জহির উদ্দিন বাবর
তিনি ছিলেন একজন শিক্ষাবিদ। জীবনের বড় অংশটি ব্যয় করেছেন শিক্ষার পেছনে। লেখক-গবেষক হিসেবে দেশে-বিদেশে রয়েছে তাঁর খ্যাতি। আরবি, উর্দু, ফারসি তিন ভাষাতেই তাঁর দক্ষতা ঈর্ষণীয়। সংশ্লিষ্ট ভাষার বিজ্ঞজনেরা তাঁকে ভাষাবিদ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। আলেমদের মধ্যে বাংলা চর্চার সেই দুর্ভিক্ষের যুগে তিনি বাংলায় লিখেছেন, অন্যদের লিখতে উৎসাহিত করেছেন। তিনি একজন স্বভাবজাত কবিও। শিক্ষা সংস্কার আন্দোলনে আলেমদের মধ্যে তাঁর ভূমিকা অনন্য। একজন আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বও। যুগশ্রেষ্ঠ বুজুর্গ সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভীর উত্তরাধিকার বহন করেন। হাদিসের মসনদে ছিলেন সরব একজন শাইখুল হাদিস। প্রিন্সিপাল হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন দক্ষতার। দীনের প্রতিটি শাখায় রয়েছে তাঁর পদচারণা। তাঁর পরিচয় বহুমাত্রিক। তিনি আল্লামা সুলতান যওক নদভী রহ.। সারা দেশের আলেম-উলামা তাঁকে চেনে, জানে ও অভিভাবক হিসেবে গণ্য করে। ব্যক্তি-দুর্ভিক্ষের এই সময়ে তাঁর অস্তিত্ব ছিল অনেক বড় নেয়ামত। অবশেষে ৮৬ বছর বয়সে শুক্রবার (২ মে ২০২৫) রাতে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার এই আধার পাড়ি জমালেন পরপারের উদ্দেশে।
আল্লামা সুলতান যওক নদভী রহ.-এর জন্ম ১৯৩৯ সালে কক্সবাজারের মহেশখালীতে। বাবা সুফি আবুল খায়ের, মা রূহ আফজা বেগম। শৈশবে মাকে হারান। বেড়ে ওঠেন বাবার স্নেহে। প্রাথমিক পড়াশোনার সূচনা হয় নিজ গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পড়াশোনা সম্পন্ন করেন মহেশখালীতেই। পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রামের বিখ্যাত দীনি প্রতিষ্ঠান জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ার প্রতিষ্ঠাতা মুফতি আজিজুল হক (রহ.)-এর সুদৃষ্টি পড়ে তাঁর ওপর। তিনি ভর্তি হন পটিয়া মাদরাসায়। সেখানেই মাদরাসার শেষ দিকের ক্লাসগুলো সম্পন্ন করেন। মূলত জামিয়া পটিয়ায় পড়াশোনার সময়ই তখনকার বিখ্যাত শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে বহুমুখী যোগ্যতা অর্জন করেন।
আল্লামা সুলতান যওক নদভী রহ. পটিয়া মাদরাসায় ছয় বছর লেখাপড়া করে ১৯৫৯ সালে দাওরায়ে হাদিস উত্তীর্ণ হন। এরপর প্রথমে চট্টগ্রামের মাদরাসা রশিদিয়াতে শিক্ষকতা শুরু করেন। এখানে দুই বছর শিক্ষকতার পর বিখ্যাত আলেম মাওলানা আতহার আলী (রহ.)-এর আহ্বানে কিশোরগঞ্জের জামিয়া ইমদাদিয়ায় কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। এরপর কিছুদিন নিজ শ্বশুর মাওলানা আলী আহমদ বোয়ালভী (রহ.)-এর প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা হুসাইনিয়ার পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন। ১৩৮১ হিজরি সনে জামিয়া পটিয়া থেকে শিক্ষকতার ডাক আসে। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে নিজের কাঙ্ক্ষিত প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। আরবি সাহিত্যের বিখ্যাত কিতাবগুলো পড়ানোর দায়িত্ব পড়ে তাঁর ওপর। সঙ্গে হাদিস-তাফসিরসহ অন্যান্য বিষয় তো ছিলই। এখানেই তিনি শিক্ষকতার সোনালি অধ্যায়টুকু পার করেন। এতে তার হাতে গড়ে ওঠে এমন কয়েক ডজন ছাত্র যারা পরবর্তী সময়ে নানা অঙ্গনে বিখ্যাত হয়েছেন। এখানে তিনি দুই দফায় প্রায় ১৭ বছর শিক্ষকতা করেন। মাঝখানে সাত বছর তিনি পটিয়ায় ছিলেন না। দুই বছর চট্টগ্রাম শহরে একটি ব্যতিক্রমধর্মী প্রতিষ্ঠান গড়ার চেষ্টা করেন আর পাঁচ বছর শিক্ষকতা করেন মাদরাসায়ে আজিজুল উলুম বাবুনগরে।
পটিয়া মাদ্রাসায় থাকাকালে একদিকে তিনি ছাত্রদের যোগ্য করে গড়ে তোলার প্রয়াস চালান অন্যদিকে নিজেকে বহুমুখী যোগ্যতায় শাণিত করার চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। পটিয়ার তৎকালীন মুহতামিম হাজি মুহাম্মদ ইউনূস (রহ.)-এর পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি আরব বিশ্বে সফরের সুযোগ লাভ করেন। এছাড়া বিশ্ববিখ্যাত মুসলিম মনীষী মুফাক্কিরে ইসলাম সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.)-এর সান্নিধ্য লাভের সুযোগও পেয়ে যান। একবার সেমিনার উপলক্ষে লক্ষ্মৌর দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামায় গিয়ে দুই মাস অবস্থান করেন। সেই সময়টি তিনি গবেষণার কাজে ব্যয় করেন। তাঁর বিশেষ যোগ্যতা দেখে নদওয়াতুল উলামা কর্তৃপক্ষ তাঁকে আরবি সাহিত্যের ওপর ছাত্রদের পড়ানোর সুযোগ দেন। এটা ছিল তাঁর জন্য বিরল সম্মান। তখনই মূলত নদওয়াতুল উলামা কর্তৃপক্ষ তাঁকে নামের সঙ্গে নদভী উপাধি যুক্ত করার অনুরোধ করেন। নদওয়ায় নিয়মতান্ত্রিক পড়াশোনা না করেও নদভী উপাধি ধারণ এটা তাঁর বিশেষ বৈশিষ্ট্য। আলী মিয়া নদভী (রহ.)-এর অত্যন্ত প্রিয়ভাজন ছিলেন তিনি। যুগের এই মুজাদ্দিদকে বাংলাদেশে দুইবার আনার পেছনে মূল ভূমিকা রাখেন আল্লামা যওক। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি ছিলেন এদেশীয় নদভীদের প্রধান স্তম্ভ ও মাথার মুকুট।
পটিয়া মাদরাসায় থাকা অবস্থাতেই শিক্ষা সংস্কার ভাবনা আল্লামা সুলতান যওক নদভী রহ.-এর মধ্যে সক্রিয় হয়ে ওঠে। তিনি আশির দশকে ‘মাদরাসা শিক্ষা সংস্কারের ডাক’ নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন, যা সেই সময়ে দৈনিক আজাদে প্রকাশিত হয়। পরবর্তী সময়ে এটি পুস্তিকা আকারেও প্রকাশিত হয়। এতে মূলত তিনি মাদরাসা শিক্ষায় চলে আসা শত শত বছরের পুরনো পাঠ্যক্রমে সংস্কার ও সংশোধনের প্রস্তাব তুলে ধরেন। পৃথিবীতে কোনো সংস্কারই প্রথমে মানুষ সহজভাবে নেয় না। এখানেও তাই হয়েছে। একটি গোষ্ঠী তাঁর এই লেখাকে পুঁজি করে পেছনে লাগে এবং এক পর্যায়ে তিনি পটিয়া থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য হন।
পরবর্তী সময়ে তিনি ১৯৮৫ সালের দিকে চট্টগ্রাম শহরে গড়ে তোলেন বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান ‘মাহাদ দারুল মাআরিফ আল ইসলামিয়া’। সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.)