জুমার দিন মুসলমানদের জন্য একটি বড় নিয়ামত। এ দিনটি গরিব মুসল্লিদের হজের দিন। এ দিন প্রতিটি ঈমানদারের সামনে হাজির হয় অফুরন্ত কল্যাণ ও সৌভাগ্যের বার্তা নিয়ে। সপ্তাহের এই দিনে জোহরের ওয়াক্তে জুমার নামাজ জামাতের সঙ্গে পড়া ফরজ। জুমার নামাজ নিজ গৃহে একাকী পড়া যায় না। এই নামাজ ইমামসহ আরো তিন বা এর বেশি মুসল্লি মিলে মসজিদে জামাতে আদায় করতে হয়।
রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, ‘দিবসসমূহের মধ্যে জুমার দিন শ্রেষ্ঠ এবং তা আল্লাহর কাছে অধিক সম্মানিত।’ (ইবনে মাজাহ: ১০৮৪)।
হাদিসে আরও বর্ণিত হয়েছে, ‘সূর্য উদিত হওয়ার দিনগুলোর মধ্যে জুমার দিন সর্বোত্তম। এই দিনে আদম আ.-কে সৃষ্টি করা হয়েছে। এই দিনে তাঁকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়েছে এবং এই দিনে তাঁকে জান্নাত থেকে বের করা হয়েছে।’ (মুসলিম: ৮৫৪)
জুমার দিনে করণীয়
জুমার দিনে মহানবী সা.-এর নির্দেশনা অনুযায়ী মুসলিম উম্মাহর করণীয় বিশেষ কিছু আমল রয়েছে। যেমন-
১. ফজরের নামাজে সুরা সিজদা ও ইনসান তেলাওয়াত
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সা. শুক্রবার ফজরের নামাজে সুরা আস-সিজদা এবং সুরা আল-ইনসান তিলাওয়াত করতেন। (সহিহ বুখারি: ১০৬৮)
২. বেশি পরিমাণে দরুদ পড়া
রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, তোমরা জুমার দিন আমার ওপর বেশি বেশি দরুদ পাঠ করো। কেননা তোমাদের পাঠকৃত দরুদ আমার সামনে পেশ করা হয়। (আবু দাউদ: ১০৪৭)
৩. জুমার নামাজ আদায়
ইসলামের যেসব ফরজ বিধান আছে, এর মধ্যে বেশি গুরুত্বপূর্ণ জুমার নামাজ। যারা জুমার নামাজকে অলসতা কিংবা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে ছেড়ে দেয়, তাদের হৃদয়ে আল্লাহ তাআলা মোহর মেরে দেন। রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘যদি মানুষ জুমার সালাত পরিত্যাগ করা থেকে বিরত না থাকে তাহলে আল্লাহ তাদের অন্তরে মোহর মেরে দেবেন, যার ফলে তারা অলস ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত হবে।’ (সুনানে দারামি: ১৫২৪)
৪. গোসল করা
জুমার দিনে বিশেষভাবে গোসল করার তাগিদ এসেছে হাদিসে। সালিম রহ. থেকে তাঁর পিতার সূত্র থেকে বর্ণিত, তিনি নবী সা.-কে বলতে শুনেছেন, যে ব্যক্তি জুমার নামাজে আসে সে যেন গোসল করে আসে। (জামে তিরমিজি: ৪৯২)
৫. সম্ভব হলে সুগন্ধি ব্যবহার করা
অন্য দিনের চেয়ে এদিন বেশি সুগন্ধি ব্যবহার করা উত্তম। আবু সাইদ খুদরি রা. বলেন, আমি এ মর্মে সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহর রাসুল সা. বলেছেন, জুমার দিন সুগন্ধি পাওয়া গেলে তা ব্যবহার করবে। (সহিহ বুখারি: ৮৮০)
৬. মেসওয়াক করা
রাসুলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেছেন, জুমার দিন প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির গোসল ও মেসওয়াক করা কর্তব্য এবং সামর্থ্য অনুযায়ী সে সুগন্ধিও ব্যবহার করবে। (সহিহ মুসলিম: ১৮৪৫)
৭. জিকির করা
ইমাম জুমার নামাজে আসার পূর্ব পর্যন্ত নামাজ, জিকির ও তেলাওয়াতে রত থাকা। জুমার দিনে যত বেশি সম্ভব আল্লাহর জিকির করা বাঞ্ছনীয়। কৃরআনুল কারিমে ইরশাদ হয়েছে- ‘হে বিশ্বাসীগণ! জুমার দিনে যখন নামাজের জন্য আহবান করা হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের জন্য দ্রুত ধাবিত হও এবং ক্রয়-বিক্রয় ত্যাগ কর। এটাই তোমাদের জন্য শ্রেয়, যদি তোমরা উপলব্ধি কর।’ (সুরা জুমা: ৯)
৮. খুতবার সময় চুপ থাকা
খুতবার সময় সম্পূর্ণ চুপ থাকা। এটি ওয়াজিব। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী সা. বলেন, যে ব্যক্তি জুমার দিন ইমামের খুতবা দেওয়ার সময় তার সঙ্গীকে বলল, ‘চুপ থাকো’ সে একটি অনর্থক কাজ করল। (সুনানে নাসায়ি: ১৪০১)
৯. সুরা কাহাফ পড়া
আবু সাঈদ খুদরি রা. থেকে বর্ণিত, নবী সা. বলেন, ‘যে ব্যক্তি জুমার দিন সুরা কাহাফ পাঠ করবে তার জন্য দুই জুমার মধ্যবর্তীকাল জ্যোতির্ময় হবে।’ (আত-তারগিব: ৭৩৫)
১০. জুমার নামাজে সুরা আলা, সুরা জুমা ও গাশিয়াহ পড়া
নুমান ইবনে বশির রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সা. দুই ঈদের নামাজে ও জুমার নামাজে ‘সাব্বিহিসমা রব্বিকাল আলা-’ ও ‘হাল আতা-কা হাদিসুল গা-শিয়াহ’ সুরাদ্বয় পাঠ করতেন। (সহিহ মুসলিম: ১৯১৩)
কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে, রাসুল সা. সুরা জুমা ও সুরা আলা তেলাওয়াত করতেন।
১১. পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর কাপড় পরিধান করা
আবু জার রা. থেকে বর্ণিত, নবী সা. বলেন, যে ব্যক্তি জুমার দিন উত্তমরূপে গোসল করে, উত্তমরূপে পবিত্রতা অর্জন করে, তার উৎকৃষ্ট পোশাক পরিধান করে এবং আল্লাহ তার পরিবারের জন্য যে সুগন্ধির ব্যবস্থা করেছেন, তা শরীরে লাগায়, এরপর জুমার সালাতে এসে অনর্থক আচরণ না করে এবং দুজনের মাঝে ফাঁক করে অগ্রসর না হয়, তার এক জুমা থেকে পরবর্তী জুমার মধ্যবর্তী সময়ের গুনাহ ক্ষমা করা হয়। (সুনানে ইবনে মাজা: ১০৯৭)
১২. মসজিদে সুগন্ধি লাগানো
ওমর রা. জুমার দিন দ্বিপ্রহরে মসজিদে সুগন্ধি লাগানোর জন্য আদেশ করেছেন। এছাড়াও যেকোনো সময় মসজিদে সুগন্ধি লাগানো উচিত। রাসুলুল্লাহ সা. পাড়ায় পাড়ায় মাসজিদ নির্মাণ করতে, তা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে এবং সুবাসিত করতে হুকুম দিয়েছেন। (ইবনু মাজাহ: ৭৫৯)
১৩. ইস্তেগফার করা ও কথা না বলা
এদিন মহান রবের পক্ষে গুনাহ মাফের বারি বর্ষিত হয়। নবী সা. বলেছেন, কোনো মুসলিম যদি পবিত্র হয়ে জামে মসজিদের দিকে হাঁটতে থাকে, এরপর ইমাম নামাজ শেষ করা পর্যন্ত নীরব থাকে, তাহলে এ নামাজ এই জুমা থেকে পরবর্তী জুমা পর্যন্ত তার গুনাহের কাফফারা (মোচনকারী) হয়ে যাবে, যদি ধ্বংসকারী তথা কবিরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকে। (মুসনাদে আহমদ: ২৩৭২৯)
