|| তাওহীদ আদনান ইয়াকুব ||
বহু বিবাহ ইস্যুটি দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। একদিকে একে নারীর প্রতি অবিচার বলে সমালোচিত করা হয়, অপরদিকে একে ইসলামের বৈধ ও সমস্যাসংশোধনমূলক বিধান হিসেবে তুলে ধরা হয়। বাস্তবতা হলো—ইসলাম এক্ষেত্রে না এর অসীম প্রচার করেছে, না সম্পূর্ণ নিষেধ হিসেবে সাব্যস্ত করেছে, বরং বহু বিবাহের ক্ষেত্রে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও প্রজ্ঞাপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছে।
কুরআন ও হাদীসের আলোকে বহু বিবাহ:
কুরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা বলেন:
“তোমরা তোমাদের পছন্দমতো নারীদের মধ্যে দু’টি, তিনটি বা চারটি বিয়ে করো। তবে যদি আশঙ্কা করো যে, তোমরা তাদের মাঝে ইনসাফ করতে পারবে না, তাহলে একজনই যথেষ্ট...” (সূরা নিসা: ৩)
এ আয়াতে বহু বিবাহের অনুমোদন দেওয়া হলেও কঠিন শর্ত হিসেবে ‘ইনসাফ’ করার বাধ্যবাধকতাও আরোপ করা হয়েছে।
নবী করীম (সা.)-এর বহু বিবাহ ছিল, কিন্তু তিনি ছিলেন ইনসাফের সর্বোচ্চ আদর্শ।
হাদীসে এসেছে, “যে ব্যক্তি একাধিক স্ত্রী রাখে এবং তাদের মধ্যে ইনসাফ করে না, কিয়ামতের দিন সে এমনভাবে উঠবে যে, তার এক পাশ ঝুলে থাকবে।” (আবু দাউদ, হাদীস: ২১৩৩)
ইসলাম বহু বিবাহকে ফরজ বা সুন্নত করেনি:
ইসলাম বহু বিবাহকে না ফরজ, না ওয়াজিব, না সুন্নত করেছে; বরং একে ‘মুবাহ’ তথা প্রয়োজনভিত্তিক একটি সমাধান হিসেবে রেখে দিয়েছে।
মুফতী তাকি উসমানী (দা. বা.) বলেন, “বহু বিবাহ ইসলামে একটি অপশন, কর্তব্য নয়। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে এই অপশনটি একটি বড় উপশম ও সামাজিক ভারসাম্যের কারণ হতে পারে।” (ফিকহুল বুয়ূ', ১/৪২১)
প্রেক্ষাপট ও প্রয়োজন বিবেচনায় বহু বিবাহ:
হযরত আবুল লাইস সামারকন্দী (রহ.) বলেন, “যেখানে সমাজে নারীর সংখ্যা পুরুষের তুলনায় বেশি, অথবা বিধবা ও তালাকপ্রাপ্তা নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়, সেখানে বহু বিবাহ সামাজিক ভারসাম্য রক্ষার শরয়ি সমাধান হতে পারে।” (তানবীহুল গাফিলীন, পৃঃ ৩৪৮)
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও, বিশেষত যুদ্ধ-পরবর্তী বা দুর্যোগকবলিত অঞ্চলে, বহু বিবাহ অনেক সময় নারীদের মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য প্রয়োজনীয় সমাধান হয়ে দাঁড়ায়।
কিছু বাস্তব যুক্তি ও প্রয়োগযোগ্য দিক:
১. নারীর নিরাপত্তা ও সম্মান: বিধবা, তালাকপ্রাপ্ত বা অসচ্ছল নারীদের জন্য বহু বিবাহ সম্মানজনক বিকল্প।
২. প্রাকৃতিক ভারসাম্য: অনেক দেশে নারীর সংখ্যা পুরুষের তুলনায় বেশি, ফলে বহু বিবাহ একটি যৌক্তিক সমাধান হতে পারে।
৩. বাধ্যতামূলক নয়: ইসলামে একাধিক বিবাহের অনুমতি থাকলেও এটি কোনোভাবেই আবশ্যিক নয়। ইনসাফের কঠিন শর্ত আরোপ করা হয়েছে।
৪. একক বিয়ের উৎসাহ: নবীজির সাহাবীগণের অধিকাংশই এক স্ত্রীতেই সন্তুষ্ট ছিলেন।
ইমাম গাযালী (রহ.) বলেন, “যার ইনসাফ করার ভয় রয়েছে, তার জন্য একটিই উত্তম।” (ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন, ২/২৩)
