রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সাম্যের ভিত্তিতে সংবিধান রচনার আহ্বান নেপালে ফের কুরআন প্রতিযোগিতার আয়োজন করছে সৌদি আগামীকাল সংবিধান সংস্কার কমিশনে প্রস্তাবনা পেশ করবে ইসলামী আন্দোলন ‘আল্লামা আতহার আলী রহ. জীবন, কর্ম, অবদান’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন আগামীকাল হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রহ. : কে এই মহান ব্যক্তি হাজিদের স্বার্থ রক্ষায় সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ : ধর্ম উপদেষ্টা মহানবীকে সা. নিয়ে কটূক্তি করলে সংবিধানে শাস্তির বিধান রাখার প্রস্তাব পার্থের নতুন নির্বাচন কমিশন প্রত্যাখ্যান জাতীয় নাগরিক কমিটির ফুলপুরে জমিয়তের কমিটি গঠন স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিতে চাই: সিইসি নাসির উদ্দীন

জাতীয় পর্যায়ে মুফতি বোর্ড হওয়া দরকার

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

দেশের শীর্ষস্থানীয় মুফতিদের একজন। স্বতন্ত্রধারার শিক্ষা গবেষণা প্রতিষ্ঠান শাইখ যাকারিয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত পরিষদ বাংলাদেশের মহাসচিব। দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন- স্বতন্ত্র মুফতি বোর্ডের প্রয়োজনীয়তা, শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রবণতা, ভাড়া বাড়িতে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা, উত্তরাধিকার বঞ্চিত ও সকালের মক্তব শিক্ষা প্রসঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রায়হান রাশেদ।


গণমাধ্যম: প্রতিবেশীর সঙ্গে মুসলমানের কেমন আচরণ হওয়া উচিত?

মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদ: মুসলমানের ওপর ছয়টি হক রয়েছে। এর একটি প্রতিবেশীর হক, এটা আবশ্যকীয় বিষয়। এ ব্যাপারে হজরত রাসুলুল্লাহ সা.-এর অনেক হাদিস রয়েছে। এগুলো অধ্যয়ন করলে বুঝতে পারবেন, এত কঠোর নির্দেশনা অন্য হকের ব্যাপারে নেই। ইসলামের সৌন্দর্য এটাই যে, ইসলাম শান্তিপূর্ণ পরিবেশ চায়, শান্তিপূর্ণ সমাজ চায়। মানুষের অধিকার চায়, কাউকে অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখার সুযোগ ইসলামে নেই। সামাজিক অধিকারের মধ্যে সবচেয়ে বড় হলো প্রতিবেশীর অধিকার। অনেকেই প্রতিবেশীর হক সম্পর্কে জ্ঞান রাখে না। চোখের সামনে প্রতিবেশীর ক্ষতি হলেও তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করে না। এগুলো কাম্য নয়।

গণমাধ্যম: কাউকে ওয়ারিশ থেকে বঞ্চিত করলে কোন ধরনের গোনাহ হয়?

মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদ: হাদিসে স্পষ্টভাবে বলা আছে, সন্তানদের মধ্যে সম্পদ বণ্টনে কমবেশি করা যাবে না। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) বলেন, অন্য সন্তানদের ওপর জুলুম না করে বিশেষ বিবেচনায় কাউকে বাড়তি সম্পদ দেওয়া যাবে। এর মধ্যে অন্য সন্তানদের বঞ্চিত করার নিয়ত থাকা হারাম। হাদিসে আছে, যে সন্তানকে অন্যায়ভাবে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করবে, আল্লাহ তাকে জান্নাতের উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করবেন। ওয়ারিশ থেকে বঞ্চিত করার কারণে আল্লাহর নবী জান্নাত থেকে বঞ্চিত করার হুমকি দিয়েছেন। এর থেকে বড় হুঁশিয়ারি আর কী হতে পারে?

গণমাধ্যম: সকালের মক্তব কীভাবে আগের মতো প্রাণ ফিরে পেতে পারে?

মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদ: এই প্রশ্নের দুটি দিক আছে। একটি হলো সকালের মক্তবে এখন বাচ্চারা যেতে পারছে না। কারণ, সকালে ঘুম থেকে উঠেই তাদের স্কুলে যেতে হচ্ছে। খুব কৌশলে মুসলমানের সন্তানদের ইসলামের মৌলিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করতে মক্তবের সময়ে স্কুলের ক্লাস শুরু করেছে। সরকার, প্রশাসন ও জনগণ মিলে যদি একটা সময় নির্ধারণ করে যে, সকালে বাচ্চারা মক্তবে পড়বে। তারপর স্কুলে যাবে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী তো বলেছেন, ‘বাঙালিদের শিক্ষাই শুরু হয় মক্তব থেকে।’ সেই মক্তব যদি সকাল থেকে ৮ পর্যন্ত চলে, তাহলে আমরা মক্তবগুলো ফিরে পাব।

