|| আরাফাত নুর ||
প্রাইমারি থেকে অক্সফোর্ড, সাধারণ অফিস থেকে হোয়াইট হাউস, দিনমজুর থেকে শ্রেষ্ঠ ধনী, চলচ্চিত্রের অন্দরমহল থেকে ক্রিকেটপাড়া, আফ্রিকার জঙ্গল থেকে বিজ্ঞানী সংস্থা নাসা, সর্বত্রই দাওয়াতে তাবলিগের জোরদার মেহনত চলছে। একদল মরদে মুজাহিদ, দীনের দায়ী পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ছুটছেন।
ইসলামের আলো ছড়াচ্ছেন। ঈমানের নুর জ্বালাচ্ছেন। এছাড়া বিলগেটস, বারাক ওবামা, ডোনাল্ড ট্রাম্প, শাহরুখ খান আর ডেভিট ওয়ার্নারের মতো তারকারাও দীনের পথে চলে আসুক, ইসলামের রঙে রঙিন হোকÑ এই আশা ও প্রত্যাশা নিয়ে ঘর থেকে ঘরে, পথ থেকে পথে, দেশ থেকে দেশান্তরে ছুটে বেড়াচ্ছে দাওয়াতে তাবলিগের কাফেলা। তাবলিগের সাথী ভাইদের প্রেমের পরশ, কোনো দলমত কিংবা জাতি-গোষ্ঠীর জন্য নির্দিষ্ট নয়। সবাইকেই তারা দেখেন প্রণয়ের চোখে। প্রেম বিলানোর ক্ষেত্রে তারা কাউকে আলাদাভাবে দেখেন না। যাকেই তারা জীবন প্রকৃত স্রোতধারা থেকে দূরে দেখেন, তাদেরকেই আদর ও ভালোবাসায় ফিরিয়ে দেন জীবন প্রকৃত স্রোতধারা।
মেহনতি তাবলিগি ভাইদের এই ভালোবাসায় যেমন সোনালি জীবনের সন্ধান পেয়েছেন সিনেমার তারকা, সঙ্গীত পরিচালক, সিনেমা পরিচালক। তেমনি তাদের ভালোবাসায় সোনালি জীবনের সন্ধান পেয়েছেন বেশ কিছু ক্রিকেটার। আজ আমরা সোনালি জীবনের সন্ধান পাওয়া কিছু ক্রিকেটারের জীবনপাতা ছুঁয়ে আসবো
সাঈদ আনোয়ার
৬ সেপ্টেম্বর ১৯৬৮ সালে পাকিস্তানের করাচিতে জন্ম নেন। ওপেনিং ক্রিকেটারদের আইকন কিংবা আইডল যাই বলুন; তিনি কিন্তু ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছেন পূর্ণ যৌবনে। দুনিয়ার অর্থবিত্ত, যশখ্যাতি অর্জনের তখনও বেশ সুযোগ ছিল তার। কিন্তু মাত্র একটি ঘটনা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। আল্লাহর রাহের এই মুসাফির এখন দেশ-বিদেশে দাওয়াতের কাজে ছুটে বেড়ান। গত বিশ্ব ইজতেমায় বাংলাদেশে এসে তিনি প্রায় ২৫ দিন অবস্থান করেছিলেন। তার সুপথে ফিরে আসার পেছনে দীনের কেতনধারী জগদ্বিখ্যাত মুবাল্লিগ মাওলানা তারিক জামিল সাহেবের অবদান সর্বাধিক। সে সময় সাঈদ আনোয়ারের অর্থসম্পদ ইজ্জত-সম্মান কোনোটারই কমতি ছিল না। কিন্তু ইসলামের বিধি-বিধান না মানার কারণে তার মনে কোনো শান্তি ছিল না। রাতে দু'চোখের পাতা এক করতে পারতেন না। ঘুমের ওষুধ খেয়েও ঘুমাতে ব্যর্থ হতেন। মাওলানা তারিক জামিল তার এলাকায় তিন দিনের জামাতে এলেন। তিনি মাওলানার কাছে মনের অশান্তির কথা খুলে বললেন। মাওলানা তাকে বললেন- ‘ভাই! মসজিদে যাও । মসজিদে গিয়ে নামায আদায় করো। দীনি মেহনতে সময় লাগাও। দ্বীন মানার মধ্যেই শান্তি এবং কামিয়াবি। এতেই খুঁজে পাবে অনাবিল ও অফুরন্ত শান্তি।’ মাওলানার জাদুমাখা বক্তব্যে প্রভাবিত হয়ে সাঈদ আনোয়ার তিন দিনের জামাতে বের হয়ে যান। প্রথম দিনের অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে সাঈদ আনোয়ার বলেন- ‘প্রথম দিন মসজিদে ঘুমাতে গিয়ে যে শান্তি আমি পেয়েছি, আল্লাহর কসম! বিশ বছরেও আমি তা পাইনি।’ তারপর আদরের একমাত্র কন্যাকে রেখে তিনি মুলতানে একটি ক্রিকেট ম্যাচ খেলতে যান। খেলা শেষে স্ত্রী কম্পিত কণ্ঠে খবর দেন মেয়ে অসুস্থ। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে ডাক্তার মেয়েটিকে মৃত ঘোষণা করেন। এই ঘটনায় সাঈদ আনোয়ার অন্তরে প্রচণ্ড ধাক্কা খান এবং তখনই ক্রিকেটের অসমাপ্ত অধ্যায়কে চিরতরে বিদায় জানিয়ে এক চিল্লায় বের হয়ে যান।
