শনিবার, ০৩ মে ২০২৫ ।। ২০ বৈশাখ ১৪৩২ ।। ৫ জিলকদ ১৪৪৬


ইসলাম ও নারী উন্নয়ন : একটি বাস্তবভিত্তিক পর্যবেক্ষণ


নিউজ ডেস্ক

নিউজ ডেস্ক
শেয়ার
সংগৃহীত

||মুফতী হাফীজুদ্দীন||

বাংলাদেশে নারী উন্নয়ন নিয়ে সাম্প্রতিক আলোচনাগুলো এক নতুন মোড় নিয়েছে। শিক্ষা, অধিকার, কর্মসংস্থান ও সামাজিক অংশগ্রহণের মতো নানা ক্ষেত্রে নারীর অগ্রযাত্রা দৃশ্যমান হলেও, এই অগ্রগতির পেছনে যে চিন্তাধারাগত দ্বন্দ্ব ও বিতর্ক লুকিয়ে আছে, তা উপেক্ষা করার উপায় নেই। বিশেষ করে একটি প্রশ্ন ঘুরেফিরে সামনে আসছে - " ইসলাম কি নারী উন্নয়নের পথে অন্তরায় ?"

দুঃখজনক হলেও সত্য, এই অভিযোগ আজকাল কিছু আত্মবিস্মৃত, আত্মঘৃণায় নিমজ্জিত আধুনিক নারীবাদী ও তথাকথিত প্রগতিশীল গোষ্ঠীর মুখে নিয়মিত উচ্চারিত হচ্ছে। তারা ইসলামকে নারীর অবরুদ্ধ জীবনের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরতে চায়, অথচ ইতিহাস ও বাস্তবতা বারবার প্রমাণ করেছে ঠিক উল্টোটা। এই প্রবণতা কেবল বিভ্রান্তিকর নয় বরং আমাদের সমাজের স্বকীয় মূল্যবোধ, বিশ্বাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গেও এক নির্মম অবিচার।

" ইসলাম কি নারী উন্নয়নের পথে প্রতিবন্ধক ? " এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার পূর্বে আমাদের দরকার ইতিহাস, সমাজ ও ধর্মীয় দর্শনের নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ। কারণ, যেকোনো মূল্যায়নের আগে সত্যকে জানতে হলে আবেগ নয়, প্রয়োজন বাস্তবতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক সততা।


ইতিহাসের পাতা থেকে: ইসলামে নারীর মর্যাদা এক বিপ্লব

ইসলাম এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে আবির্ভূত হয়, যখন নারীর সামাজিক অবস্থান ছিল শূন্যের কোঠায়। আরব সমাজে কন্যাশিশু জন্ম ছিল অভিশাপস্বরূপ এবং অনেক বাবা তাদের জীবন্ত কবর দিয়ে দিত। এমন বর্বর সময়েই মুহাম্মদ (সা.) ঘোষণা করেন : "যে ব্যক্তি কন্যাসন্তান লালন-পালন করে, তাদের প্রতি সদ্ব্যবহার করে, তাকে জান্নাত দেওয়া হবে।" ( আল হাদীস)

এই একটি বাণীই সেই সমাজে নারী মর্যাদার ক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক যুগান্তর। ইসলাম নারীকে দিয়েছে ব্যক্তিসত্তা, অধিকার ও মর্যাদা। কোরআনে নারী ও পুরুষকে সমানভাবে সৃষ্টির অংশ বলা হয়েছে - "আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি"। (সূরা হুজুরাত: ১৩)
এই সাম্যবাদী ভাষ্য তখনকার কোনো ধর্মে ছিল না।

ইসলামে নারীর অধিকার: একটি পূর্ণাঙ্গ কাঠামো

১. শিক্ষার অধিকার: হাদীসে এসেছে, “জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর উপর ফরজ।” নারী শিক্ষাকে ইসলাম যে ফরজ ঘোষণা করেছে, তা মধ্যযুগীয় কোনো সমাজে কল্পনাই করা যেত না।

২. অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও মালিকানা:
খাদিজা (রা.) ছিলেন ইসলামপূর্ব যুগেই একজন স্বনির্ভর ও সফল ব্যবসায়ী। ইসলাম তাঁর সেই অধিকারকে মান্যতা দেয়। নারীর উপার্জন ও সম্পত্তি তাঁর একক মালিকানায় থাকার নির্দেশ ইসলামে সুস্পষ্টভাবে দেওয়া হয়েছে।

৩. উত্তরাধিকারের অধিকার:
ইসলাম নারীকে উত্তরাধিকার দিয়েছে এমন এক সময়, যখন পাশ্চাত্যে নারী ছিল পুরুষের মালিকানাধীন সম্পদ। খ্রিস্টান ইউরোপে ১৯ শতকের শেষ দিকে গিয়ে নারীরা উত্তরাধিকার পেতে শুরু করে, আর ইসলাম তা দিয়েছে ৭ম শতকেই।

