|| জুবাইর আহমদ আশরাফ ||
শায়খুল হাদিস আল্লামা হাফেজ মুহাম্মদ ইসহাক ফরিদী রাহিমাহুল্লাহ এক বর্ণাঢ্য নাম। ব্যতিক্রম ধারার লোক ছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ জ্ঞানসাধক ও পরিশ্রমী মানুষ। তাঁর সাধনা ও জ্ঞানচর্চা অবাক হওয়ার মত। আর তার কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যবসায় বিস্মিত অভিভূত হওয়ার মত।
তাঁর ন্যায় পরিশ্রমী মানুষ শুধু সমকালে নয়, সর্বকালেই বিরল। বিশেষ করে জীবনের শেষ কয়েকটি বছর তিনি অত্যন্ত ব্যস্ততায় কাটিয়েছেন। তাঁর বিদায়ের সময় যতই ঘনিয়ে আসতে থাকে, ব্যস্ততাও ততই যেন বৃদ্ধি পেতে থাকে।
তিনি কি জানতেন, তিনি অল্পসময় নিয়ে পৃথিবীতে এসেছেন? তবে এত ব্যস্ততায় ও কর্মতৎপরতায় সময় কাটালেন কেন? শেষ সময়ে তিনি হয়তো অনুভব করতে পেরেছিলেন, তাঁর সময় ফুরিয়ে এসেছে। সে জন্য ওফাতের তিন দিন পূর্বে নিজ গ্রামে কবরের জায়গা রেজিস্ট্রি করে বলেন, সম্ভবত প্রথম কবর আমারটিই হবে।
এ ছাড়া শেষ বিদায়ের এক দিন পূর্বে তাঁর তাসাওউফ ও আত্মশুদ্ধি নামক যে অমর হযরত ওমর ইবনে আবদুল আযীয চল্লিশ বছর বয়সে ইনতেকাল করেন। ইমাম ইবরাহীম নাখাঈ গ্রন্থখানি প্রকাশিত হয়, তা হাতে নিয়ে বলেন, এটিই আমার সর্বশেষ বই। উনপঞ্চাশ বছর বয়সে, ইমাম শাফিঈ চুয়ান্ন বছর বয়সে, ইমাম গাযালী পঞ্চান্ন বছর বয়সে, ইমাম নববী পঁয়তাল্লিশ বছরে ইহলোক ত্যাগ করেন। এবং ইমাম আবূ বকর হাযিমী ছত্রিশ বছরে, আল্লামা সফিউদ্দীন আলখায়াজী সাড়ে তেইশ বছরে, হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত কাসিম নানুতবী উনপঞ্চাশ বছরে ও মাওলানা আবদুল হাই লাখনৌবী উনচল্লিশ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন।
এ সকল মনীষী অল্পসময়ে পৃথিবীতে অক্ষয় কীর্তি স্থাপন করতে সক্ষম হন। তাঁদের কালোত্তীর্ণ কীর্তিগাঁথার বিশদ বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন জগতের শত শত লেখক ও সাহিত্যিক। কালে কালে পৃথিবীর সুশীল সমাজ তাদেরকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেছে এবং অনাগত কালেও করতে থাকবে।
মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক ফরিদী ছিলেন এ ধারারই একজন। তিনি মাত্র আটচল্লিশ বছরের জীবনে অন্তত পঞ্চাশ হাজার পৃষ্ঠা লিখে ফেলেন। শত শত ওয়াজ মাহফিল, রাজনৈতিক সমাবেশ ও মিটিং-মিছিলে অংশগ্রহণ করেন। বুখারী শরীফসহ জটিল জটিল কিতাবের দরস প্রদান করেন, একটি বিশাল মাদরাসা পরিচালনা করেন এবং একান্ত ব্যক্তিগত উদ্যোগে শত শত ছাত্রের সুপ্ত প্রতিভা পরিচর্যার মাধ্যমে তাদেরকে যোগ্য নাগরিক এবং প্রকৃত ওয়ারিসে নবী হিসাবে গড়ে তুলতে প্রাণপণ চেষ্টা করেন।
