|| মাওলানা আস'আদ আল হুসাইনী ||
আজ থেকে প্রায় ত্রিশ বছর পূর্বের কথা। আমি ফরিদাবাদ মাদরাসার একজন ছাত্র। ১৯৭৫ইং সাল থেকেই সেখানে আমার পদচারণা। তখন থেকে ফরিদাবাদের মাটি ও মানুষের সাথে আমার পরিচয়। সঙ্গীহীন একা আমার কালের খেয়া বহমান স্রোতে চলতে থাকে। ১৯৭৭ইং সালে আমি কাফিয়া জামায়াতে পড়ি।
এ বছরই গ্রাম থেকে একজন চতুর বালক হেদায়াতুন্নাহু জামায়াতে ভর্তি হয়। নাম মোহাম্মদ ইসহাক। পড়ালেখা আর কিতাব ছাড়া তিনি আর কিছুই বুঝেন না। স্বাভাবিক চলাফেরা। মনমুগ্ধকর আচরণ যা ক্রমেই আমার মাঝে প্রভাব ফেলতে শুরু করল। অপর দিকে গ্রাম থেকে আসা এই জীর্ণশীর্ণ দেহের অধিকারী ছেলেটি হেদায়াতুন্নাহু জামায়াতের প্রথম নাম্বার ছাত্র।
আমি কাফিয়াতে প্রথম। দু'জনের মাঝেই বিভিন্ন মতামত এবং চিন্তা-চেতনায় মিল থাকায় অধিকন্তু আদর্শ ছাত্রের সার্বিক গুণাবলী তার মাঝে বিদ্যমান থাকায় দু'মনের মাঝে একটি সেতু বন্ধন গড়ে উঠে। তাছাড়া তখনকার সময়ে ফরিদাবাদ মাদরাসায় শেরের বাহাস ছিল খুবই মজার পর্ব। ছাত্রদের মাঝে যেমন প্রেরণা, উদ্দীপনা ছিল, তেমনি উস্তাদদের মাঝেও মেহনত ও চেষ্টা-প্রচেষ্টা ছিল।
ছাত্রকাল থেকে শেরের এর প্রতি আলাদা একটি প্রতিভা আমার মাঝে কাজ করত। আলহামদুলিল্লাহ শের রচনা, গাওয়া তখন থেকেই অভ্যাস। মাওলানা ইসহাক ফরিদী রহ. ছিলেন অসাধারণ জ্ঞান পিপাসু! বুদ্ধিমানের কাজই হলো সংগ্রহ। তিনি আমার কাছে শের, বিভিন্ন কবিতা, ছন্দ জিজ্ঞাসা করতেন। জেনে নিতেন। রাত কে রাত চলত এই শের এর বহছ।
একদিকে ইসহাক সাহেব অপরদিকে আমি। সাথে মাওলানা ইউনুস, মাওলানা আবু সাঈদ সাহেব (মুহাদ্দিস ফরিদাবাদ মাদরাসা)। মাওলানা ইসহাক ফরিদী রহ.-এর সুললিত কণ্ঠ না থাকলেও অগ্নি মেধার ফলে বড় বড় কঠিন কঠিন শের নির্বিঘ্নে বলে ফেলতেন। বেশ আনন্দচিত্বেই দু'হৃদয়ের তরী চলতে থাকে। গড়ে উঠতে থাকে দু'মনের শক্তিশালী সেতু বন্ধন। যেমন তার সুন্দর ব্যবহার তেমনি তার মেধাবী প্রশংসার জোয়ার।
