মুফতি সফিউল্লাহ ।।
একটি শান্তিময় পারিবারিক জীবন গড়ার মাধ্যম হলো বিবাহ। সুখী পরিবার গঠন, মানুষের জৈবিক চাহিদা পূরণ এবং মানসিক প্রশান্তি লাভের মাধ্যম হচ্ছে বিয়ে।
বিবাহের অন্যতম শর্ত হলো দেনমোহর।
কোনো নারী তার সঙ্গে বিবাহবন্ধনের কারণে সে তার স্বামীর উপর যে মালের হকদার হয়, তাই দেনমোহর। দেনমোহর ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ফরজ। কিন্তু এ বিষয়ে আমাদের সমাজে চরম অজ্ঞতা ও শৈথিল্য বিরাজমান।
দেনমোহর নারীর একটি অন্যতম পরিশোধ ও আদায় যোগ্য প্রাপ্য অধিকার। ইসলামী আইনে বিয়ে বৈধ হওয়ার জন্য যেসব শর্ত পালন করতে হয়, তার মধ্যে দেনমোহর আদায় করা অন্যতম শর্ত।
তা আদায় করা স্বামীর অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। বিয়েতে দেনমোহর নির্ধারণের বিষয়টি ইসলামের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। দেনমোহর কোন পণ্যমূল্যের চুক্তি নয় বরং দেনমোহর হলো নারীর সম্মান ও মর্যাদাস্বরূপ। তাই এমন ধ্যান ধারণা রাখা যে দেনমোহর দেওয়া মানে নারীকে কিনে নেওয়া মূর্খতা ছাড়া কিছুই না। দেনমোহর শুধু দান নয়, দেনমোহর নারীর অর্থনৈতিক প্রাপ্য অধিকার।
পুরুষের জন্য একটি ফরজ বিধান যাতে ফাঁকি দেওয়ার কোন সুযোগ নেই এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি লেনদেন। দেনমোহর একটা ঋণ বিশেষ। এটা পরিশোধ করা অত্যন্ত জরুরী। অন্যান্য ওয়াজিব ঋণ যেমন সন্তুষ্টচিত্তে পরিশোধ করা হয়, স্ত্রীর মোহরের ঋণও তেমনি সন্তুষ্টচিত্তে, উদার মনে জরিমানা মনে না করে পরিশোধ করা কর্তব্য।
আল্লাহতায়ালা বলেনوَاٰتُوا النِّسَآءَ صَدُقٰتِہِنَّ نِحۡلَۃً ؕ فَاِنۡ طِبۡنَ لَکُمۡ عَنۡ شَیۡءٍ مِّنۡہُ نَفۡسًا فَکُلُوۡہُ ہَنِیۡٓــًٔا مَّرِیۡٓــًٔا অর্থঃ আর তোমরা স্ত্রীদেরকে তাদের মোহর দিয়ে দাও খুশীমনে। তারা যদি খুশী হয়ে তা থেকে অংশ ছেড়ে দেয়, তবে তা তোমরা স্বাচ্ছন্দ্যে ভোগ কর। ( আন নিসা, আয়াতঃ ৪)
মুফতি শফি রাহিমাহুল্লাহ এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেনঃ চাপ প্রয়োগ কিংবা কোন প্রকার জোর-জবরদস্তি করে ক্ষমা করিয়ে নেওয়া কোন অবস্থাতেই ক্ষমা নয় । তবে স্ত্রী যদি স্বতঃস্ফূর্তভাবে দেনমোহরের অংশ বিশেষ মাফ করে দেয় কিংবা পুরোপুরিভাবে বুঝে নিয়ে কোন অংশ স্বামীকে ফিরিয়ে দেয়, তবে ভোগ করা জায়েয হবে।
দেনমোহর নারীর প্রাপ্য অধিকার।
তার স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতি ছাড়া অন্য কারো তাতে হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই। স্বামী স্ত্রীকে দেনমোহর থেকে বঞ্চিত করতে, কিংবা পরিশোধ করার পর ফেরত নিতে পারে না। স্বামী যদি চাপ দিয়ে বা কৌশলে পূর্ণ দেনমোহর বা কিছু অংশ মাফ করিয়ে নেয় তাহলে আল্লাহর বিচারে তা মাফ হবে না।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম বলেছেন أَلَا لَا تَظْلِمُوا ، إِنَّهُ لَا يَحِلُّ مَالُ امْرِئٍ إِلَّا بِطِيبِ نَفْسٍ مِنْهُ ، أَلَا وَإِنَّ كُلَّ সাবধান! জুলুম করো না। মনে রেখো, কারো পক্ষে অন্যের সম্পদ তার আন্তরিক তুষ্টি ব্যতীত গ্রহণ করা হালাল হবে না। (মুসনাদে আহমদ হাদিস নং -২০২৫৯)
দেনমোহরের পরিমাণ : দেনমোহরের সর্বোচ্চ কোন পরিমান শরীয়তে নির্ধারিত নেই । পুরুষ তার সামর্থ্যানুযায়ী যত খুশি দেনমোহর নির্ধারণ করতে পারবে। দুপক্ষের আলাপের ভিত্তিতে দেনমোহরের পরিমাণ নির্ধারণ করা উত্তম । বরের সামর্থের দিক বিবেচনায় রেখে ঠিক করা জরুরী।
আর মহরে ফাতেমী হল হযরত ফাতেমা রা.-এর বিবাহের সময় যে মোহর নির্ধারিত হয়েছিল। যার পরিমাণ ছিল পাঁচ শত দিরহাম। (তবকাতে কুবরা ৮/২২)