আরেকটি হলো আলেমরা মক্তবের পড়াকে নুরানির ক্লাসে নিয়ে গেছেন। সেখানে ইসলাম ও কোরআন শিক্ষার পাশাপাশি সাধারণ শিক্ষাও আছে। স্কুলের বিকল্প ইসলামি স্কুল শুরু করেছেন। সকালে বাচ্চারা মক্তবে না এলেও তারা কিন্তু নুরানিতে পড়ছে। আমি মনে করি, আগের মক্তব থেকে এখনকার নুরানিতে আমাদের সন্তানরা আরও বেশি উপকৃত হচ্ছে।

গণমাধ্যম: শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। এটাকে কোন দৃষ্টিতে দেখবেন?

মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদ: আত্মহত্যা থেকে বাঁচানোর উপায় হলো, যে সব কারণে মানুষ আত্মহত্যা করে, সেগুলো চিহ্নিত করা। কেউ শুধু শুধু আত্মহত্যা করে না। সবারই জীবনের প্রতি মায়া আছে। আমি মনে করি, আত্মহত্যার পেছনে মূল কারণ হলো, দুনিয়ার লোভ। দুনিয়ার লোভের মধ্যে রয়েছে, নারী, সম্পদ ও পদ। এই তিন বিষয় যখন মানুষকে আকৃষ্ট করবে, তখন সে আর এখান থেকে বের হতে পারে না, সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।

বলতে দ্বিধা নেই, এখন স্কুলে নৈতিকতা শিক্ষা দেওয়া হয় না। ওই শিক্ষায় কোনো আধ্যাত্মিকতা নেই, যেখানে শুধু দুনিয়া শেখানো হয়। সহশিক্ষার বিষয়টিও ভাবা দরকার। সেখানে প্রেম থাকে। ঝগড়া থাকে। এরপর শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যায় জড়ায়। এখান থেকে উত্তরণের পথ হলো, সর্বস্তরে ইসলাম শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা।

গণমাধ্যম:  বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গ্র্যান্ড মুফতি কিংবা স্বতন্ত্র মুফতি বোর্ড থাকা উচিত কিনা, থাকলে তা কেমন হতে পারে?

মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদ: ধর্মীয় কাজকে সুশৃঙ্খল করার জন্য রাষ্ট্র কিংবা দেশের জনগণ যদি মনে করেন, বিজ্ঞজনদের একটা মুফতি বোর্ড থাকলে জাতীয় অনেক সমস্যার সমাধান হবে। নতুন নতুন উদ্ভূত মাসয়ালার সুন্দর সমাধান হবে, জাতির কল্যাণ হবে; তাহলে এটা অবশ্যই দরকার।

ইতিপূর্বে দেশে বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুতে নানা ধরনের গন্ডগোল হয়েছে। এগুলো দেখেছি, বিপুল অভিজ্ঞতাও হয়েছে সেসব দেখে। সে হিসেবে বলা যায়, জাতীয় পর্যায়ে একটা মুফতি বোর্ড হওয়া দরকার। বোর্ডে বিজ্ঞ মুফতিরা থাকবেন, যাদের ওপর জাতির আস্থা আছে। তাহলে যে কেউ যেকোনো বিষয়ে ফতোয়া দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারবে না।

কয়েকটি শিক্ষা বোর্ড আছে, যারা মাদ্রাসাগুলো নিয়ন্ত্রণ করে, শিক্ষা ও ধর্মীয় বিষয় নিয়ে গবেষণা করে। তারা দেশের সর্বস্তরের মুফতিদের নির্বাচন করে একটা বোর্ড প্রতিষ্ঠা করবেন। সেক্ষেত্রে যারা ফতোয়া নিয়ে জীবনভর কাজ করেছেন, যাদের জীবন-মরণ ফতোয়ার ওপর, তাদের প্রাধান্য দিতে হবে। ফতোয়ার যোগ্যতা আছে, কিন্তু ভিন্ন কাজ করেন, তাদের নেওয়া যাবে না। কারণ, গবেষণাটা বেশি জরুরি। এককথায়, যারা ফতোয়ার কাজে নিয়োজিত, তাদের মধ্য থেকে দীর্ঘ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন, উত্তম চরিত্রবান, আল্লাহওয়ালা ও প্রভাবশালীদের নিয়ে হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া উদ্যোগী হয়ে মুফতি বোর্ড করতে পারে। বোর্ড প্রথমে বেসরকারিভাবে কাজ করবে। পরে ধীরে ধীরে সরকারি পর্যায়ে গ্রহণযোগ্যতা আসবে।

গণমাধ্যম: মুফতি হওয়ার জন্য এক-দুই বছর পড়াশোনা কি যথেষ্ট? করণীয় কী?

মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদ: ইফতা (মুফতি কোর্স) এক বছরেও যথেষ্ট আবার দশ বছরেও যথেষ্ট নয়। বিষয়টা অত্যন্ত কঠিন। যোগ্যতাসম্পন্ন ছাত্র, অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মুফতি আর সিস্টেম যদি উন্নতমানের হয়, তাহলে এক বছরের মধ্যে একজন মুফতির পর্যায়ে পৌঁছতে পারে। এই তিন পয়েন্টের কোথাও ত্রুটি থাকলে, সে দুই বছর পড়লে এক বছরের অভিজ্ঞতা হবে। সেক্ষেত্রে দুই বছর প্রয়োজন। তিন পয়েন্টে যদি দুর্বলতা বেশি হয়, তাহলে চার বছর পড়লে হয়তো এক বছরের যোগ্যতা হবে। সুতরাং দুই বছর বা চার বছর পড়লেই কেউ মুফতি হয়ে যাবে, এমনটা বলার সুযোগ নেই। আবার কেউ এক বছর পড়েই মুফতি হতে পারে।

আমাদের দেশে মুফতি হওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষার্থী খুবই কম। অথচ মুফতি হওয়ার প্রবণতা সবার মধ্যে বিরাজমান। অনেক দারুল ইফতা অযোগ্য ছাত্রদের ভর্তি করে এক বছর কোনো রকম পার করে মুফতির সার্টিফিকেট দিয়ে দিচ্ছে। এটা জাতির জন্য দুর্ভাগ্যের বিষয়। এরা আসলে মুফতি নয়, এরা ফাও মুফতির ডিগ্রি নিয়ে যাচ্ছে। সত্যিকারের মুফতি হাতেগোনা কয়েকটা প্রতিষ্ঠান ছাড়া তৈরি হচ্ছে না। এর মধ্যেও গুটিকয়েক হচ্ছেন। এটাকে উন্নত করা, আরও যাচাই-বাছাই করা, কড়া শর্ত দেওয়া, গবেষণা বাড়িয়ে সিস্টেম সুন্দর করা, শিক্ষার্থী ও শিক্ষক নির্বাচন করে তারপর ইফতা চালু করা প্রয়োজন।

গণমাধ্যম: ভাড়া বাড়িতে মাদ্রাসা পরিচালনা এবং মাদ্রাসার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কালেকশন সম্পর্কে বিধান কী? এটা কি দেওবন্দের আদর্শের পরিপন্থী নয়?

মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদ: দেওবন্দের আদর্শের মধ্যে ভাড়া বাড়িতে মাদ্রাসার ধারণা নেই, এর কোনো ইতিহাস নেই। স্থায়ী জায়গা ও ওয়াকফকৃত জায়গায় মাদ্রাসা করতে হবে। সেখানে মোতাওয়াল্লি ও কমিটি থাকবে এটাই কওমি মাদ্রাসার আসল রূপরেখা। কিন্তু আপনি যদি ইসলামের দিকে তাকান, কোরআন-হাদিস চর্চা করেন, সেখানে একথা নেই যে, ভাড়া জায়গায় মাদ্রাসা করা যাবে না। কোরআন-হাদিসে আছে, ইলম শেখো ও শেখাও।

দীনি শিক্ষার মানোন্নয়ন ও শিক্ষায় অবদান রাখার জন্য কেউ যদি ওয়াকফ জায়গা না পেয়ে ভাড়ায় মাদ্রাসা করেন, কোনো অসুবিধে নেই। মাদ্রাসা কোনো ঘরের নাম নয়, এটা চিন্তার নাম; সিস্টেমের নাম। আমি একটা চিন্তা করে রাখছি, এভাবে মাদ্রাসা চালাব, স্থায়ী জায়গা পেলেও চালাব, অস্থায়ী পেলেও চালাব। চিন্তার নাম মাদ্রাসা। শিক্ষার জন্য যে সিস্টেম তৈরি করে রাখছি, এটা মাদ্রাসা, এটার জন্য চাঁদা কালেকশন করা যাবে।

কিতাব কালেকশন করা যাবে। মানুষ টাকা ও কিতাব দান করে, এগুলো প্রতিষ্ঠানের নামে করে; ঘরের নামে নয়। মাদ্রাসার নামে করে, জায়গার নামে নয়। মাদ্রাসা ঘরের ভেতরও থাকতে পারে। খোলা আকাশের নিচেও থাকতে পারে কিংবা নৌকায়। এটা নিয়ে বাড়াবাড়ির পক্ষে আমি নই।

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