২০১১ সালের ২ মে। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সেদিন ঘোষণা দেন—আল–কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেন নিহত হয়েছেন। তবে এই ঘোষণা শুধুমাত্র একটি দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। দীর্ঘ এক দশক ধরে যাঁকে খুঁজতে মরিয়া ছিল মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো, সেই ব্যক্তি ছিলেন মুসলিম বিশ্বের জন্য এক প্রতিরোধক, যিনি পশ্চিমা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের ভয়াবহ হামলার পর, তাকে ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, তবে এটি ছিল একটি ন্যায়সঙ্গত প্রতিবাদ—পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এবং মুসলিমদের অধিকার রক্ষার জন্য একটি নির্ভীক লড়াই।
‘নাইন-ইলেভেন’ নামে পরিচিত ওই ঘটনার পর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের চোখে বিশ্বের শীর্ষ সন্ত্রাসী হয়ে উঠেন, কিন্তু তাঁর অনুসারীদের জন্য তিনি ছিলেন একজন যোদ্ধা, যিনি তার ধর্ম এবং জাতির স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। পশ্চিমারা ওসামাকে সন্ত্রাসী হিসেবে দেখলেও, তাঁর চোখে এটি ছিল একটি বৈধ প্রতিরোধের অংশ—একটি অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই যা তিনি মুসলিম বিশ্বের মুক্তির জন্য চালিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, মুসলিমদের মর্যাদা রক্ষার জন্য কোনো কিছুর প্রতি সমঝোতা করা সম্ভব নয়, এবং এই পথে যে কোনো আত্মত্যাগই তাঁকে অতিক্রম করতে হবে।
তাঁর লড়াই ছিল কেবল একজন ব্যক্তির সংগ্রাম নয়; এটি ছিল একটি বৃহত্তর আদর্শের প্রতিনিধিত্ব। ওসামা বিন লাদেনের প্রতি তাঁর অনুসারীদের শ্রদ্ধা এবং বিশ্বাস শুধুমাত্র তাঁর কর্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তিনি যে নৈতিক ভিত্তি ও ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই লড়াই চালিয়েছেন, তা তাদের জন্য এক অনুপ্রেরণা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই হামলার পর সন্ত্রাসবাদ দমনের অজুহাতে যুক্তরাষ্ট্র অভিযান চালায় আফগানিস্তান ও ইরাকে। আফগানিস্তানেই দীর্ঘদিন আত্মগোপনে ছিলেন ওসামা। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদ শহরে তাঁর অবস্থান শনাক্ত করে মার্কিন সেনারা। রাজধানী ইসলামাবাদ থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরের সেই শহরে, ২০১১ সালের ২ মে রাতে অভিযান চালিয়ে তাঁকে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্রের নৌসেনার একটি বিশেষ দল।
অভিযানের বিবরণ: বাঁ চোখের ওপরে গুলি
ওই অভিযানের সূচনা হয় আফগানিস্তানের জালালাবাদ ঘাঁটি থেকে। ২ মে রাত ১১টার দিকে সেখান থেকে দুটি হেলিকপ্টারে অ্যাবোটাবাদের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় মার্কিন সেনারা। সীমান্ত অতিক্রম করে পৌঁছে যায় লাদেনের বাড়ির কাছে। এক হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হলেও অপরটি সফলভাবে আঙিনায় অবতরণ করে। সেনারা দ্রুত বাড়িতে প্রবেশ করে প্রতিটি তলা তল্লাশি করে। তৃতীয় তলায় পাওয়া যায় ওসামা বিন লাদেনকে। তাঁর বাঁ চোখের ঠিক ওপরে গুলি করা হয়। পরবর্তীতে আরও কয়েকটি গুলি চালিয়ে নিশ্চিত করা হয় তাঁর মৃত্যু।
এই পুরো অভিযান যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউস থেকে সরাসরি দেখেছিলেন প্রেসিডেন্ট ওবামা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনসহ গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা।
মুসলিম রীতি অনুযায়ী দাফন