যা বর্তমান ওজন অনুপাতে ১৩১.২৫ তোলা বা১.৫৩০৯ কিলোগ্রাম রূপা। এক দিরহামের ওজন হল ৩.০৬১৮ গ্রাম, বর্তমানে প্রতি তোলা রুপার মূল্য ১২০০ টাকা হলে মহরে ফাতেমীর মূল্য হয় ১,৫৭,৫০০/- টাকা।
মহরে ফাতেমী শরীয়ত নির্ধারিত কোনো পরিমাণ নয়। যে এর চেয়ে কম বেশি করা শরীয়তে অপছন্দনীয়। স্বামী যদি মহরে ফাতেমীর চেয়ে বেশি দেনমোহর দেওয়ার সামর্থ্য রাখে, তাহলে মহরে ফাতেমী নির্ধারণের দ্বারা স্ত্রীকে ঠকানো হয়।
আর স্বামী যদি মহরে ফাতেমী দেওয়ার সামর্থ্য না রাখে তাহলে অভিভাবকদের জোরপূর্বক মহরে ফাতেমী নির্ধারণ করাটা স্বামীর উপর জুলুম। তবে উভয়পক্ষ যদি পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে নির্ধারণ করে এবং মনে করে যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর নির্ধারিত পরিমাণটি বরকতপূর্ণ তাই তা গ্রহণ করা ভালো। তাহলে তা প্রশংসনীয়।
আমাদের সমাজে দেনমোহরের বহুবিধ কুপ্রথা প্রচলিত আছে যার ফিরিস্তি অনেক লম্বা। অনেক সময়তো মহর শুধু নামমাত্র কাবিননামায় উল্লেখ থাকে, তা আদায়ের কোন নিয়তই থাকে না।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন مَا مِنْ رَجُلٍ يَنْكِحُ امْرَأَةً بِصَدَاقٍ، وَلَيْسَ فِي نَفْسِهِ أَنْ يُؤَدِّيَهُ إِلَيْهَا إِلَّا كَانَ عِنْدَ اللَّهِ زَانِيًا،) যে বিবাহ করল এবং দেনমোহর শুধু ধার্য্য করল কিন্তু তার অন্তরে দেনমোহর আদায় করার নিয়ত নেই, তাহলে আল্লাহর দরবারে তাকে যিনাকারী হিসাবে গণ্য করা হবে। (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক ৬/১৮৫)
আবার কখনো কনে পক্ষের চাপাচাপিতে এত পরিমাণ দেনমোহর নির্ধারণ করা হয় যা বরের সাধ্যের বাইরে। তাদের উদ্দেশ্য থাকে যেন স্বামী কখনো তালাকের পথে যেতে সাহস না পায়। আর মুখে মুখে থাকে দেনমোহর কি ছেলেকে আজই পরিশোধ করতে হবে? ছেলে-মেয়ে ঠিক থাকলে এর হিসাব কেউ নিতে যাবে না।
দেনমোহরের সর্বনিম্ন পরিমাণঃ হানাফী মাযহাবে দেনমোহরের সর্বনিম্ন পরিমাণ হল দশ দিরহাম, যা বর্তমান ওজন অনুপাতে দুই তোলা সাড়ে সাত মাশা বা ৩০.৬১৮ গ্রাম রূপা।
বর্তমানে প্রতি তোলা রূপার মূল্য ১২০০/- টাকা হলে ১০ দিরহামের মূল্য দাঁড়ায় ৩,১৫০/- টাকা। সর্বনিম্ন পরিমাণ দেনমহর নির্ধারিত থাকার উদ্দেশ্যে এই নয়, যে সর্বনিম্ন পরিমাণ মোহর নির্ধারণ করা শরীয়তে প্রশংসনীয়। বরং এর উদ্দেশ্য হলো যে এর চেয়ে কমে স্ত্রী রাজি হলেও জায়েজ নয়।
সর্বনিম্ন পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে সমাজের নিঃস্ব ব্যক্তিরাও যাতে বিবাহ করতে পারে। কিন্তু আমাদের সমাজের সামর্থ্যবান কিছু মানুষের মাঝেও এই প্রবণতা বিদ্যমান যে দেনমোহর কম দিয়ে নারীকে যত ঠকানো যায়। শরীয়তে এটা প্রশংসনীয় নয়। আমার এক সহপাটি শিক্ষকের বোনের বিবাহের আলাপ চূড়ান্ত হয় একজন সামর্থ্যবান ব্যক্তির সাথে, আমার জানামতে ঐ লোকের মাসিক আয় প্রায় লক্ষ টাকার উপরে। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো ঐ সামর্থ্যবান ব্যক্তি ৩০ হাজার টাকার বেশি এক টাকাও দেনমোহর দিবে না বলে ঘাপটি মেরে বসে। এমন মানসিকতার কারণে পরিশেষে বিয়েই ভেঙ্গে যায়।
সমাজে এমন মন-মানসিকতার লোক ভুরিভুরি। দেনমোহর নারীর জন্য সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক। প্রত্যেক স্বামীরই উচিত তার আর্থিক সামর্থ্যানযায়ী স্ত্রীকে যথাযথ সম্মান দেখানো।
দেনমোহর নিয়ে বাড়াবাড়ি যেমন ঠিক নয়, তেমনি ছাড়াছাড়িও ঠিক নয়। আমাদের সকলের উচিত উভয় পক্ষের আলপের ভিত্তিতে এ পরিমাণ মোহর ধার্য করা যাতে স্ত্রী না ঠকে এবং স্বামীর আদায় করতেও কষ্ট না হয়।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দেনমোহরের গুরুত্ব বুঝে তা আদায় করার তাওফিক দিন। আমীন!
-এটি