কারণ, ফরিদাবাদ মাদরাসায় নাম্বারে আউয়াল হওয়া তখনকার সময়ের জন্য চাট্টিখানি ব্যাপার ছিল না। দুধ কলা আর পান্তা ভাতও নয়; বরং বিরাট এক ব্যাপার-সেপার। যা তীক্ষ্ণ ও প্রখর মেধার পরিচায়ক। তখন ফরিদাবাদের মুহতারাম আসাতিযায়ে কিরাম ছিলেন যুগের অদ্বিতীয়। যাদের তুলনা দুষ্কর। মাওলানা আব্দুল হাফিয রহ., মাওলানা বশীর আহমদ রহ., আল্লামা ফরিদ উদ্দীন মাসউদ, মুফতি আব্দুল হান্নান, মাওলানা নূর হুসাইন কাসেমী, মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক বিশেষভাবে উল্লেখ্যযোগ্য। যেমন তাঁদের ইলমের গভীরতা, তেমনি ছাত্র গড়ার এক প্রানান্তকর প্রচেষ্টা।
হকের পতাকাবাহী একদল আন্দোলনী সিপাহসালার ও দ্বীনের প্রতিটি ক্ষেত্রে জানবাজ যোদ্ধা তৈরির লক্ষ্যে উস্তাদুল আসাতিযা, হৃদয়ের মধ্যমণি আল্লামা ফরিদ উদ্দীন মাসউদ লাজনাতুত্তালাবা নামে একটি আদর্শ ছাত্র সংগঠন গড়ে তোলেন। সেই বাগানেরই অন্যতম সার্থক সন্তান মাওলানা ইসহাক ফরিদী রহ.। মাওলানাকে আমি লাজনার জন্য প্রাণ উজাড় করে কাজ করতে দেখেছি। নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করেও ফরিদ সাহেব হুজুরের অঙ্গুলী ইশারাকে তিনি আদেশতুল্য মনে করতেন। লাজনার জন্য নিজ পকেটের টাকা, বাড়ি থেকে আনা নাস্তার পয়সা ব্যয় করেও লাজনাকে সহায়তা করেছেন।
বিশেষ প্রয়োজনে জামা-কাপড় ও কিতাব পত্র বিক্রি করে লাজনাকে আর্থিক সহায়তা করেছেন। টাকার দৈন্যতার দরুণ আটা-ময়দা কিনে নিজ হাতেই রুটি তৈরী করে সাথীদের সামনে উপস্থিত করতেন।
বহু সময় নিজে না খেয়ে হলেও লাজনার সাথী-সঙ্গীদের খাইয়েছেন। তাদের মনকে খুশী রেখেছেন। পায়ে হেঁটে বহু পথ চলে লাজনার মিটিং মিছিলে যোগদান করেছেন। এই বিরামহীন একনিষ্ঠ মুখলিস বান্দার শুধু ধর্মীয় স্বার্থই সামনে ছিল। ক্ষমতার লোভ বা নেতৃত্ব প্রদান মোটেও তাকে কাবু করতে পারেনি। ক্ষমতার ললাটে লাথি মেরে জীবনের সবটুকু শ্রম এ পথে ব্যয় করেছেন।
যার ফলে বাংলাদেশের আনাচে কানাচে এই লাজনার নাম ও শুহরত ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু এই উদ্দীপনা আর প্রেরণার উৎস মূল কোথায়? কে দিয়েছেন তাঁর মাঝে এই প্রতিভার পাহাড়? কে তাঁর এই সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটানোর পথ সুগম করে দিয়েছেন? নিশ্চয় এর পিছনে কোন সত্তার হাত রয়েছে। কারণ মানুষ নিজে নিজে এত বড় হতে পারে না।
ফরিদ সাহেব হুজুর নিজে অতি শ্রম দিয়ে ইসহাক ফরিদীকে ইসহাক ফরিদী বানিয়েছেন। ইসহাক সাহেব নিজেই বলতেন, যা বলতে পারি যা লিখতে পারি সবই ফরিদ সাহেব ও নূর হুসাইন কাসেমীসহ সব হুজুরদের অবদান।