৪. রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অংশগ্রহণ:
হযরত আয়েশা (রা.) ছিলেন হাদীসশাস্ত্র ও ইসলামী আইনব্যবস্থার অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্বান। সহস্রাধিক সাহাবী তাঁর নিকট থেকে জ্ঞান গ্রহণ করেছেন। যুদ্ধ, সামাজিক আলাপ, চিকিৎসা ও শিক্ষা - সবখানেই মুসলিম নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ ইতিহাসে দৃষ্টিগোচর হয়।

৫. বিয়ে ও পারিবারিক অধিকার:
ইসলাম নারীকে বিয়েতে মতামত প্রকাশের অধিকার দেয়। তাকে বাধ্য করে না। স্বামীর প্রতি যেমন দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি স্ত্রীর প্রতিও রয়েছে স্বামীর সুরক্ষা ও সম্মানের আচরণ। যেমনটি নবীজী সা. বলেছেন , “তোমরা নারীদের সাথে উত্তম আচরণ করো।” 

আধুনিক নারীবাদ একদিকে যেমন নারীর কিছু অধিকার রক্ষায় অবদান রেখেছে, অন্যদিকে একে কেন্দ্র করে অনেক বিভ্রান্তিও ছড়াচ্ছে তারা। নারীর “উন্নয়ন” বলতে কি শুধুই চাকরি, অর্থ বা বাইরে গিয়ে কাজ করাকেই বোঝায় ? নাকি উন্নয়ন বলতে বোঝায় - তার আত্মমর্যাদা, পারিবারিক শৃঙ্খলা, মাতৃত্বের স্বীকৃতি এবং একটি নিরাপদ সমাজব্যবস্থায় বসবাসের অধিকার ?

আজকের ভোগবাদী সংস্কৃতি নারীর ‘স্বাধীনতা’র নামে তাকে পণ্যে পরিণত করেছে। বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে বিনোদন জগত - নারীর শরীর এখানে কেবল পুঁজিবাদের বিক্রয়যোগ্য উপকরণ। অথচ ইসলাম নারীর শালীনতা, মর্যাদা ও নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। পর্দা নারীকে আবদ্ধ করে না বরং তাকে অন্যায় দৃষ্টির হাত থেকে মুক্ত রাখে। এটি একপ্রকার সামাজিক বর্ম।

বর্তমান সময়ে দুঃখজনক একটি চিত্র হলো নারী উন্নয়নের নামে অনেক সময় এমন কিছু আদর্শ চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে যা তাদের পারিবারিক জীবনকে ভেঙে দেয়, আত্মিক ভারসাম্য নষ্ট করে এবং তাদের 'মাতৃত্ব'কে অবজ্ঞার চোখে দেখে। এই প্রবণতা নারীকে একটি কর্পোরেট যন্ত্রে পরিণত করছে, যেখানে মূল্যবোধের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে কর্মদক্ষতা ও বাহ্যিক সফলতা।

আর যারা বলেন, “ইসলাম নারী উন্নয়নের পথে বাঁধা,” তাদের জিজ্ঞেস করা দরকার:
কোন ধর্ম নারীর সম্মানে বলে, “জান্নাত রয়েছে মায়ের পদতলে”?
কোন ব্যবস্থা নারীকে বলে—“তোমার উপার্জন তোমার, তথাপি স্বামীর উপরও রয়েছে ভরণপোষণের সম্পূর্ণ দায়িত্ব” ?
বর্তমান বাংলাদেশেই আমরা দেখতে পাই - হাজারো মুসলিম নারী চিকিৎসক, অধ্যাপক, প্রশাসক, উদ্যোক্তা ও দার্শনিক হিসেবে দৃষ্টান্ত স্থাপন করছেন। ইসলামী মূল্যবোধের ভিতর থেকেই তারা এগিয়ে যাচ্ছেন। তারা প্রমাণ করছেন ইসলাম নারীকে আটকে রাখে না বরং তার পূর্ণ সম্ভাবনাকে বিকশিত হতে সহায়তা করে।

ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা: নারীবান্ধব ইসলামী সমাজ :

নারী উন্নয়নের একটি পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা দিতে হলে পরিবার, শিক্ষা ও সমাজ এই তিনটিকে একত্রে দেখতে হবে। ইসলাম এ তিনটির মাঝেই ভারসাম্য বজায় রাখে। কাজেই নারীদের আধুনিক শিক্ষার পাশাপাশি কোরআন-সুন্নাহভিত্তিক মূল্যবোধ শেখাতে হবে।
নারীর উন্নয়ন যদি তার মর্যাদা, নিরাপত্তা, জ্ঞান, এবং আত্মিক বিকাশকে কেন্দ্র করে হয় - তবে ইসলাম একমাত্র পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা প্রদানকারী ধর্মব্যবস্থা। আধুনিক নারীবাদী শ্লোগান অনেক সময় নারীর প্রকৃত প্রয়োজনকে বাদ দিয়ে কেবল তার 'দেহ' ও 'বাহ্যিক স্বাধীনতা'কে গুরুত্ব দেয়।
মুসলিম নারীদের উচিত এখন আত্মবিশ্বাসের সাথে ইসলামী নারীতত্ত্বের সৌন্দর্য তোলে ধরতে হবে।

এসএকে/


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