অনেক দরিদ্র ছাত্রকে আর্থিকভাবে সহযোগিতার মাধ্যমে তাদের দীনী ইলম অর্জনের বাধা অপসারিত করে, তিনি উসতাদ ও পিতা উভয়ের দায়িত্ব পালন করেন। ক্ষেত্রবিশেষে সংশ্লিষ্ট ছাত্রের পরিবারের দায়িত্বও নিজ কাঁধে তুলে নেন।
আমি দেখিয়াছি দুঃখীর তরে তোমার চোখের পানি এক আল্লাহ জানেন তোমারে দিয়াছ কি কোরবানি।
এরূপ কিভাবে সম্ভব হল? সম্ভব হল, আল্লাহ প্রদত্ত তাঁর প্রখর মেধা ও বিরামহীনভাবে প্রাণান্তকর পরিশ্রমের ফলে। তিনি পিতামাতার একমাত্র সন্তান। সচ্ছল পিতার আদুরে সন্তান হওয়ার কারণে তিনি আরাম আয়েশ ও বিলাসিতার জীবন বেছে নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি গ্রহণ করেন সংগ্রাম ও সাধনার জীবন।
জ্ঞানচর্চার প্রতি গভীর অভিনিবেশ ও ঈপ্সিত লক্ষ্য অর্জনে বজ্রকঠিন স্থিরতা ছাড়াও তাঁর মাঝে আরো অনেক মানবিক গুণের অতিবিরল সমাবেশ ঘটেছিল। তিনি ছিলেন অসাধারণ ধৈর্যশীল। জীবনের নানা চড়াই-উতরাই, দুর্যোগ-দুর্বিপাক ও সংগ্রাম-সঙ্কট তিনি সবরের মাধ্যমে মুকাবিলা করেন। কঠিন বিপদেও তিনি বিচলিত হতেন না। তাঁর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের সকল সমস্যায়, কর্মক্ষেত্রের সঙ্কটকালে, বিশেষত চৌধুরীপাড়া মাদরাসার আর্থিক ও পারিপার্শ্বিক জটিলতায় তিনি ছিলেন পাহাড়সম অটল।
অর্থসম্পদের মোহ তাঁকে কখনো স্পর্শ করেনি। তিনি জমি বিক্রয় করে সে টাকা দিয়ে গ্রন্থ প্রকাশ করেন। তিনি নিজে যে সব গ্রন্থ প্রকাশ করেন, তার অধিকাংশই মানুষকে হাদিয়া দেন। আর তাঁর ভক্তজনেরা যেগুলো ক্রয় করে নেয়, সে বিক্রয়লব্ধ অর্থও তিনি দ্বীনি কাজে অকাতরে বিলিয়ে দেন।
তিনি গ্রন্থ রচনা করে ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও অন্যান্য প্রকাশনা থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা অর্জন করেন। কিন্তু এ সব টাকা দুই হাতে খরচ করে ফেলেন। তিনি মৃত্যুর সময় দশটি টাকাও ব্যাংক ব্যালেন্স হিসেবে রেখে যাননি।
কবির ভাষায়:
যুগে যুগে এই পৃথিবী গেয়েছে সেই মানবের জয়, বিলায়ে দিয়েছে মানুষেরে যারা স্বীয় সব সঞ্চয়।
এ সব টাকা কি তিনি সন্তানদের পেছনে ব্যয় করেছেন? না। সন্তানদের জন্য খুব সামান্যই ব্যয় করেছেন। সিংহভাগ করেছেন রূহানি সন্তানদের পেছনে। মাদরাসা ও সংগঠনের কাজে বের হলে সর্বদা নিজের পকেট থেকে টাকা খরচ করতেন।
তাঁর পিতামাতার ইনতেকালের পর একদিন আমি বলি, গজারিয়ার জমিজমা বিক্রয় করে তো ঢাকায় একটি বাড়ি করে ফেলতে পারেন। তদুত্তরে দুনিয়ার প্রতি। নির্লোভ মাওলানা ইসহাক ফরিদী বলেন, 'ঢাকায় বাড়ি করলে আমার ছেলেটি ভাববে, আমার পিতার ঢাকায় বাড়ি আছে, পড়ালেখা করার কী প্রয়োজন!' মানসিকতা কত পরিচ্ছন্ন হলে এ ধরনের চেতনা লালন করা যায়!