ইসহাক ফরিদীর প্রতিটি শীরায় শীরায় রন্ধ্রে রন্ধ্রে ফরিদ সাহেব হুজুরের অবদান চির বহমান। যার ফলে ইসহাক সাহেব অতি আপন করে, মায়া করে পরম শ্রদ্ধাভাজন উস্তাদ আল্লামা ফরিদ উদ্দীন মাসউদের স্বীয় নামাংশ ফরিদকে নিজের নামের সাথে যুক্ত করে নিজে ফরিদী হন।
আমরা তখনও ফরিদাবাদ মাদরাসায় পড়ছি। ইসহাক সাহেব হেদায়া জামায়াতে আমি জালালাইন জামায়াতে। এ বছরই ফরিদাবাদের উস্তাদদের মাঝে আভ্যন্তরীণ একটি ইখতিলাফ দেখা দেয়। মনের গতিতে পরিবর্তন আসে ছাত্রদের। পরবর্তী বছর আল্লামা ফরিদ উদ্দীন মাসউদ, নূর হুসাইন কাসেমীসহ আরো কয়েকজন বিজ্ঞ উস্তাদ সেখান থেকে বেরিয়ে পড়েন।
মন মানল না তার ভক্ত অনুরক্তদের সাথে সাথে মাওলানা ইসহাক ফরিদীসহ আমরা বিশ-পঁচিশজন চলে আসি। ঢাকার শামীবাগ ভাঙ্গাবাড়ীর হাজী আব্দুর রাজ্জাক সাহেবের বাড়ীতে আশ্রয় মিলে। শুরু হলো কষ্টের জীবন। দুঃখের পালা। ঘুমানোর জায়গা নেই। খাবার দাবারের তেমন কোন ব্যবস্থা নেই, সামানপত্র আর সম্বলহীন এক করুন অবস্থা। অসহায় হয়ে পড়ে আছি; কিন্তু পড়ালেখার মোটেও ঘাটতি নেই। পুরো উদ্যোমের সাথেই চলছে।
আমার এখনও চোখে ভাসছে যখন মাওলানা ইসহাক সাহেবের সঙ্গে এই শামীবাগ থেকে কিতাব নিয়ে সূদুর বায়তুল মোকাররমের ইসলামিক ফাউন্ডেশন অফিসে যেতাম। সেখানে বসে উস্তাদে মুহতারাম আল্লামা ফরিদ উদ্দীন মাসউদ দরস দিতেন। মেশকাত শরীফের কি মজার তাকরীর!
মাওলানা সে বছরই জালালাই জামায়াত বাদ দিয়ে মেশকাত জামায়াতে আমাদের সাথে মিলিত হন। তখনকার সময়ে ফরিদাবাদ মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা ইসমাইল রহ. তিনি আব্বার খলীফা। সে হিসাবে তিনি শত পীড়াপিড়ি করেছেন আমাকে ফরিদাবাদ মাদরাসায় ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য। কিন্তু না! হুজুরদের প্রতি অগাধ ভালবাসা আর ছাত্র ভাইদের সাথে হৃদ্যতা আর গভীর সম্পর্ক আমাকে ভাঙ্গাবাড়ী ছেড়ে যেতে দেয়নি।
দিন শেষে রাত আর রাত শেষে দিন। কালের চাকা ঘুরতে ঘুরতে কষ্টের এই দিনগুলো শেষ হতে থাকে। বছর প্রায় শেষ। সেই হেদায়াতুন্নাহু থেকে মেশকাত পর্যন্ত থাকা, খাওয়া, চলা-ফেরা হাসি- কৌতুক, দুষ্টুমীর সাথী। কিন্তু কখনও দু'মনের মাঝে কোন দূরত্ব অনুভব হয়নি। বন্ধুত্ব আর মুহব্বতের সেতু ক্রমেই শক্তিশালী হয়েছে। কিন্তু এখন বিচ্ছেদের সময় ঘনিয়ে এসেছে। ছাত্রবন্ধু ইসহাককে ছেড়ে আসাতিযায়ে কিরামকে হারানোর সময় ঘনিয়ে এলো।