প্রচারণাবাজদের বিভ্রান্তি এবং তার জবাব:
বর্তমান সময়ে কিছু গোষ্ঠী বহু বিবাহের নামে এমন প্রচারণা চালায়—যেন এটি না করলে ইসলাম পূর্ণাঙ্গই হয় না। এ মনোভাব শরিয়তের সীমালঙ্ঘন এবং সমাজে অশান্তির এক মহা উৎস। এর কয়েকটি কারণ হতে পারে:
১. সুন্নাতের নামে অতিরঞ্জন: নবীজী (সা.)-এর বহু বিবাহ ছিল দাওয়াতি, রাজনৈতিক ও মানবিক উদ্দেশ্যসম্পন্ন। সাধারণ উম্মতের জন্য এটি ফরজ, ওয়াজিব বা সুন্নত করা হয়নি। মুফতী তাকি উসমানী বলেন, “নবীজীর বহু বিবাহ একাধিক হিকমতের জন্য ছিল। একে কামনা চরিতার্থের মাধ্যম বানানো শরিয়তের অপব্যবহার।” (আছারুল হাদীস, ২য় খণ্ড)
২. পারিবারিক ভাঙন ও অনর্থক সংঘাত: অপ্রয়োজনে বহু বিবাহ অনেক সময় প্রথম স্ত্রীর উপর নির্মম অবিচার সৃষ্টি করে। দাম্পত্য জীবন, সন্তানদের মনস্তত্ত্ব এবং পারিবারিক পরিবেশে তীব্র ক্ষত তৈরি হয়।
৩. ইনসাফ করতে না পারার বাস্তবতা: বহু বিবাহের দাওয়াতদাতাদের অনেকে নিজের স্ত্রীদের মধ্যে ন্যায্যতা রক্ষা করতে পারেন না। অথচ কুরআনে বলা হয়েছে,
“তোমরা নারীদের মধ্যে ইনসাফ করতে চাইলেও করতে পারবে না” (সূরা নিসা: ১২৯)
৪. রেওয়াজে পরিণত হওয়া: সমাধানমূলক একটি বিকল্পকে যদি সমাজে প্রথম পছন্দ বা আদর্শ রেওয়াজ বানানো হয়, তাহলে তা শরিয়তের উদ্দেশ্যের পরিপন্থী হয়ে দাঁড়ায়।
৫. ধর্মের নামে প্রবৃত্তির পূজা: অনেকে বহুবিবাহের ছায়ায় নিজের প্রবৃত্তির অনুগামী হন। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে: “তুমি কি এমন ব্যক্তিকে দেখেছ, যে তার প্রবৃত্তিকে উপাস্য বানিয়ে নিয়েছে?” (সূরা জাসিয়া: ২৩)
মধ্যমপন্থা কী হওয়া উচিত?
মধ্যমপন্থা হলো—
* বহু বিবাহকে শরীয়তের অনুমোদিত সমাধান হিসেবে মেনে নেওয়া, অগ্রাধিকারমূলক আদর্শ বানানো নয়।
* যেখানে প্রয়োজন, সেখানে ইনসাফের পূর্ণ শর্ত রক্ষা করে বিবেচনা করা।
* অহেতুক উগ্রতা বা হীনম্মন্যতার চেতনা পরিহার করা।
মুফতী মাহমুদুল হাসান গাঙ্গুহী (রহ.) বলেন, “একাধিক বিবাহের অনুমতি থাকলেও, কেবল সেই ব্যক্তি করুক, যার মাঝে নফস ও চরিত্র নিয়ন্ত্রণ এবং ইনসাফের বাস্তবতা আছে।” (ফতোয়ায়ে মাহমুদিয়া ৫/১৩৫)
বহু বিবাহ ইসলামি শরিয়তের বৈধ একটি সমাধান। তবে এটিকে অন্ধ অনুসরণ বা অবজ্ঞার পাত্র বানানো নয়। ব্যক্তি, সমাজ ও সময়ের বাস্তবতা, ইনসাফ এবং জবাবদিহির চেতনায় পরিচালিত হওয়াই ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে উত্তম।
ইসলাম যতটুকু অনুমতি দিয়েছে, ততটুকুই গ্রহণ করাই পরিপক্কতা। যারা অতিরঞ্জন করে প্রচার চালায়, তারা শুধু সমাজ নয়, ইসলামের ভাবমূর্তিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে।
এক স্ত্রীর সঙ্গে সুখী ও ইনসাফপূর্ণ জীবন অতিবাহিত করাও রাসূলুল্লাহ (সা.)-এরই একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত।
তাই বহু বিবাহ নিয়ে উগ্রতা ও বিভ্রান্তিমূলক প্রচারের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান নেওয়া জরুরি।
লেখক: ফাযেল, দারুল উলুম দেওবন্দ ও নদওয়াতুল উলামা লাখনৌ
মুফতী ও মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া আহলিয়া নশাসন, শরীয়তপুর
এমএইচ/