১৪. আছরের সময়টি দোয়ায় অতিবাহিত করা
জুমার দিন বিশেষ সময়ে দোয়া কবুল হয়। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী সা. বলেন, জুমার দিনের মধ্যে অবশ্যই এমন একটি মুহূর্ত আছে, যখন কোনো মুসলিম আল্লাহর কাছে কল্যাণ প্রার্থনা করে নিশ্চয়ই তিনি তাকে তা দান করেন। তিনি বলেন, সে মুহূর্তটি অতি স্বল্প। (সহিহ মুসলিম: ১৮৫৮)
বেশির ভাগের মতে, সে সময়টি আছরের পর থেকে নিয়ে মাগরিবের আগ মুহূর্ত। জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল সা. বলেন, ‘জুমার দিনের বারো ঘণ্টার মধ্যে এমন একটি মুহূর্ত রয়েছে যদি কোনো মুসলিম এ সময়ে আল্লাহর কাছে কিছু প্রার্থনা করে, তাহলে মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাকে দান করেন। এ মুহূর্তটি তোমরা আসরের শেষ সময়ে অনুসন্ধান করো।’ (আবু দাউদ: ১০৪৮)
১৫. কবর আজাব থেকে মুক্তির দোয়া করা
জুমার দিন কবরের আজাব মাফ হয়ে যায়। আবু কাতাদাহ রা. থেকে বর্ণিত, নবী সা. জুমার দিন ছাড়া (অন্য দিন) ঠিক দুপুরে নামাজ আদায় করা অপছন্দ করতেন। তিনি বলেছেন, জুমার দিন ছাড়া (অন্যান্য দিনে) জাহান্নামের আগুনকে উত্তপ্ত করা হয়। (আবু দাউদ: ১০৮৩)
জুমার দিনে বা রাতে যে মারা যাবে, তার থেকে কবরের আজাব উঠিয়ে নেওয়া হবে এটা এই হাদিস থেকে প্রমাণিত। তবে কেয়ামত পর্যন্ত আজাব দেওয়া হবে না এটা নিশ্চিত নয়।
জুমার দিনে বর্জনীয়
১. পরিপাটি না হয়ে জুমায় যাওয়া
অনেকে জুমার দিনে পরিচ্ছন্ন হওয়াকে তেমন গুরুত্ব দেন না। অথচ, জুমার নামাজে যাওয়ার আগে গোসল করা, পরিপাটি হয়ে মসজিদে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ নেক আমল। প্রিয়নবী সা. সাহাবায়ে কেরামকে জুমার দিন গোসলের ব্যাপারে বিশেষ তাগিদ দিয়েছেন। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, সালমান ফারসি রা. থেকে বর্ণিত, নবী সা. বলছেন, যে ব্যক্তি জুমার দিন গোসল করে, যথাসাধ্য উত্তমরূপে পবিত্রতা অর্জন করে এবং নিজের তেল থেকে ব্যবহার করে বা নিজ ঘরের সুগন্ধি ব্যবহার করে, অতঃপর বের হয় এবং দুজন লোকের মধ্যে ফাঁক না করে (অর্থাৎ পরে গিয়ে মানুষের ঘাড় টপকে সামনে যাওয়ার চেষ্টা না করে), অতঃপর তার নির্ধারিত নামাজ আদায় করে এবং ইমামের খুতবা দেওয়ার সময় চুপ থাকে, তা হলে তার সে জুমা থেকে আরেক জুমা পর্যন্ত সময়ের সব গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। (বুখারি: ৮৮৩)
উল্লেখিত হাদিসে জুমার দিন উত্তমরূপে গোসল করার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। তাই উচিত হলো- জুমার দিন উত্তমরূপে গোসল করা ও পরিচ্ছন্ন হওয়া। যদি সামর্থ্য থাকে, সুগন্ধি ব্যবহার করা। এছাড়াও ভালো জামা পড়ে মসজিদে যাওয়া। রাসুল সা. নিজেও এই দিন ভালো ও পরিচ্ছন্ন পোশাক পরতেন।