আমাদের কালে আমরা যখন একান্ত আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছি, আত্মস্বার্থ ভিন্ন কোন কিছু ভাববার ন্যূনতম ফুরসতও আমাদের নেই, সে সময় মাওলানা ইসহাক ফরিদীকে দেখি, নিজের স্বার্থচিন্তা বিস্মৃত হয়ে পরার্থপরতার এক চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করছেন।
কোন অসুস্থ বা বিপদগ্রস্ত মানুষের উপকার করার জন্য তিনি ছুটে যেতেন। যেন এটা তাঁর কর্তব্য। যে কোন মানুষের উপকার করতে পারলে তিনি অত্যন্ত খুশী হতেন। এ ক্ষেত্রে তিনি কত উদার ছিলেন তার নিদর্শন হিসেবে আমাদের পারিবারিক একটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে।
আমার আব্বার ইনতেকালের পর এলাকার কতিপয় অতি দুরাচার লোকের প্রত্যক্ষ মদদে জনৈক মূর্খ ও পরসম্পদ লোভী ব্যক্তি আমাদের একটি পতিত ভিটি জমি বেদখল করার অপচেষ্টা চালায়। ওরা পরিকল্পিতভাবে আমাদের ঐ জমিতে একটি ঘর নির্মাণ করে। কে বা কারা পরবর্তী রাতে এসে এই ঘর ভেঙ্গে দেয়। পরদিন সকালে এ সকল সংবাদ আমরা ঢাকায় বসে জানতে পারি। অতঃপর ওরা কোতোয়ালী থানার তৎকালীন ওসিকে অবৈধভাবে প্রভাবিত করে একটি মিথ্যা চার্জশিট সাজিয়ে কোর্টে কেইস ঠুকে দেয়। মামলা মোকদ্দমা সম্বন্ধে আমাদের কোনরূপ অভিজ্ঞতা নেই। আমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ি। আমার ছোট ভাই মাওলানা জাফর আহমদ আশরাফী চৌধুরীপাড়া মাদরাসার মুহাদ্দিস হওয়ার কারণে মাওলানা ইসহাক ফরিদীর সঙ্গে আমাদের পারিবারিক পূর্বসম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হয়। আমাদের পরিবারের এ কঠিন মুহূর্তে মরহুম মাওলানা ফরিদী একান্ত আপনজনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।
আমাদেরকে কিভাবে উদ্ধার করা যায়, সে চিন্তায় তিনি বিভোর হয়ে পড়েন। আমিনী সাহেবসহ অনেকের নিকট টেলিফোন করে বিষয়টি অবহিত করেন। আসলে এরূপ মামলা মোকদ্দমা সম্পর্কে তাঁরও কোন পূর্বঅভিজ্ঞতা ছিল না। তিনি একদিন আমাদের দুইভাইকে নিয়ে তৎকালীন সচিব জনাব আবদুল হক সাহেবের বাসায় যান। সচিব মহোদয় আমাদের কাগজপত্র পাঠ করে এবং মৌখিকভাবে বিবরণ শ্রবণ করে বলেন, 'পুলিশ এর চেয়েও আরো দুঃখজনক কাজ করছে। প্রায় পুরো বাংলাদেশেই এরূপ চলছে। আচ্ছা, আমি কুমিল্লার ডিসিকে বলে দেব।'
মামলা ট্রায়াল কোর্টে গেলে কোন তদবীরে কাজ হয় না, সম্পূর্ণভাবে বিচারকের এখতিয়ারে চলে যায়। মাওলানা ইসহাক ফরিদী জানতেন না।