দেওবন্দ যাওয়ার তীব্র ইচ্ছা আমাকে ব্যাকুল করে তুলল। হৃদয়ের টানে দাওরায়ে হাদিস পড়ার উদ্দেশ্যে আমি ভারত উপমহাদেশের শ্রেষ্ট বিদ্যাপীঠ দারুল উলুম দেওবন্দে চলে যাই। আর মাওলানা ইসহাক ফরিদী মালিবাগ জামিয়ায় ভর্তি হন। তখন মালিবাগের শায়খুল হাদিস কাজী মু'তাসিম বিল্লাহ সাহেব। আল্লামা ফরিদ উদ্দীন মাসউদ ও সেখানে আছেন। মালিবাগ জামিয়ার সকল উস্তাদ মাওলানাকে গড়তে লাগলেন। দ্বীনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যোগ্য ও প্রজ্ঞাবান করে তোলার জন্য কাছে ডেকে নিতেন। লিখতে, পড়তে, মুতালা'আ করতে সর্বদা উৎসাহিত করতেন।
হুজুরদের রহমতের ছায়ায় একান্ত সান্নিধ্যে মাওলানা এক যোগ্য আলিম হিসাবে গড়ে উঠেন। দেওবন্দের একটি বছর মাওলানাকে দূরে রেখেই আমার অতিবাহিত হয়। পরের বছরের শুরুতেই মালিবাগে লাজনাতুত্তালাবার এক মহা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে এসে আবার সেই মনের হারানো মানুষকে খুঁজে পাই। প্রাণপ্রিয় বন্ধুকে পেয়ে এক আনন্দরাজ্যে বাস করি। শত গুণে বেড়ে যায় চোখের দ্বীপ্তি। কারণ, কথায় আছে বন্ধুর দর্শন চোখের জ্যোতি। খুশিতে মনটা ভরে যায়। আনন্দ আর হৃদয়ে ধরে না।
দেওবন্দে থাকা অবস্থায় মাওলানা এনামুল হক আমাকে কুমিল্লার কাসিমুল উলূম মাদরাসায় শিক্ষকতার জন্য খুব জোর তাগিদ করেছেন। এমনকি বাড়ীতে এসে মায়ের কাছেও একথা বলেছেন। আমি মালিবাগের হুজুরদের সাথে আলাপ করলে হুজুরগণ পূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন আমাকে কুমিল্লায় পাঠাবেন।
এদিকে মাওলানা ইসহাক ফরিদী মালিবাগ মাদরাসায় নিয়োগ পেয়েছেন। কিন্তু আমার মন মানছে না। আসাতিযায়ে কিরাম আর বন্ধু বান্ধবদের ছেড়ে একা সেখানে থাকতেও পারব না। তাই আমি হুজুরদের বললাম আমি কুমিল্লায় যাব একটি শর্তে তা হলো, মাওলানা ইসহাককে আমার সাথে দিতে হবে। এটা কিভাবে সম্ভব ইসহাকের তো মালিবাগ মাদরাসায় মুদাররিসি হয়ে গেছে বললেন হুজুরগণ।
ইতিমধ্যেই একজন বলে উঠলেন তারা দু'জন ছয় মাসও এক সাথে থাকতে পারবে না। এমনিতেই বাধা আবার আরও এই কথা! কিন্তু ভাগ্যের চাকা মানুষ কি পরিবর্তন করতে পারে?