হাশিম আমলা
ক্রিকেটের রানমেশিন খ্যাত দক্ষিণ আফ্রিকান এ ব্যাটসম্যান এখনও ঝড় তোলেন বাইশ গজে। এছাড়া তিনি মাঠের একজন সার্থক ফিল্ডার। তাকে যেখানে অধিনায়ক দাঁড় করান, সেদিক দিয়ে বল ছুটবে! তা কল্পনাতীত। তিনি কিন্তু ক্রিকেট মাঠের মতো নিজের ব্যক্তি জীবনেও পুরোপুরি সফল। তিনি একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান। নামাজ ও নিয়মিত কুরআন তেলাওয়াতের প্রতি তার বেশ গুরুত্ব। কখনও রমজানে মাঠে নামতে হলে রোজা রেখেই মাঠে নামেন তিনি। শুধু ধর্মীয় বিধি-নিষেধের কারণে নিজ ক্রিকেট দলের প্রধান স্পন্সর ‘ক্যাসেল’ (মাদক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান) এর লোগো সমৃদ্ধ টি-শার্ট পরেন না। শোনা যায়, এই লোগো ব্যবহার না করার কারণে ক্রিকেট বোর্ডকে নাকি কিছু অর্থও দণ্ড দিতে হয়।
আফতাব আহমদ
বাংলাদেশ জাতীয় দল ও আইসিএল এর হয়ে মাঠ কাঁপানো এই খর্বকায় ক্রিকেটারকে কে না চেনে? বিভিন্ন কারণে ক্রিকেটের সঙ্গে তিনি ততটা সক্রিয় নন। কিন্তু ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে যে দাগ রেগেছেন তিনি তা কি ভোলার মতো? ক্রিকেট মাঠের ঝড় তোলা এ ব্যাটসম্যান নিজের জীবনধারাকে ইসলামের ছোঁয়ায় পাল্টে নিয়েছেন। পাল্টে নিয়েছেন সখ, আহ্লাদ ও আনন্দের রূপ। তিনি দাড়ি রেখেছেন। নামাজ রোজায় যত্নশীল হয়েছেন। ক্রিকেটের পাশাপাশি তরুণদের রোজা-নামাজের জন্য উৎসাহিত যাচ্ছেন নিরলসভাবে। আর তা এই তাবলিগ মেহনতের ফসলেই।
রাজিন সালেহ
রাজিন সালেহও আফতাবের মতো বদলে গেছেন তাবলিগের ছোঁয়ায়। জাতীয় দল থেকে একরকম হারিয়ে গেলেও ঘরোয়া ক্রিকেটে তিনি সক্রিয়। তিনি ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে ক্রিকেট কোচিং দলের অধিনায়ক ছিলেন। নিয়মিত নামাজ কালাম ইবাদতে সময় দেন।
সোহরাওয়ার্দী শুভ
সোহরাওয়ার্দী শুভ। হঠাৎ করেই মুখভরা দাড়ি। চেহারায় শুভ্রতার ছাপ। জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক এই খেলোয়াড়ের এমন পরিবর্তনের কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, এর পেছনে সম্পূর্ণ ভূমিকা তাবলিগ জামাতের দীনি ভাইদের। জানা যায়, জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের নিয়ে সুযোগ পেলেই তিনি চলে যান তাবলিগে। তার দীনি কাজের নিপুণতায় অনেক ক্রিকেটারের গায়েই লাগছে দীনের শান্তির সমীরণ।
এছাড়া পাকিস্তানের মুশতাক আহমাদ, সাকলাইন মুশতাক, ইংল্যান্ডের আদিল রশিদ, মইন আলী, ওয়েইন পারলেন আর ইনজামাম-উল-হক প্রমুখ তারকারা ধর্মের মোড়কে তাবলিগের ছোঁয়ায় নিজেদের বদলে ফেলেছেন।
কেএল/