তাই তিনি একদিন বলেন, 'তোমাদেরকে নিয়ে স্বরাষ্ট্র সচিব ওমর ফারুক সাহেবের সঙ্গে দেখা করব। তাঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক আছে।' কে একজন তাঁকে বলেছে, কুমিল্লা সদরের দায়িত্বপ্রাপ্ত এমপি হলেন ডক্টর খন্দকার মোশাররফ হোসেন। ইসহাক সাহেব আমাকে বলেন, 'তোমাদেরকে মিথ্যা মামলা থেকে উদ্ধারের জন্য মোশাররফ সাহেবের কাছে নিয়ে যাব। তিনি আমাদের কাছাকাছি অঞ্চলের মানুষ এবং আমার সঙ্গে চেনাজানা আছে।'
মাওলানা হসহাক ফরিদীর শাহাদাতের কয়েকদিন পর কুমিল্লা ফৌজদারী কোর্টের প্রথম শ্রেণীর মেজিস্ট্রেট জনাব শফিউল আজিম সাহেব এ মামলা শুনানি হওয়ার পর আমাদেরকে বেকসুর খালাস দেন। আজ ইসহাক সাহেব জীবিত থাকলে কতই না খুশী হতেন! তিনি চলে গেছেন। আমরাও মামলা থেকে রেহাই পেয়েছি। তবে বিপদগ্রস্ত আমাদেরকে উদ্ধারের জন্য তাঁর সে কী আকুতি! নিজের আরব্ধ কাজ বর্জন করে আমাদের জন্য বিভিন্নজনের নিকট টেলিফোন ও ছুটাছুটি! এ সব ঘটনার জন্য তিনি চিরতরে আমাদের হৃদয়ের মণিকোঠায় অমর হয়ে রইলেন।
মানুষের উপকার করবার এরূপ আকাঙ্ক্ষায় তাঁর পুরা জীবনই ব্যয় হয়েছে। পরোপকারের এই উন্নত মানসিকতার কারণে তিনি আপনজনকে অতি ঘনিষ্ঠ এবং শত্রুকেও বন্ধুতে পরিণত করতে সক্ষম হন।
আরবিতে একটি কথা আছে, মানুষ যে বিষয়ে অজ্ঞ, সে বিষয়ের শত্রু হয়ে দাঁড়ায়। মরহুম মাওলানা ইসহাক ফরিদী প্রিন্সিপাল হওয়ার পূর্বে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করেন। যেহেতু তিনি ছিলেন ফিকহ, হাদিস ও তাফসির ইত্যাদি বিষয়ে প্রভূত জ্ঞানের অধিকারী, পাঠদানে অত্যন্ত দক্ষ এবং বিভিন্ন মানবিক গুণে সমৃদ্ধ, এ জন্য তিনি যেখানেই গেছেন, সেখানেই কায়েমী স্বার্থবাদীদের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছেন।
কিন্তু তিনি সাময়িকভাবে সমস্যায় পতিত হলেও পরিণামে তাঁর মানমর্যাদা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে, তিনি সকলের আস্থাভাজন ও প্রিয়ভাজন হয়েছেন। তাঁর জীবনের প্রথম কর্মক্ষেত্র কুমিল্লায় যে ছাত্রগুলি তাঁর সবচেয়ে বিরোধী ছিল, সে ছাত্রগুলিই তাঁর একান্ত অনুরক্তে রূপান্তরিত হয়। এরূপ সম্ভব হয় তাঁর ক্ষমা, পরোপকার, ধৈর্য ও সহনশীলতার ন্যায় উন্নত আখলাকের কারণে। সকলেরে তুমি সেবা করে গেলে, নিলে না কারুর সেবা।
মাওলানা ফরিদী নিরন্তর সাধনায় নিয়োজিত ছিলেন। জীবনে কোনদিন কারো ক্ষতি করেননি। সকলের উপকারই করেছেন। না পারলে অন্তত উপকার করার চেষ্টা করেছেন। তিনি মানুষের গীবত শেকায়েত থেকে বিরত থাকতেন।
বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় মুরুব্বী উলামায়ে কিরামের মধ্যে কখনো বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে মতবিরোধ হয়েছে। এ সব ক্ষেত্রে তিনি নিজের জবানকে সকলের সমালোচনা থেকে দূরে রাখতেন। এ জন্য তিনি ছিলেন বাংলাদেশের সকল উলামায়ে কেরামের নিকট অত্যন্ত প্রিয়। তাঁর জানাযার নামাযে দেশের শীর্ষপর্যায়ের উলামায়ে কিরামের উপস্থিতিই এর উজ্জ্বল সাক্ষী।
মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক ফরিদী আমার মরহুম আব্বাজান মাওলানা আশরাফ উদ্দীন সাহেবকে অত্যন্ত ভক্তি ও শ্রদ্ধা করতেন। তিনি কুমিল্লা কাসিমুল উলুম মাদরাসায় আব্বার সঙ্গে কয়েক বছর হাদিস অধ্যাপনার কাজ করেন। সে সময় আব্বাকে খুব কাছে থেকে দেখার কারণে আব্বার প্রতি তাঁর এই ভক্তিশ্রদ্ধা সৃষ্টি হয়। তিনি সবসময় আব্বার জ্ঞানগরিমার প্রশংসা করতেন। আমাদেরকে ও আমাদের ভগিনিপুত্রদেরকে তাঁর মত আলেম হওয়ার উপদেশ দিতেন।
আব্বা অসুস্থ হয়ে পিজি হাসপাতালে ভর্তি হলে তিনি কয়েকবার হাসপাতালে গমন করে আব্বাকে দেখে আসেন। তিনি চৌধুরীপাড়া মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদেরকে সঙ্গে নিয়ে আব্বার সুস্থতার জন্য অঝোর ধারায় কান্নাকাটি করে দোয়া করেন।
সকলের দোয়ায় আব্বাজান সুস্থ হওয়ার পর মাওলানা ইসহাক ফরিদী সাহেব তাঁর কয়েকজন বন্ধু যথাক্রমে ডক্টর মাওলানা মুশতাক আহমদ, মাওলানা আবদুল মতীন ও মাওলানা আবু সুফিয়ান যাকীসহ উনিশ শ' নিরানব্বই সনের চব্বিশে আগষ্ট মঙ্গলবার আব্বার সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে আমাদের গ্রামের বাড়ি ধনুয়াখলায় গমন করেন। সে দিন তাঁরা আমাদের বাড়িতে পরিপূর্ণ একটি দিন কাটান। তাঁরা আব্বার ছাত্রজীবন ও সংগ্রামমুখর কর্মজীবন নিয়ে তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ করেন।
এর প্রায় নয় মাস পর দুই হাজার সনের ২০ মে মাওলানা ফরিদী আমার বিবাহোত্তর ওলীমা অনুষ্ঠানে আমাদের বাড়ি যান। এ দিনই ছিল আব্বার সঙ্গে তাঁর সর্বশেষ সাক্ষাৎ।
আব্বার ইন্তেকালের দিন চৌধুরীপাড়ায় মাদরাসা সংক্রান্ত এক গুরুত্বপূর্ণ মিটিং ছিল। তিনি প্রিন্সিপাল হওয়ার কারণে মিটিং বর্জন করে আব্বার জানাযায় শরীক হওয়ার উদ্দেশ্যে কুমিল্লায় যাওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। তবে তিনি অনেক আফসুস করেন।