আমার আবেদন শুনে হুজুরগণ পূণরায় আলোচনা করে মাওলানাকে আমার সাথে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এমনকি নূর হুসাইন কাসেমী সাহেব নিজে আমাদের উভয়কে কুমিল্লায় কাসিমূল উলুম মাদরাসায় নিয়ে যান। আনন্দের ঢেউ হৃদয় জুড়ে। খুশীতে আত্মহারা। মনে মনে ভাবছি জীবনে কিছু না পেলেও মনের মত একজন বন্ধ পেয়েছি।
মাওলানা এনামুল হকসহ আমাদের সমান প্রচেষ্টার ঘাম ঝরানো মেহনতের বদৌলতে এক বছরেই মাদরাসাটিকে কাফিয়া জামায়াত থেকে দাওরায়ে হাদিস পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম হই।
হুজুরের দিন রাতের মেহনত কবুল হয় আল্লাহর দরবারে। একটানা চারটি বছর অতিবাহিত হয় সেখানে। কুমিল্লায় হুজুরের ৫ম বছরের শুরুতে মাদরাসা খোলা হলো। অসুস্থতার দরুন আমি যেতে পারি নাই। রাতেই মাওলানা ইসহাক ফরিদী সাহেব মুফতী আব্দুল বাতেনকে সাথে নিয়ে আমার গ্রামের বাড়ীতে চলে আসেন। মাওলানাকে দেখে আমি অর্ধেক সুস্থ হয়ে যাই। আলাপ আলোচনার এক পর্যায়ে তিনি বললেন মাওলানা এখানেতো বহুদিন কাটালাম চলেন দু'জনে মিলে আমাদের দেশে একটি মাদরাসা করি।
হুজুরের কথা শুনে সে রাতেই আমরা মুন্সিগঞ্জে কাউনিয়াকান্দি চলে আসি। রাত শেষে বর্তমান হুজুর রহ.-এর কবর তথা কাউনিয়াকান্দির বাগে জান্নাত মসজিদের পার্শ্বের জায়গাটি দেখলেন। সেখানে মাদরাসা গড়ার পরিকল্পনা করলেন।
ছেড়ে এখানে এসে কিভাবে থাকব! ভাবছি আমি। আমি মনকে মোটেও বুঝাতে পারলাম না। আমি ইসহাক সাহেবকে বললাম, দেশে মাদরাসা করেন, আর দূরে প্রতিষ্ঠিত একটি মাদরাসা কোথাও মুদারিসি করেন, যা ইচ্ছা তাই করেন। আমি এসব ভেবে মাওলানাকে বলে কুমিল্লায় চলে গেলাম। হুজুর চলে এলেন ঢাকার পীরজঙ্গী মাজার মাদরাসায়। মাদরাসার পাশেই সাজাহানপুর মসজিদের ইমাম।
তখনো দুজনের মাঝে পুরা যোগাযোগ ছিল। কিছুদিন পর পরই সংবাদ পত্র আদান প্রদান হত। হাল অবস্থার খোঁজ খবর দেয়া নেয়া হত। কিন্তু মনের মানুষটিকে দূরে রেখে কি ভাল লাগে? ভাল লাগার কথাও না। পীরজঙ্গী মাদরাসা থেকে নূর হুসাইন কাসেমী হুজুরের পরামর্শে বারিধারা মাদরাসায় চলে যান। সেখানেও দক্ষ ও অভিজ্ঞ মুদাররিসের পরিচয় দেন। তার নাম ও পরিচিতি বিদুৎবেগে সবদিকে ছড়াতে থাকে। এদিকে শেখ জনুরুদ্দীন রহ. দারুল কুরআন শামসুল উলুম চৌধুরীপাড়া মাদরাসার মুহতামিম না থাকায় মুহতামিম প্রয়োজন।
