেমন উৎপাদন চালু থাকে তেমনি মানুষ নামক মেশিন বন্ধ হয়ে গেলে গুনাহ বা সাওয়াব দুটোর প্রোডাক্টশনই বন্ধ হয়ে যাবে। তখন কেউ চাইলেও আর উৎপাদন চালু করতে পারবে না।

এজন্য আমার ভাইয়েরা! সময় থাকতেই আমাদের আখেরাতের পাথেয় সংগ্রহ করতে হবে।  যেহেতু কখন কার মৃত্যু হবে কেউ জানে না। সেজন্য আমাদেরকে প্রতিটি মুহূর্তেই মহান আল্লাহকে স্মরণে রাখতে হবে। যতক্ষণ এই শরীর নামক মেশিন চালু থাকবে ততক্ষণ এর সঠিক ব্যবহার করতে হবে। তবেই আখেরাতে আমরা কল্যাণ ও পুরস্কারের ভাগিদার হবো। মহান আল্লাহ আমাদেরকে আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

ইজতেমা ময়দানে ৩ ফেব্রুয়ারি বাদ মাগরিবের বয়ান

শ্রুতিলিখন : আমিন আশরাফ


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