||কাউসার লাবীব||
বাংলাদেশ কুরআনপ্রেমী মানুষের দেশ। কুরআনকে ভালোবেসে প্রতি বছর শত শত মুসলমানের সন্তান কুরআন হিফজ করছে। কুরআন হিফজের পর এটিকে স্মৃতিতে ধরে রাখা গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। পবিত্র কুরআনকে স্মৃতিতে ধরে রাখতে আমাদের দেশে তারাবিকে অন্যতম মাধ্যম হিসেবে মনে করা হয়। তাই হাফেজ সাহেবরাও প্রাণপন চেষ্টা করেন প্রতি বছর মনের মতো একটি মসজিদে তারাবি পড়ানোর জন্য। কিন্তু বেশ কয়েক বছর ধরে রমজান এলেই হাফেজ সাহেবদের তারাবি না পাওয়ার একটি হাহাকার তৈরি হয়! সামনে আসে নানান প্রস্তাবনা। রমজানে হাফেজ সাহেবদের তারাবি না পাওয়ার আক্ষেপ গুচাতে কী পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে এ নিয়ে কথা বলেছিলেন দেশের কয়েকজন বোদ্ধা আলেম এবং হাফেজের সঙ্গে
‘যে পরিমাণ হাফেজ বের হচ্ছে প্রতি বছর, সে পরিমাণ নতুন মসজিদ কি তৈরি হচ্ছে? যদি না হয় তাহলে হাফেজদের তারাবি না পাওয়ার সমস্যা থেকে কীভাবে বেরিয়ে আসা যেতে পারে?’ জানতে চেয়েছিলাম জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের সিনিয়র পেশ ইমাম মুফতি মিজানুর রহমান কাসেমীর কাছে।
তিনি বলেন, প্রথমে জানতে হবে তারাবির জন্য মসজিদ শর্ত নয়। একমাত্র কুরআন মুখস্থ রাখার উদ্দেশ্যেই যদি কেউ তারাবি খুঁজে থাকে তাহলে তার জন্য অনেক পথ খোলা আছে। মসজিদে ইশার নামাজ আদায় করে ঘরে এসে আত্মীয়দের নিয়ে তারাবি পড়তে পারে। কয়েক বাড়ির মুসল্লিদের নিয়ে কোনো উঠান বা ময়দানে নিজেদের মতো করে তারাবির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ঢাকায় বিল্ডিং, এপার্টম্যান্টের ছাদে তারাবির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। একান্তই এমন না হলে তারাবি না পাওয়া দুইজন হাফেজ মিলে নিজেরা তারাবি পড়তে পারে। এর ফলে তারাবি না পড়ালে ‘ইয়াদে’ যে ঘাটতি আসার সম্ভাবনা সেটি কেটে যাবে বলে মনে করি।
তিনি উল্লেখ করেন, ওইদিন একটা লেখা চোখে পড়লো, ‘প্রতি বছর শত শত হাফেজ তৈরি করা হচ্ছে। কিন্তু তাদের তারাবির ব্যবস্থা কেউ করছে না। আগে তারাবির ব্যবস্থা করে তারপর হাফেজ বানানো দরকার।’ লেখাটি পড়ে খুবই মর্মাহত হলাম। হাফেজ কি শুধু তারাবির জন্যই তৈরি হয়! পবিত্র কুরআন হিফজের পেছনে রয়েছে ইসলামের মহান এক উদ্দেশ্য। তাই চাহিদা মতো তারাবি না পেলে মনক্ষুণ্ণ হওয়ার কিছু নেই।
একই প্রশ্ন করেছিলাম শিক্ষাবিদ আলেম অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা ফজলে বারি মাসউদের সঙ্গে। তার মতে, হাফেজের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও অনেক মসজিদ কমিটিই তারাবির জন্য মানসম্পন্ন হাফেজ না পাওয়ার অভিযোগ করছেন। তাই হাফেজ সাহেবরা শুধু রমজানের প্রাক্কালে তারাবির জন্য তিলাওয়াত না করে, যদি নিয়মিত তিলাওয়াত করে যায় তাহলে তাদের ‘ইয়াদ’ নিয়ে চিন্তায় পড়তে হবে না।