তখন চৌধুরীপাড়া মাদরাসার ভারপ্রাপ্ত মুহতামিম ছিলেন মাওলানা দিলাওয়ার হুসাইন রাশেদ। যিনি বর্তমানে চৌধুরীপাড়া মাদরাসার সিনিয়র মুদাররিস। তিনি যোগ্য-প্রাজ্ঞ ব্যক্তির খুঁজে হন্য। কোথায় পাবেন তার লাইনের যোগ্য ব্যক্তি! খুঁজে পেলেন মাওলানা ইসহাক ফরিদী রহ. কে। দিলাওয়ার সাহেব স্ব-উদ্বেগে ইসহাক সাহেবকে মুহতামিম বানানোর সংকল্প করেন। প্রভূর দরবারে দু'আ করেন সাথে আছে মাওলানা মাহফুজুর রহমান। উভয়ে মিলে যৌথ প্রচেষ্টায় হুজুরকে এখানে আনার তীব্র প্রয়াস চালান। এক পর্যায়ে মাওলানা ফরিদ উদ্দীন মাসউদ ও নূর হুসাইন কাসেমী রহ. দ্বয়ের কথায় মাওলানা ইসহাক ফরিদী রাজি হলেন।
তবে একটি আবেদন! একটি চাওয়া! তা হলো কুমিল্লার কাসিমূল উলুম মাদরাসার নাজিমে তা'লীমাত মাওলানা আস'আদ আল হুসাইনীকে আমার সাথে দিতে হবে। যেই কথা সেই কাজ। মাওলানা আমাকে চৌধুরীপাড়ায় নিয়ে এলেন। মাদরাসার ছাত্র-উস্তাদ, কমিটির লোকজন যেন হুজুরকে হীরা মাণিক পেল। মাওলানার সার্বিক চেষ্টা-প্রচেষ্টা, মেহনত মুজাহাদা দিয়ে মাদরাসাকে গড়তে থাকেন। অল্প দিনেই দেশে বিদেশে মাদরাসার সু-প্রসিদ্ধি ছড়িয়ে পড়ে। আষাড়ের স্রোতের মত ছাত্র ভীড় জমাতে থাকে।
এই নব্বীর মধু কাননে ফুটতে থাকে হাজারো ফুল। আমি মাওলানার পেছনে পেছনে চলছি। যখনই মাওলানার সু-পরিচিতি সর্বত্রই পৌঁছতে লাগল, তখন থেকে বহু রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক দলগুলো থেকে বহুমুখী হাঁক আসতে থাকে। ফুলের ঘ্রাণ পেয়ে শত শত ফায়দা লুণ্ঠনকারী ভ্রমর আসতে থাকে। দলীয় সার্থে, রাজনৈতিক সার্থে এই যোগ্য-প্রাজ্ঞ ব্যক্তিটিকে আপন করতে থাকে। মাওলানাও দলমত নির্বিশেষে সকল ধর্মীয় কাজে অংশ গ্রহন করতে থাকেন।
অপরদিকে পরম শ্রদ্ধা-ভাজন উস্তাদ আল্লামা ফরিদ উদ্দীন মাসউদ সাহেবের সাথে রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিন্নতার দরুণ কিছুটা দূরত্ব অনুভব হতে থাকে। কারণ, যাকে এত আপন করে গড়েছেন সে যদি অন্যের হাত ধরে সঙ্গত অসঙ্গত রাজনৈতিক দল তার থেকে ফায়দা লুন্ঠন করে তা অবশ্যই হৃদয়ে বাজে। কিন্তু মাওলানা এগিয়ে চলছেন।
তিনি দ্ব্যার্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করছেন যেখানে ইসলাম আছে সেখানে যাও প্রান্তিকতার শিকার হয়ো না। একথা কখনও বলতেন না যে তাবলীগই ইসলাম, জিহাদই ইসলাম, রাজনীতিই ইসলাম বরং বলতেন সবগুলোর সমন্বয়ে হলো ইসলাম। যার ফলে দল মত নির্বিশেষে সকল দলেই কাজ করা সম্ভব হয়েছে। দ্বীনের প্রতিটি কর্মস্থলে তাঁর পদচারণা ঘটেছে। এ কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, মাওলানা ইসহাক ফরিদী তার উস্তাদের সাথে সব সময় সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলতেন।