তিনি লিখেছেন, '... কিন্তু মনে বড় দুঃখ ছিল এবং এ কারণে নিজেকে অপরাধী মনে করছিলাম। অবশেষে রমযানের পর ২৯ডিসেম্বর হযরতের মাযার যিয়ারতে যাই এবং জুমআর খুতবায় হযরতের কামালাত ও গুণাগণ সম্বন্ধে আলোচনা করি। নামাজ পড়াই এবং নামাজান্তে হযরতের দারাজাত বুলন্দীর জন্য দুআ
এক পর্যায়ে তিনি গ্রামবাসীকে বলেন, এখানে মসজিদের পাশে মরহুম মাওলানা আশরাফ উদ্দীনের নামে আপনারা একটি কোরআনিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করুন। যার কোরআন তিলাওয়াতের শব্দ হযরত কবর থেকে শুনতে পাবেন। আমি প্রতিমাসে এক হাজার টাকা করে দেব।
মাওলানা ইসহাক ফরিদী ছিলেন আমাদের পরিবারভুক্ত সদস্যের মত। আমাদের পারিবারিক অধিকাংশ অনুষ্ঠানে তিনি অংশগ্রহণ করেন। জাফরের বিবাহ ও জাফরের পুত্র হুমাইদের আকিকা-এ উভয় অনুষ্ঠানে তিনি শরীক হন। ইসহাক সাহেবের স্নেহধন্য ছাত্র ও আমাদের ভগিনিপুত্র মাওলানা উবায়দুল্লাহ আশরাফের বিবাহের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তও তাঁর মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।
আমার আম্মার একান্ত ইচ্ছা, উবায়দুল্লাহর বিবাহ ইসহাক সাহেব হুজুর পড়াবেন। এ জন্য বিবাহের তারিখ তাঁর থেকেই নেওয়া হয়। তিনি ব্যস্ততার মাঝেও এ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে সুদূর ব্রাহ্মণবাড়িয়া গমন করেন। আমি ও দুলাভাই মাওলানা শহীদুল্লাহ সিদ্ধান্ত করে রাখি, বিবাহের মুহূর্তে তাঁকে আম্মার ইচ্ছার কথা জানাব এবং তাঁকেই বিবাহ পড়াতে অনুরোধ করব। এদিকে বিবাহের মজলিসে কন্যাপক্ষের আত্মীয় ও মুরুব্বি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিশিষ্ট আলেম মুফতী মাওলানা নূরুল্লাহ উপস্থিত। তিনি সেই মজলিসের মধ্যমণি এবং ইসহাক সাহেব হুজুরেরও মুরুব্বি। এরূপ পরিস্থিতিতে আমরা নিশ্চুপ হয়ে যাই। কন্যার দাদা মাওলানা আবদুল মালেক মুফতি সাহেবকে বিবাহ পড়াতে অনুরোধ করেন।
মুফতি নূরুল্লাহ সাহেব সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে বলেন, 'এ বিবাহ আমিই পড়াতাম। কিন্তু আল্লাহ পাকের শুকরিয়া, আমাদের এ মুবারক মজলিসে অনেক কষ্ট স্বীকার করে উপস্থিত হয়েছেন আমাদের একান্ত বন্ধু মাওলানা ইসহাক ফরিদী। আমার অনুরোধ, বিবাহ তিনিই পড়াবেন। আমি দুআ করব।' এতটুকু কথা বলে মুফতি সাহেব হুযুর বসে পড়েন। আমি ও দুলাভাই একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসি দেই। আমরা আম্মার ইচ্ছা বাস্ত- বায়িত হওয়ার কারণে আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া আদায় করি। যেখানে ইসহাক সাহেব লেখালেখি বাদ দিয়ে একটি মিনিট ব্যয় করতেও কুণ্ঠিত হন, সেখানে তিনি এ অনুষ্ঠানে পূর্ণ একটি দিন ব্যয় করেন।
