|| হাসান আল মাহমুদ ||
সওয়াবে ভরা ইবাদতের বসন্ত রমজান মাসের একটি নেক আমলকে আল্লাহ তায়ালা ৭০ গুণ সওয়াব বৃদ্ধি করে দেন মর্মে হাদিসে রয়েছে। দিনে রোজা পালন ও রাতে তারাবি, তাহাজ্জুদ, কুরআন তিলাওয়াতসহ গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত রয়েছে রমজানজুড়ে। এছাড়া, রয়েছে নফল নামাজ, তাসবিহ ইত্যাদি আমল। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ছাড়াও রমজানে বাড়তি বিশ রাকাত নামাজ নারী-পুরুষ সবার জন্যই প্রযোজ্য। একজন পুরুষ অফিস-কর্ম করে ইবাদত করার সুযোগ পেলেও অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় নারীকে রান্নাবান্না নিয়ে পড়ে থাকতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঘরোয়া কাজের চাপে নারী তারাবিসহ অন্যান্য ইবাদত করারও সুযোগ পান না। রমজানে ঘরোয়া কাজে সহযোগিতায় নারীকে ইবাদতমুখী করা যায় কীভাবে সে বিষয়ে কথা বলেছেন বিজ্ঞ আলেম ও সমাজগবেষকরা।
মিরপুর-১২ শহিদবাগ বায়তুস সুন্নাহ মাদরাসার মুহতামিম ও শহিদবাগ বায়তুল ফালাহ মসজিদের খতিব মুফতী শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘পুরুষের উপর যেমন রোজা ফরজ, তদ্রুপ নারীদের উপরও। তাই, এ মাসে বিভিন্ন নফল ইবাদতের প্রতি আগ্রহ তাদেরও থাকে। তাই ইফতারিতে খুব বেশি আইটেম তৈরি করার চাপ প্রয়োগ করাও অনুচিত। বরং তাদের কষ্ট লাঘব করে নফল ইবাদতে সুযোগ দেয়া প্রয়োজন’।
রাসুল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের কষ্ট দূর করে, আল্লাহতায়ালা কেয়ামতের দিন তার একটি কষ্ট দূর করবেন। (সহিহ মুসলিম ৩৮)
অন্য এক হাদিসে আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) নিজের কাপড় নিজে সেলাই করতেন, জুতা মেরামত ও সাংসারিক যাবতীয় কাজ করতেন। (ফাতহুল বারী ১৩/৭০)
তিনি বলেন, ‘নারীরা অসহায় প্রতিবেশীদের মধ্যে খাবার বিতরণ করে সওয়াবের অংশীদার হতে পারে, যদিও তার পরিমাণ খুব সামান্য হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে সে একজন দাস মুক্ত করার সওয়াব পাবে এবং তার পাপ মার্জনা করা হবে।
বিশিষ্ট আলোচক ফলপট্টি জামে মসজিদ মিরপুর-১০ এর খতিব মুফতি আজিজুর রহমান মাদানী বলেন, সারা বছরই আমাদের নারীরা ঘর গোছান, রান্না করেন, খাবার পরিবেশন করেন, ছেলে-মেয়ের পড়াশোনা- খাবার, গোছল ও স্বাস্থ্যের যত্ন নেন। নারীরাই সবার আগে বিছানা ছাড়েন, ক্লান্ত শরীরে ঘুমঘরে যান সবার পরে। সাংসারিক এসব কাজে পুরুষদের অংশ গ্রহণ সামান্যই বলা চলে। অথচ ইসলামের নবী (সা.)-এর জীবনের চিত্র ভিন্ন রকম। আম্মাজান হজরত আয়েশা (রা.) কে জিজ্ঞেস করা হলো, রাসুল (সা.) ঘরে কী কাজ করতেন? প্রতি উত্তরে আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) ঘরোয়া মানুষদের সেবায় বিভিন্ন কাজে অংশ নিতেন। নামাজের সময় হলে বেরিয়ে যেতেন। (বোখারি শরিফ : ৫০৪৮)।
তিনি বলেন, ‘একটি পরিবারে সুখ-শান্তি তখনই বিরাজ করে; যখন কোনো পুরুষ তার স্ত্রীর কাজকে সম্মান ও স্বীকৃতি দেয়। প্রশংসা করে। নিজ হাতে ঘরের কাজে স্ত্রীকে সহযোগিতা করে। প্রচণ্ড শীতে কিংবা গরমে রোজ বিহানে সবার আগেই বিছানা ত্যাগ করে কর্মব্যস্ত স্বামীর কাজে সহযোগিতা ও সন্তান-সন্ততির স্কুল-কলেজ, মাদরাসায় যাওয়ার প্রস্তুতিতে লেগে যান স্ত্রীরা। আবার সারা দিনের কাজের ফলে ক্লান্ত-অবসন্ন শরীরে ঘুমাতেও যান সবার পরে।’
এই সময় তিনি মত দেন, ‘তবে, নারী ইফতার-সাহরির রান্নাবান্না করেও ইবাদতের সওয়াব পেতে পারেন। কারণ, নারীর রান্না করা খাবার খেয়ে রোজাদার যে রোজা রাখেন আর ইফতার করেন সে রোজার সওয়াব তিনিও পেয়ে যান ‘।
এদিকে বহুগ্রন্থপ্রণেতা লেখক ও সমাজগবেষক মেহেরুন রুমা বলেন, ‘রমজান মাসে একজন নারীর সিয়াম পালনরত অবস্থায় তার কোন কাজ কমে যায় না। বরং ঘরের কাজ অনেকাংশে বেড়ে যায়। যেসব নারী বাইরে কাজ করেন তাদের ঘর-বাহির উভয় সামলাতে যেয়ে হিমশিম খেতে হয়। রমজানে অফিসের কর্মঘণ্টা কমিয়ে আনা হয়, এটা সুখকর হলেও এর ফল একজন নারী খুব কমই পায়। নারীকে ঘরে এসেই ইফতার তৈরি, রাতের খাবার রান্নায় ব্যস্ত হতে হয়’।
তিনি বলেন, ‘খুব কম পুরুষই আছেন যারা ঘরের কাজে নারীকে সাহায্য করেন। আসলে ঘরের কাজটিকে যদি উভয়ের কাজ হিসেবে গণ্য করা হয় এবং একজন পুরুষ যদি মনে করেন যে, ঘরের নারীটিও রোযাদার,তারও শরীর ক্লান্ত থাকতে পারে,তারও নামাজ আছে, তারও তারাবি আছে। তারও বিশ্রাম প্রয়োজন। এই চিন্তা থেকে সে যদি ঘরের কাজ ভাগাভাগি করে নেয় তাহলে একা নারীকে এত পরিশ্রম করতে হয় না’।
তিনি উল্লেখ করেন, ‘ঘরে ঘরে আমাদের নারীদেরকে দেখা যায় রোযা রাখে ঠিকই, কিন্তু সংসারের কাজ করতে করতে দিনশেষে এত ক্লান্ত হয়ে পড়ে যে রাতে তারাবি নামাজ পড়তে পারেন না। অনেকে তো মনে করে নারীদের তারাবি পড়তে হয় না। সময় করে যে একবেলা কুরআন তিলওয়াত করবে সেটুকু সময়ও একটা মেয়ে বের করতে পারে না। ইবাদত যার চিন্তাও তার বেশি থাকা দরকার। নারীকেও রমজানের প্রস্তুতি নিতে হবে, ঘরে ইবাদতের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে’।
হাআমা/