মাওলানার মনের বিরাট আশা ছিল আমাদের সাথে আত্মীয়তা করার। সে সুবাদে আমার ভাগিনা মাওলানা মুহাম্মাদ আবূ মূসার সাথে তাঁর বড় মেয়ের বিবাহ সংঘটিত হয়।
মাওলানা ইসহাক ফরিদী মুহতামিম হিসাবে মাদরাসার সকল কাজ যথারীতি পালন করেছেন। মাদরাসার ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র বিষয়াবলীসহ, ব্যক্তিগত, পারিবারিক বিষয়গুলো পর্যন্ত আমার সাথে আলোচনা করতেন। রাজনৈতিক চিন্তাধারার ভিন্নতা থাকলেও তিনি বিভিন্ন বিষয়ে আমার সাথে পরামর্শ করতেন। এতো একমাত্র হুজুরের সাদা মন আর আমার প্রতি অত্মিবিশ্বাস ছিল বলেই তা সম্ভব হয়েছিল।
মাদরাসায় যখনই কোন সমস্যা হত তখনই আসাতিযায়ে কিরামসহ হুজুর এর শক্ত হাল ধরতেন। সকল বাধা-বিপত্তিকে পদদলিত করে সামনে এগুতেন। এতে তিনি সফলও হয়েছেন। বিভিন্ন সময়ে হুজুরের ধৈর্য্য দেখে আমি অধৈর্য্য হয়ে যেতাম। কারণ, হুজুরের নজরীয়াহ ছিল যা বলব সত্য বলব, কিন্তু সব সত্যই আমাকে বলতে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। তাই অনেক প্রতিকূল অবস্থাকেও তিনি সুকৌশলে অনুকুলে নিয়ে আসতে পারতেন।
জীবনের ত্রিশটি বছর যার সাথে অতিবাহিত করলাম তিনি এত নিষ্ঠুর, এত নির্দয়, যিনি আমাকে একা ফেলে এত সকাল চলে যাবেন তা কখনও ভাবিনি। যখন রাত দু'টার সময় মাওলানা নূরুল হক মোবাইলে আমাকে ইসহাক ফরিদীর শাহাদাতের সংবাদ শুনালেন। তখন যে আমার কি অবস্থা হয়েছে তা কি কলমের আঁচড়ে আসবে? মুখের ভাষায় বর্ণনা সম্ভব হবে? আদৌ না, হৃদয়ের আগুন হৃদয়কেই জ্বলে পুড়ে ভস্ম করুক।
অন্তরটি ভেঙ্গে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। জীবনে কাউকে হারিয়ে এত অধিক ভেঙ্গে পড়ি নাই। আমার প্রতিটি মুহুর্ত দাঁড়াতে, বসতে, শুইতে সর্বদাই এক কল্পনা, চোখ বন্ধ করলেই ছোট বেলার স্মৃতিগুলো এসে আমায় দুঃখ সাগরে ভাসিয়ে দেয়। চৌধুরীপাড়া মাদরাসার প্রতিটি দেয়াল চুপে চুপে আমার কানে কানে বলে দেয় তোমার মাথার উপরের ছাদ হারিয়ে ফেলেছ। তাঁর শীতল ছায়া থেকে চিরদিনের জন্য মাহরুম হয়ে গেছ।
হুজুরের রুমের সামনে এলেই নিজেকে আর স্থির রাখতে পারি না। তখনই আমার মনে পড়ে যখন তিনি লিখতেন, বা মুতালায়া করতেন। আমি দরজায় মুখ রাখলেই বলতেন, মাওলানা আসেন। অনেক সময় হাসি মজাক করে বলতাম। কত শত-লেখক দেখেছি কিন্তু আপনার মত সারাদিন লেখতে কাউকে দেখিনি। তখন হেসে হেসে বলতেন আমরা কি লেখি, কি কষ্ট করি? আমাদের আকাবীর তো আরো হাজারগুণ বেশি মেহনত করে গেছেন। রুমে প্রবেশ করতে না করতেই কোন ছাত্রকে ডেকে চা নাস্তার ব্যবস্থা করতেন।