ওসামাকে হত্যা করার পর তাঁর মরদেহ ইউএসএস কার্ল ভিনসন রণতরীতে নিয়ে যাওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তরের এক গোপন ই–মেইলের তথ্য অনুযায়ী, ইসলামি রীতি মেনে তাঁর মরদেহ গোসল করানো হয় এবং সাদা কাপড়ে মোড়ানো হয়। এরপর একটি ধর্মীয় বক্তব্য পাঠ করা হয়, যা একজন আরবি অনুবাদক দ্বারা অনূদিত হয়। শেষে মরদেহ একটি সমতল বোর্ড থেকে সাগরে ফেলে দেওয়া হয়।
তবে এরপর যখন বার্তা সংস্থা এপি তাঁর ছবি, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন, ডিএনএ পরীক্ষার ফল জানতে চায়, তখন প্রতিরক্ষা দপ্তর জানায়, এসব কিছুই তাদের হাতে নেই।
স্ত্রীকে লেখা চিঠি ও গোপন নথিপত্র
মৃত্যুর পর কয়েক বছর পেরিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালকের দপ্তর প্রকাশ করে কিছু গোপন নথি—শিরোনাম ছিল “বিন লাদেনস বুকশেলফ”। এতে দেখা যায়, ২০০৮ সালে তিনি তাঁর এক স্ত্রীকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। সেখানে মৃত্যুর পর সন্তানদের কীভাবে মানুষ করতে হবে, সেই পরামর্শ দিয়েছিলেন। মেয়েদের যেন ‘ভালো মানুষদের’ সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয় এবং ছেলেদের যেন ‘জিহাদের জন্য’ প্রস্তুত করা হয়—এমন নির্দেশনা ছিল চিঠিতে।
এ ছাড়া ওই বাড়ি থেকে উদ্ধার করা একটি ফর্মে দেখা যায়, আল–কায়েদায় যোগ দিতে ইচ্ছুকদের জন্য নানা প্রশ্ন ছিল—তাঁদের পেশা, অপরাধে জড়িত ছিলেন কি না, আত্মঘাতী হামলা করতে রাজি কি না ইত্যাদি।
বই ও চিন্তাভাবনা
ওসামা বিন লাদেনের সংগ্রহে থাকা বইগুলোর তালিকায় কিছু বিশেষ বই ছিল, যা তাঁর রাজনৈতিক দর্শন ও বিশ্বব্যাপী পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের প্রতি তীব্র অসন্তোষকে প্রতিফলিত করে। এসব বইতে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী নীতি ও তার প্রভাব নিয়ে গভীর সন্দেহ এবং প্রশ্ন তুলে ধরা হয়েছিল। ওসামা বিশ্বাস করতেন যে, পশ্চিমা শক্তিগুলো—বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র—বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে নিজের স্বার্থ হাসিল করার জন্য এক ধরনের গোপন ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে।
তাঁর সংগ্রহে ছিল জন পারকিনসের ‘Confessions of an Economic Hitman’, সিআইএর গোপন প্রকল্প MK-Ultra নিয়ে মার্কিন কংগ্রেসের শুনানির অনুলিপি, এবং ইহুদিবিরোধী হিসেবে পরিচিত ইউস্টেস মুলিনসের ‘The Secrets of the Federal Reserve’।
তাঁর কাছে নোয়াম চমস্কির লেখা ‘Necessary Illusions: Thought Control in Democratic Societies’ এবং ফ্রিৎস স্প্রিংমেয়ারের ‘Bloodlines of the Illuminati’ বইটিও পাওয়া যায়, যেখানে কথিত ইলুমিনাতি গোষ্ঠীর বিশ্ব নিয়ন্ত্রণের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
নেটফ্লিক্সে তথ্যচিত্র নিয়ে বিতর্ক
২০২৫ সালের ১০ মার্চ নেটফ্লিক্সে মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল ‘American Manhunt: Osama bin Laden’ নামের তথ্যচিত্রটি। তবে নির্ধারিত দিনে তা মুক্তি না দিয়ে জানানো হয়, "শিগগিরই আসছে"। এতে ব্যবহারকারীদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। কেউ কেউ অভিযোগ করেন, ১০ মার্চ ছিল ওসামার জন্মদিন, তাই ওই দিন তথ্যচিত্র মুক্তি দিলে তা বিতর্কিত হতে পারত। আবার অনেকে মনে করেন, মার্কিন সরকারের চাপেই তা পিছিয়ে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে জানানো হয়, তথ্যচিত্রটি ১৪ মে মুক্তি পাবে।
তথ্যসূত্র: আল–জাজিরা, এনবিসি, নিউইয়র্ক টাইমস, দ্য ইকোনমিক টাইমস
এনএইচ/