|| মাওলানা শিব্বীর আহমাদ ||
হযরত ফকীহুল মিল্লাত মুফতি আব্দুর রহমান রহ. এমন একজন ব্যক্তি ছিলেন, যিনি প্রায় সব অঙ্গনেই কাজ করেছেন। তবে এদেশে নাহু-সরফ প্রশিক্ষণে তার ভূমিকা অনন্য। তার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল পটিয়া মাদরাসায়। আমাকে হাজী সাহেব হুজুর রহ. সেখানে প্রশিক্ষক হিসেবে ডাকলে আমি সেখানে যাই। দেখা হয় মুফতি সাহেবের সঙ্গে। বিভিন্ন বিষয়ে তার সঙ্গে কথা হয়। বিভিন্ন আলোচনায় অনেকটা বুঝতে পেরেছিলাম তিনি একজন প্রাজ্ঞ ব্যক্তি। একবার বসুন্ধরা মাদরাসার দস্তারবন্দী মাহফিলে আমি উপস্থি হয়েছিলাম। তিনি আমাকে এতোটাই সম্মান করেছিলেন যে, আমাকে দিয়ে ছাত্রদের মাথায় পাগড়ি বাঁধিয়ে ছিলেন। তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল আত্মিক। তার মৃত্যু অবদি এই সম্পর্ক অটুট ছিল। তিনি যখন শয্যাশায়ী; তখন তাকে দেখার জন্য একবার বসুন্ধরা মাদরাসায় যাই। আমাকে দেখে তিনি বিভিন্ন বিষয়ে জানতে চাইলেন। এছাড়া তিনি আমাকে বললেন, অসুস্থ ব্যক্তির খবরাখবর নিতে যাওয়ার সাওয়াব সম্পর্কে। তার কথাগুলো শুনে খুব অবাক হচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল নতুন করে যেন অনেককিছু জানছি। যদিও সেগুলো আমার আগে থেকে জানা ছিল। তার কথায় সত্যিই ভিন্ন এক প্রভাব ছিল।
তিনি পটিয়া মাদরাসা থেকে চলে আসার পর যখন রাজধানীর উত্তরার জসীমুদ্দীন রোডে ছোট্ট আকারে গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান শুরু করেন; তখন তিনি আমাকে এক রমজানে ডেকে পাঠান। আমি আসি। তিনি আমাকে বলেন, ইফতা বিভাগের ছাত্র ও শিক্ষকদেরকে প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য। সে রমজানে সেখানে প্রশিক্ষণ দিই। এরপর জসিমুদ্দীন রোড থেকে মারকাযুল ফিকরিল ইসলামী যখন রাজধানীর আবাসিক এলাকা বসুন্ধরায় স্থানান্তর হয় তখন হযরত মুফতি সাহেব রহ. প্রতি রমজানে নাহু সরফের তাদরিবের আয়োজন করতেন। আর আমাকে সেখানে প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য ডাকতেন। আসলে তিনি নিজেও একজন নাহুর প্রশিক্ষক ছিলেন এবং যারা এটি নিয়ে কাজ করে তাদেরও তিনি যথেষ্ট মূল্যায়ন করতেন। আহলে ইলেমের কদর তার চরিত্রের অনন্য একটি বৈশিষ্ট্য। তার কাছে কোনো আলেম কখনো মেহমান হলে তাকে মনখুলে মেহমানদারী করতেন। তার দিল ছিল অনেক বড়। তার মনের মাধুরী মিশিয়ে গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠান থেকেও পরিস্থিতির শিকার হয়ে তাকে চলে আসতে হয়েছিল। কিন্তু আমার জানামতে কোনোদিন কখনো তিনি যাদের কারণে চলে আসতে হয়েছে তাদের সমালোচনা করেননি। এমনকি তাদেরকে তিনি বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করতেন। শুনেছি, চট্টগ্রামের বেশকিছু মাহফিলে হযরত মুফতি সাহেব রহ.কে নিয়ে নাম ধরে সমালোচনা করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি তার দীর্ঘ জীবনে কখনো তাদের কোনো সমালোচনা করেননি। এমনকি তার কাছের কেউ তার কাছে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাইলে সঙ্গে সঙ্গে চুপ করিয়ে দিতেন।
আসলে তার মধ্যে আকাবিরদের অনেক বৈশিষ্ট্য বিদ্যামান ছিল। তিনি সবসময় সুন্নত মোতাবেক চলতেন এবং সবাইকে সে অনুযায়ী চলার কথা বলতেন। তাযকিয়ার লাইনে মেহনত করতেন। নিজের মুরব্বী ও সমবয়সীদের যথার্থ সম্মান করতেন। আপন শাগরেদদের যথাযথ মূল্যায়ন করতেন। বিপদগ্রস্তদের পাশে দাঁড়াতেন। দ্বীনের স্বার্থে নিজের সবকিছু জলাজ¦লি দিতেন। দ্বীন সব জায়গায় প্রাধান্য দিতেন। ফেরাকে বাতেলার সঙ্গে তিনি কখনো আপোষ করতেন না।
আল জামিয়াতুল ইসলামিয়া মাইজদী, নোয়াখালী (আল আমিন মাদ্রাসা) একসময় আমরা পরিচালনা করেছি। অনেক চেষ্টা করছি লেখাপড়া ও সার্বিক বিষয় উন্নত করার জন্য। কিন্তু শত চেষ্টার পরও প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের মন মতো তেমন কোনো উন্নতি করতে পারছিলাম না। তবে হযরত মুফতি সাহেব রহ. এর হাতে যখন আল আমিন মাদরাসা গেল; তখন থেকে মাদরাসার সার্বিক বিষয়ে উন্নতি হতে লাগলো। ছাত্রদের লেখাপড়া হালত পাল্টে গেল। সবার আমল-আখলাক চলে ফেরায় ব্যাপক উন্নতি হয়। বলা যায়, মাদরাসার রূপ-ই পাল্টে যায়। তাছাড়া শুধু এই মাদরাসা নয়। নোয়াখালী এলাকার মাদরাসাগুলোর সার্বিক উন্নয়নে হযরত মুফতি সাহেব রহ. এর ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। এখানের অনেক প্রাণহীন মাদরাসায় তিনি সজিবতা ফিরিয়ে এনেছেন। তিনি যখন আল আমীন মাদরাসায় আসতেন তখন এই অঞ্চলের প্রায় সব ওলামায়ে কেরাম আসতেন। তাদের হালত শুনে তিনি তাদেরকে সার্বিক সহযোগিতা করতেন। আর্থিকভাবে অনেক সাহায্য করতেন । তাছাড়া তিনি নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর জেলার কওমি মাদরাসা ওলামায়ে কেরামকে একত্রিত করার জন্য গঠন করেন, ‘জমিয়তে মাদারিসিল কওমিয়া নোয়াখালী-লক্ষ্মীপুর’। সময়ের ব্যবধানে এই সংগঠন উক্ত অঞ্চলে ওলামায়ে কেরামকে অনেক ঝড়-ঝাপ্টা থেকে নিরাপদ রেখেছে। এভাবে তার সুনিপুন চিন্তাধারায় সুফল আজও এদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ পেয়ে যাচ্ছেন। আল্লাহ তার কবরকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসিব করুন। আমিন।
লেখক- প্রধান প্রশিক্ষক, বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ। শাইখুল হাদিস, জামিয়া ইসলামিয়া চরমটুয়া, সদর নোয়াখালী।
হাআমা/