-এর নির্দেশনায় গড়ে ওঠা এই প্রতিষ্ঠান থেকেই মূলত তিনি নিজের শিক্ষা সংস্কার আন্দোলনের সূচনা করেন। পাঠ্যক্রমকে আধুনিক যুগের ধর্মীয় চাহিদা অনুযায়ী অধিকতর উন্নত করার বাস্তবভিত্তিক আন্দোলন তিনি শুরু করেন এবং তাতে সফলও হন। এখানকার ছাত্ররা আরবি ভাষায় বিশেষভাবে যোগ্য হয়ে ওঠেন। অসংখ্য ছাত্র এই প্রতিষ্ঠান থেকে পড়াশোনা সম্পন্ন করে দেশে-বিদেশে কর্মরত। মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিশ্বের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে দারুল মাআরিফের মুআদালা (পারস্পরিক সনদ স্বীকৃতি) রয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এটি অনেক বড় সাফল্য, যা খুব কম প্রতিষ্ঠানেরই আছে।
আরবি লিখনির কারণে আরব বিশ্বে ব্যাপক কদর রয়েছে আল্লামা যওকের। তাঁর ব্যক্তিগত সুপারিশ সেখানকার অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়। তিনি রাবেতা আলমে ইসলামিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশ নিয়েছেন এবং প্রবন্ধ পাঠ করে প্রশংসা কুড়িয়েছেন। আন্তর্জাতিক সাহিত্য সংস্থা রাবেতা আদবে ইসলামির বাংলাদেশের ব্যুরো প্রধানের দায়িত্বও তিনি পালন করছেন। তিনি সৌদি আরব, ভারত, লিবিয়া, তুরস্ক, মিসর, শ্রীলঙ্কা, কুয়েত, আফগানিস্তান, মরক্কো, ওমান, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশ সফর করেছেন। ১৯৯০ সালে মক্কায় অনুষ্ঠিত রাবেতার কনফারেন্স চলাকালে বায়তুল্লাহ শরিফের অভ্যন্তরে প্রবেশের বিরল সৌভাগ্য লাভ করেন খ্যাতিমান এই আলেম।
আল্লামা সুলতান যওক রহ. বেশ কিছু কিতাব লিখেছেন, যা দেশে-বিদেশে বিভিন্ন মাদরাসায় পাঠ্যভুক্ত। এর মধ্যে আত্তরিক ইলাল ইনশা, কাসাসুন নাবিয়্যিন, যাদুত ত্বালিবিনের ব্যাখ্যাগ্রন্থ, নুখবাতুল আহাদিস, শিশুদের আরবি ভাষা শিক্ষা সিরিজ, রাহবারে উর্দু, আসান কাওয়ায়েদ এসব কিতাব উল্লেখযোগ্য। ‘আমার জীবনকথা’ নামে তাঁর আত্মজীবনী সর্বমহলে বেশ প্রশংসা পেয়েছে। এছাড়া মাদরাসা শিক্ষার সংস্কারে তাঁর লেখা ‘শিক্ষা সংস্কারের ডাক’ বাংলা ও আরবি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যায় ভুগলেও শেষ জীবনেও তিনি লেখালেখিতে ছিলেন সরব।
ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত অমায়িক একজন মানুষ। অনাড়ম্বর জীবনযাপনে অভ্যস্ত। দুই ছেলে ও পাঁচ মেয়ের জনক। ধর্মীয় ও সামাজিক প্রয়োজনে অশীতিপর বৃদ্ধ বয়সেও ছুটে চলেছেন অবিরত। রাজনৈতিকভাবে কোনো দলের সঙ্গে যুক্ত না হলেও জাতীয় প্রয়োজনে তিনি বিভিন্ন সময় আলেম-উলামার পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বিশেষ করে কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিসের সনদের স্বীকৃতি লাভের পুরো প্রক্রিয়ায় তিনি সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন এবং বিশেষ ভূমিকা রাখেন। দীনের ওপর যেকোনো আঘাত এলে বৃদ্ধ বয়সেও তিনি সরব হয়ে উঠতেন। আলেমদের মধ্যে বিভক্তি কমিয়ে ঐক্যের বন্ধন সৃষ্টিতেও তাঁর রয়েছে বিশেষ ভূমিকা। সময়ের প্রয়োজন বিবেচনায় দীনি খেদমতের বহুমুখী ক্ষেত্র বাছাই করতে তিনি নবীনদের উদ্বুদ্ধ করতেন। তাঁর এই চলে যাওয়ায় যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁকে মাগফেরাত ও রহমতের অফুরন্ত খাজানা দান করুন। আমিন।
লেখক: বার্তা সম্পাদক, ঢাকা মেইল; সম্পাদক, লেখকপত্র
আরএইচ/