অবশেষে এল সেই বেদনাবিধুর দিন। দুই হাজার পাঁচ সনের ছয়ই জুন। রাতের তৃতীয় প্রহর। মাওলানা জাফর মোবাইলে চিৎকার দিয়ে কান্না করে বলল, ভাই! ইসহাক সাহেব হুজুর কুমিল্লায় একসিডেন্টে ইন্তেকাল করেছেন। হুযুরের সঙ্গে উবায়দুল্লাহ ছিল। ওর অবস্থা আশঙ্কাজনক। আমি পাঠ করলাম, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মোবাইল রেখে মূঢ় মূক ও স্তব্ধ হয়ে কতক্ষণ বসে রইলাম। হুজুর ও উবায়দুল্লাহর জন্য দোয়া করলাম। বিভিন্ন স্থানে ফোন করে এ সংবাদ দেই। উবায়দুল্লাহর সঙ্গে কথা বলি। সে বলে, মামা আমার মাথা ফেটে গেছে। মনের জোরে কথা বলছি। জাফর কুমিল্লায় পৌছার পর কতক্ষণ পর পর জাফরের সঙ্গে কথা বলতে থাকি।
ফজরের পর আমার স্ত্রী ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ফোন করে বলে, কোন সংবাদ শুনেছেন কি না? বললাম, শুনেছি। অতঃপর সে বলল, 'বাসায় আমরা ইসহাক সাহেব হুজুর ও উবায়দুল্লার জন্য খতম পড়ছি। আর দুলাভাই কুমিল্লা কুসাইতলী হাসপাতালে আছেন। দুলাভাই কান্নার জন্য কথা বলতে পারছেন না। আপনি একটু সান্ত্বনা দিন।' দুলাভাইয়ের সঙ্গে আবারও কথা বলি।
হুজুরের জন্য পাগল জাফর দিশেহারার ন্যায় হয়ে গেল। সে হুজুরের লাশের সঙ্গে ঢাকায় রওয়ানা হয়ে গেছে। আমি বলি, উবায়দুল্লাহর কী অবস্থা? সে বলে, মাথায় সেলাই চলছে। সশব্দে কান্না করে জাফর আরো বলে, আমার তো সব শেষ। হুজুরের শেষ সময়টুকু তাঁর সঙ্গে কাটাতে চাই। জাফরের যুক্তি খণ্ডন করে আমি বলি, হুজুর তো জান্নাতে চলে গেছেন। এখন তাঁর জানাযায় শরীক থাকতে পারলেই হল। তুমি ভাগিনাকে বাঁচানোর চেষ্টা কর। উবায়দুল্লাহর সঙ্গে থাক। সেলাই শেষ হলে ঢাকায় নিয়ে আস। আমি ঢাকার যাবতীয় ব্যবস্থা করছি। দুলাভাইকে বলি, ঢাকায় কোথায় আনতে চান? তিনি বলেন, কোথায় আনব? বলি, শাহবাগ পিজির সামনে।
অধ্যাপক মবিন খান মামার একান্ত সহযোগিতায় পিজির নিউরো-সার্জারীর ইমার্জেন্সীতে উবায়দুল্লাহর ভর্তির বন্দোবস্ত করি। কর্তব্যরত ডাক্তারগণ কুমিল্লার সেলাই খুলে ড্রেসিং করে পুনরায় সেলাই করেন। আমি এ সব কাজ সম্পন্ন করে চৌধুরীপাড়া ইসহাক সাহেবের জানাযায় শরীক হওয়ার জন্য রওয়ানা হই।