খুব কম সময়ই এমন হয়েছে যে চা পান না খেয়ে হুজুরের রুম থেকে বের হয়েছি। তাঁর অতিথি পরায়নতার তুলনা বিরল। পকেটে টাকা নেই। মেহমান এসেছে তো নাস্তার ব্যবস্থা করেই শান্ত হয়েছেন।
মৃত্যুর দু'দিন পূর্বে আরজাবাদ মাদরাসায় হযরত মাদানী রহ.-এর আগমন উপলক্ষে এক সভা। সেখানে যাওয়ার জন্য আমি মাওলানাকে বললাম। তিনি অসুস্থ থাকায় যেতে তেমন আগ্রহী হলেন না। কিন্তু আমি বললাম, মাওলানা! আপনি মাদানী সাহেবের আগমনের প্রস্তুতি সভায় যাবেন না, তা মোটেও হতে পারে না। আমার কথায় তিনি নতুন প্রাণ ফিরে পেলেন। অসুস্থ থাকার পরও রাযি হলেন। গাড়িতে বসে মাওলানাকে বললাম এই অসুস্থ শরীর নিয়ে কিভাবে নানূপুর যাবেন। হুজুর বললেন, পীর সাহেব হুজুর আদেশ করেছেন, না গেলেই নয়।
মৃত্যুরদিন ও এর আগেরদিন এক সঙ্গে বসেই প্রশ্ন সম্পাদনা করেছি। শেষদিন কয়েকবার জামিয়া আহলিয়া মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা ইয়াহ্ইয়া মাহমূদ সাহেব মোবাইল করছেন সেখানে যাওয়ার জন্য। আমি ইসহাক সাহেবকে বললাম, মাওলানা আমি চলে গেলে ভাল হয়। কারণ, দুই মুহতামিমের চাকুরী করি সে হিসাবে দু'জনকেই খুশী রাখতে হয়। হুজুর সহসাই বলে উঠলেন, দুই মুহতামিমের অধিনে কাজ করলে এমনই হয়।
আমি হাসতে হাসতে মুখ খুলে বলেই ফেললাম, দুই পীরের কাছে মুরিদ হলেও এমন হয়। সালাম ও মুসাফাহা করে বিদায় নিলাম। এই ছিল ৫ই জুন ০৫ইং রবিবার দুপুরে তাঁর সাথে আমার শেষ কথা। কিন্তু এ কথাই যে শেষ কথা তা কখনো কল্পনাও করতে পারিনি।
পৃথিবীর সূর্য অস্ত যায় আবারো উদিত হয়। চন্দ্র ডুবে যায় ফিরে আসে আবারো; কিন্তু তুমি তো ভাই ইসহাক ফরিদী জীবনে আর কোনদিন ফিরবে না হায়!
হে আমার জ্যোতিময় আলোকিত সূর্য্য। হে হৃদয়ের ফুলকিত উজ্জ্বল চাঁদ। তুমি কি আর আসবে না। কাছে ডাকবে না। নাকি লুকিয়ে গেছ কোন অজানার পথে। হে হতভাগা আমার আত্মা। তুমিতো মাহরূম হয়ে গেছ, হারিয়ে ফেলেছ জীবনের সবকিছু। চিরদিনের জন্য তোমার জীবন সূর্য্য নিভে গেল। চলে গেলে আরাম ভরা জান্নাতে।
হে আমার দয়াল প্রভূ! আমার প্রার্থনা, আমার বন্ধুকে তুমি কষ্ট দিবে না। আদর সোহাগ করে কোলে রাখবে আমার বন্ধুকে। বন্ধু আমিও আসছি তোমারই পথ ধরে। তখন কিন্তু ভুলে যেওনা মোরে! ভুলে যেওনা!!
-লেখাটি আল্লামা ইসহাক ফরিদী রহ. স্মারক গ্রন্থ থেকে নেওয়া
এনএ/