আওয়ার ইসলাম ডেস্ক: বর্তমান সময়ের আগে বেশিভাগ মানুষ যখন সমুদ্রপথে চলাচল করতো। সেই সময়ে তাদের ধারণা ছিল যে প্রত্যেকটি সাগর আলাদা আলাদা এবং ভিন্ন, কিন্তু আধুনিক পৃথিবীর বড় আবিষ্কার হচ্ছে সব সাগর একত্রে মিশে এক অভিন্ন জলরাশি গঠন করেছে।
ভারত, চীন, পারস্য রোম ও সিরিয়ার সাগরগুলো বিচ্ছিন্ন নয়, বরং একই বিপুল, বিশাল পানিচক্র এই দেশগুলোকে ঘিরে আছে। আরবরাও এই সত্য জানত না। ২২৫ হিজরিতে আরব নাবিক সুলাইমান লিখেছেন, ‘যেসব কথা মানুষ আগে জানত না এবং আমাদের আমলে জানতে পেরেছে, সেগুলো হচ্ছে, চীন সাগর ও ভারত মহাসাগর সিরীয় সাগরের সঙ্গে যুক্ত। আগের দিনের নাবিকদের এ রকম কোনো ধারণাও ছিল না, কিন্তু আমাদের আমলে এটা প্রমাণিত হয়েছে।
আমরা এরূপ খবর পেয়েছি যে ভূমধ্যসাগরে যে জাহাজ বিধ্বস্ত হয়েছে এবং ঢেউয়ের আঘাতে টুকরা টুকরা হয়ে গেছে, সেগুলো বাতাসের টানে পানিতে ভেসে খাজার সাগরে চলে এসেছে এবং সেখান থেকে ভূমধ্যসাগরে এসেছে। তারপর ভূমধ্যসাগর ও সিরীয় সাগরে এসেছে। এর দ্বারা প্রমাণিত হয়, চীন ও সিলার চতুর্দিকে সাগর রয়েছে, তা তুর্কিস্তান ও খাজারের পেছনে বিস্তৃত হয়েছে।’
সুলাইমানের এই বর্ণনা থেকে মনে হয়, পৃথিবীর স্থলভাগ ও জলভাগের মানচিত্র সম্পর্কে তাঁর পরিচ্ছন্ন ধারণা ছিল। পরবর্তীকালে নাবিকরা আরো বেশি পরিষ্কারভাবে আফ্রিকার উপকূল থেকে ভূমধ্যসাগরে প্রবেশের পথ বর্ণনা করে গেছেন।
ইবনে ওয়াদিই ইয়াকুবি সুলাইমানের ৫০ বছর পর আবির্ভূত হন। তিনি তাঁর ভূগোল বই ‘কিতাবুল বুলদানের’ শেষে মরক্কোর একটি উপকূলীয় শহর সস-এর বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘সাগরের কিনারায় বাহলুল নামের একটি মসজিদ ছিল এবং সেই মসজিদের সামনে সেসব দড়িবাঁধা জাহাজ এসে ভেড়ে।
এই জাহাজ পারস্য উপসাগরীয় এলাকায় নির্মিত হয় এবং পারস্য উপসাগর দিয়ে সেগুলো চীনে পাড়ি দেয়।’ মাসুদি (৩০৩ হি.) ও আবু রায়হান বেরুনি (৪৪০ হি.) সাগরের সবচেয়ে বিস্তারিত বর্ণনা প্রদান করেছেন। ইয়াকুতের মতে, তাদের বর্ণনা : জন অধ্যুষিত দুনিয়ার পশ্চিমের এবং তাঞ্জা ও স্পেনের উপকূলের যে সাগর, তার নাম বাহরুল মুহিত (আটলান্টিক মহাসাগর)। গ্রিকরা একে বলে, আওকামানুস।
এই সাগরের মাঝে যাওয়া সম্ভব নয়। জাহাজ এর তীর ধরে চলাচল করে। এসব দেশ থেকে সাগর উত্তরে সাকালিবার দিকে প্রসারিত। সাকালিবার উত্তরে একটি সাগর আছে, সেটি বালগার নামক একটি মুসলিম দেশ পর্যন্ত গিয়েছে। এর নাম বেরিং নদী। এর উপকূলে বেরিং গোত্রীয় লোকেরা বাস করে। তাঞ্জা থেকে সাগর দক্ষিণমুখী হয়ে পশ্চিম সুদানের কামার নামক পর্বতমালায় পৌঁছেছে। এই পর্বত থেকে মিসরের নীল নদের উৎপত্তি।
গ্রানাডার বিখ্যাত ভূ-পর্যটক আবু হামিদ (৫৬৫ হি.) সাগর-মহাসাগরের এই মিলনের বিষয়টি অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘আপনারা নিশ্চয়ই জানবেন যে আটলান্টিক মহাসাগর দুনিয়াকে ঘিরে আছে এবং মহাসাগরের মাঝে দুনিয়ার এই ভূখণ্ড যেন পুকুরের মাঝখানে একটি গোলক বা বলের মতো। যেটিকে কৃষ্ণ সাগর বলা হয়। চীন সাগর এরই একটি শাখা। লোহিত সাগরও একটি উপসাগর। পারস্য উপসাগরও এরই একটি অংশ।’
কিন্তু মহাসাগরের সবচেয়ে উজ্জ্বল চিত্র এঁকেছেন আবুল ফিদা (৭২৫ হি.)। তাঁকেও আবার অতিক্রম করে গেছেন ইবনে খালদুন (৮০৮ হি.)। আবুল ফিদার বর্ণনা হলো, ‘পশ্চিম আটলান্টিকের যে অংশের কিনারায় মরক্কো ও স্পেন অবস্থিত তার নাম আওকামানুস। এর মধ্যে খালিদাত দ্বীপগুলো অবস্থিত। তীর থেকে দ্বীপগুলোর দূরত্ব কয়েক ডিগ্রি। এই আটলান্টিক সাগর মরক্কো উপকূল থেকে সোজা দক্ষিণে বিস্তৃত হয়েছে। তারপর বারবার ও সুদানের মধ্যবর্তী লামতুনা মরুভূমি পার হয়ে চলে গেছে। অতঃপর এই সাগর দক্ষিণের জনমানবহীন, অচেনা এলাকা অতিক্রম করে বিষুব রেখায় পৌঁছেছে, তারপর পুবের কামার পাহাড় ঘুরে গেছে। এই পাহাড় থেকে মিসরের নীল নদ উৎপন্ন হয়েছে।’
ইবনে খালদুন লিখেছেন, ‘ভূগোলবেত্তারা বলেন, ভূমধ্যসাগরের উত্তরের উপসাগর থেকে আরো দুটি সাগর বের হয়েছে। একটি কনস্টানটিনোপলের বিপরীতে। ভূমধ্যসাগর থেকে এক তীর পরিমাণ দূরত্বে অবস্থিত একটি সরু জায়গা থেকে এর উৎপত্তি এবং তিনটি নদী পার হয়ে এটি কনস্টানটিনোপলে পৌঁছেছে, পরে চার মাইল প্রশস্ত হয়ে ৬০ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। এর নাম কনস্টান্টিনোপল উপসাগর।’ সূত্র: ইকনা
-এসআর