তাছাড়া প্রতিযোগিতার এই সময়ে মসজিদে তারাবি না পাওয়ার অভিযোগটিও উড়িয়ে দেয়া যায় না। তবে মসজিদে তারাবি না পেলে হতাশ হওয়ার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। প্রায় প্রতিটি মাদরাসাতেই ছোট ছোট করে প্রচুর তারাবির জামাত হয়। এসব জামাত কাজে লাগিয়েও কিন্তু নিজেদের ইয়াদকে প্রখর রাখা যেতে পারে। তাছাড়া বড় কোনো মসজিদের যদি তারাবি না পাওয়া যায় পাঞ্জেগানা মসজিদ ও বিভিন্ন এপার্টম্যান্ট, মার্কেট ইত্যাদি জায়গা থাকা নামাজের মুসল্লাতেও কিন্তু তারাবি পড়ানো যেতে পারে।
কথা বলেছিলাম গত রমজানে তারাবি না পাওয়া কয়েকজন হাফেজ সাহেবের সঙ্গে। তারা বলছেন, তারাবির নামাজে দুইয়ের অধিক হাফেজে কুরআন নিয়োগের প্রচলন হওয়া দরকার। প্রয়োজনে একজনের হাদিয়া কয়েকজনের মাঝে ভাগ করে দিন। এতে অনেক হাফেজে কুরআন তাদের ইয়াদ ঠিক রাখতে পারবে।
তাদের মতে, সবচেয়ে বড় কথা হলো মানসিক চাপ, পারিবারিক প্রেসার ও সামাজিক কটুকথা থেকে মুক্তি পাবে হাফেজরা। এখন হাদিয়া কম-বেশির চেয়ে মসজিদ পাওয়াটাই দুষ্কর হয়ে গেছে। প্রতি বছর নতুন অনেক হাফিজে কুরআন ফারেগ হয়। দেখা যায়, মসজিদের তুলনায় হাফিজদের সংখ্যা অনেক বেশি। তাই প্রতি মসজিদে দুইয়ের অধিক নিয়োগ দেওয়া এখন সময়ের দাবি। রমজানে তারাবিহ এবং খতমে কুরআন একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত। তাছাড়া হাফিজ সাহেবদের কুরআন মাজিদ ইয়াদ রাখার জন্য তারাবিহ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি মাধ্যম।
হাফেজ সাহেবদের এই কথাগুলো তুলে ধরেছিলাম প্রতিবেদনে মতামত নেয়া দুই আলেমের কাছে। তারা বলছেন, তারাবির নামাজ যেহেতু আমাদের দেশের হাফেজ সাহেবদের কুরআন ইয়াদ রাখার অন্যতম মাধ্যম, তাই দুইয়ের অধিক হাফেজ নিয়োগ দেয়া মন্দ কিছু নয়। বরং তারাবির নামাজ তিনজন, চারজন, পাঁচজন, এমনকি দুই রাকাত করে দশজনও পড়াতে পারে। এর ফলে অনেক হাফেজ তারাবি পড়ানোর সুযোগ পাবে। মুসল্লিরাও বিভিন্ন রকম লাহানে কুরআন তিলাওয়াত শুনে হৃদয় জুড়াতে পারবে।
‘তবে আমাদের দেশে তারাবির পর বড় একটি হাদিয়া দেয়ার প্রচলন আছে। তাই মসজিদ কমিটি ভাবে, এতো হাফেজ সাহেব নিলে তাদেরকে হাদিয়া দিবো কোত্থেকে? তাছাড়া নিয়োগ পাওয়া দুই হাফেজ সাহেব ভাবেন হাফেজ সাহেব যত বাড়বে, হাদিয়ার অঙ্কটাও ততো কমবে। তাই তারাবি পাওয়া অনেক হাফেজ সাহেবরাও চান না দুইয়ের অধিক হাফেজ নিয়োগ দেয়া হোক। তাই সবাইকেই দুনিয়াবি লাভের আশা থেকে বের হয়ে একমাত্র আল্লাহর রাজি-খুশির জন্য তারাবি পড়াতে হবে। তাহলেই প্রতিটি মসজিদে তারাবির ইমামতির জন্য হাফেজের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া সম্ভব।’ যোগ করেন এই দুই বোদ্ধা আলেম।
কেএল/