শেষবারের মত তাঁকে লাইনে দাঁড়িয়ে এক নজর দেখি। সকলের চোখে পানি। এ দৃশ্য দেখে স্থির থাকা সম্ভব নয়। অশ্রুসজল নয়নে জানাযায় শরীক হই। শাহাদাতের কয়েকদিন পূর্বে তাঁর সঙ্গে আমার সর্বশেষ কথা হয়। তিনি মোবাইলে আমাকে প্রথমে
বলেন, কেমন আছ? অতঃপর বলেন, আচ্ছা একটা কথা কি বলতে পার, খতিব সাহেব দেওবন্দ থেকে এসেই কি হাদিস পড়িয়েছেন? আমি বলি, হুজুর এক মিনিট। তিনি হাসি দিয়ে বলেন, এক মিনিট সময় তোমাকে দেওয়া হল। তাঁর পান খাওয়া মুখের সেই হাসি যেন আমি দেখছি। আজো দেখছি। আমি খতিব সাহেব হুজুরের লেখা কোরআনে হাকীম আওর হামারী যিন্দেগী গ্রন্থে মুদ্রিত তাঁর জীবনী পাঠ করে বলি, 'জ্বী, তিনি প্রথম বছরই বড় কাটরা মাদরাসায় হাদীস পড়িয়েছেন।' এ ছাড়া ইসহাক ফরিদী সাহেব মাঝে মধ্যে আমার কাছে ফোন করতেন। আমিও করতাম।
মাওলানা ইসহাক সাহেবের জানাযার নামাজে তাঁর বিশেষ উসতাদ ও মুরুব্বি মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ সাহেব আবেগ বিহ্বল কণ্ঠে বলেন, 'ছেলেটা আসল। বয়স কত হবে আর! দেখতে দেখতে ও আকাশ ছুঁয়ে ফেলল। আমরা মাটিতেই রয়ে গেলাম!'
আল্লামা মাসউদ সাহেব অনেক বড়। তিনি মাটিতে অবস্থানের কথা হয়তো বিনয়াবনত হয়ে বলেছেন। তবে ইসহাক সাহেব যে দেখতে দেখতে হঠাৎ করে আকাশ ছুঁয়ে ফেললেন-এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। তিনি যেন যুগ যুগান্তরের সঞ্চিত কর্মস্পৃহার তীব্রতা নিয়ে, বেদনা ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে জ্যৈষ্ঠের ঝড়ের ন্যায় হঠাৎ আগমন করলেন, আবার আকস্মাৎ চলে গেলেন। কাউকে না জানিয়ে অতি সন্তর্পণে চলে গেছেন- এ কথা বলা বোধহয় ঠিক হবে না। অনেককেই বলেছেন, অনেকবার বলেছেন। বলেছেন, এখন তাঁর বিদায়ের পালা; তাঁর আরাধ্য কাজের পরিসমাপ্তি।
তাঁর বিদায়ে তাঁর বন্ধুরা ও ছাত্ররা শুধু নয়, তাঁর উস্তাদ ও মুরুব্বি, এমনকি, উস্তাদের উস্তাদগণও ক্রন্দন করেছেন। আরো অনেক দিন করবেন।
কবি তালিম হোসেনের ভাষায়:
এক আসমান ভরিয়া দিয়াছ, হে দিশারী আফতাব!
এ মাঠের মাটি ফসলের বানে করিয়াছ সয়লাব।
আরেক আকাশ উজালা করেছ এ মাঠের পরপারে,
সেথা হতে তব প্রাণের রোশনী ছুঁয়ে যায় বারে বারে।
মহান রাহমানুর রাহিমের শাহী দরবারে আমাদের সকাতর প্রার্থনা: তিনি যেন মাওলানা মরহুমের ত্যাগ, কুরবানি ও শাহাদাত কবুল করে নেন, তাঁর ঔরসজাত ও রূহানি সন্তানদেরকে যেন সবরে জামীল এখতিয়ার করার তাওফিক এনায়েত করেন। আমিন।
-লেখাটি আল্লামা ইসহাক ফরিদী রহ. স্মারক গ্রন্থ থেকে নেওয়া
এনএ/