২. মসজিদে দেরি করে যাওয়া
জুমার দিন একটু আগেভাগে মসজিদে যাওয়া উচিত। জুমার খুতবা শোনাও জরুরি। হজরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুল স. বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি জুমার দিন জানাবাত (সহবাস পরবর্তীকালে) গোসলের মতো গোসল করে এবং নামাজের জন্য আগমন করে, সে যেন একটি উট কুরবানি করল। যে ব্যক্তি দ্বিতীয় পর্যায়ে আগমন করে, সে যেন একটি গাভী কুরবানি করল। তৃতীয় পর্যায়ে যে আগমন করে, সে যেন একটি শিং-বিশিষ্ট দুম্বা কোরবানি করলো। চতুর্থ পর্যায়ে যে আগমন করলো সে যেন একটি মুরগি কোরবানি করল। পঞ্চম পর্যায়ে যে আগমন করলো, সে যেন একটি ডিম কোরবানি করল। (বুখারি: ৮৮১)
তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মসজিদের দিকে রওনা করা জরুরি।
৩. জুমার সময় অন্য কাজ করা
জুমার নামাজের সময় অন্য কাজ করা নিষিদ্ধ। জুমার প্রথম আজান শোনার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসা কিংবা অন্য কাজে বিরতি দেওয়া উচিত। ইয়াহইয়া ইবনু সাইদ রহ. থেকে বর্ণিত, আয়েশা রা. বলেছেন—লোকজন নিজেদের কাজকর্ম নিজেরাই করতেন। যখন তারা দুপুরের পরে জুমার জন্য যেতেন, তখন সে অবস্থায়ই চলে যেতেন। তাই তাদের বলা হলো, যদি তোমরা গোসল করে নিতে ভালো হতো..। (বুখারি: ৯০৩; মুসলিম: ৮৪৭)
৪. মনোযোগ দিয়ে খুতবা না শোনা
খুতবা শোনা জুমার নামাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং ঠিকভাবে খুতবা শোনা জরুরি। তবে যদি মুসল্লি বেশি হওয়ার কারণে অথবা অন্যকোনো কারণে খুতবার আওয়াজ না শোনা যায়, তবে নীরব থাকাই নিয়ম। হজরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ সা. বলেন—‘যে ব্যক্তি উত্তমভাবে অজু করে জুমার নামাজে এলো, নীরবে মনোযোগ দিয়ে খুতবা শুনল, তাহলে পরবর্তী জুমা পর্যন্ত এবং আরও অতিরিক্ত তিন দিনের গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়। আর যে ব্যক্তি (অহেতুক) কঙ্কর স্পর্শ করলো, সে অনর্থক, বাতিল, ঘৃণিত ও প্রত্যাখ্যানযোগ্য কাজ করলো। (মুসলিম: ১৮৭৩)
৫. খুতবার সময় কথা বলা
জুমার খুতবা শোনা শুধু সওয়াবের কাজ না, এটি ওয়াজিব। তাই খুতবার সময় কোনো কথা বলা যাবে না। এমনকি কাউকে চুপ থাকতে বলাও নিষেধ। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুল সা. বলেছেন—‘জুমার দিন যখন তোমার পাশের মুসল্লিকে চুপ থাকো বলবে, অথচ ইমাম খুতবা দিচ্ছেন, তা হলে তুমি একটি অনর্থক কথা বললে’ (বুখারি: ৯৩৪, মুসলিম: ৮৫১)। তার মানে হলো, খুতবার সময় মুখ পুরোপুরি বন্ধ রাখা চাই।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের আমল করনার তাওফিক দান করুন।
এনএ/