আওয়ার ইসলাম ডেস্ক: আজ শনিবার বেফাক ভবনে অনুষ্ঠিত বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ-এর মজলিসে শূরার অধিবেশনে উপস্থিত বেফাক নেতৃবৃন্দ এক যৌথ বিবৃতিতে জাতীয় শিক্ষাক্রমকে জাতীয় ঐক্য, স্বার্থ ও কল্যাণ বিরোধী বলে আখ্যায়িত করেন।
পাঠ্য পুস্তকে ইসলাম বিরোধী বিষয়াদি ও আমাদের বক্তব্য শীর্ষক বিবৃতিতে বেফাক সভাপতি মাওলানা মাহমুদুল হাসান, সিনিয়র সহ-সভাপতি মাওলানা সাজেদুর রহমান, সহ-সভাপতিমণ্ডলী ও মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হক প্রমুখ নেতৃবৃন্দ বলেন, একটি জাতির ঈমান, আকিদা ও জীবনাচারের উপর সেই জাতির জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার প্রভাব অপরিসীম। জাতির প্রতিটি সদস্যই কোন না কোনভাবে জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার দ্বারা প্রভাবিত। তাই কোন জাতিকে উন্নত করতে চাইলে বা ধ্বংস করতে চাইলে সে জাতির শিক্ষাব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করাই যথেষ্ট।
দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, আমাদের এই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থাকে নিজেদের কবজায় নিয়েছে একটি নামধারী সেক্যুলার গোষ্ঠী। যারা নামপরিচয়ে নিজেদেরকে মুসলিম দাবী করলেও তাদের চিন্তা-চেতনা ও কর্মকাণ্ড আমাদের পবিত্র ধর্ম ইসলামের বিশ্বাস ও আদর্শের সঙ্গে পরিপূর্ণ সাংঘর্ষিক। তারা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এমন কিছু বিষয় সংযোজন করেছে যা আমাদের সন্তানদের মুসলিম পরিচয় ও নৈতিক আদর্শের চিহ্নটুকুও মুছে দিতে পারে। এমনকি পশ্চিমাদের এমন সব দর্শন ও কালচারও তারা আমাদের জাতীয় শিক্ষাক্রমের পাঠ্যপুস্তকে সংযুক্ত করেছে কোন সভ্য মানুষ তা মেনে নিতে পারে না। এ পরিস্থিতে আমাদের জানা উচিত, পাঠ্যপুস্তকে ঈমান, আকিদা ও নৈতিকতা বিরোধী কী কী বিষয় রয়েছে?
নতুন কারিকুলাম ২০২৩ এর পাঠ্যপুস্তকে ইসলাম ও মুসলিমদের স্বার্থবিরোধী যে সকল বিষয় রয়েছে তার মৌলিক তালিকা নিম্নে উল্লেখ করা হলো :
এক. ইসলামবিদ্বেষ ও ইসলামি সংস্কৃতিকে মুছে ফেলা।
দুই. ভারতবর্ষের মুসলিম শাসকদেরকে নেতিবাচক উপস্থাপন ও ইতিহাস বিকৃতি।
তিন. ট্রান্সজেন্ডার ও সমকামিতার মত বিকৃত কাজকে সহজিকরণ।
চার. অপসংস্কৃতি ও ৯২ভাগ মুসলমানের সন্তানদের জন্য হিন্দুয়ানী কালচারকে দেশীয় সংস্কৃতি হিসেবে উপস্থাপন।
পাঁচ. বিবর্তনবাদের কুফুরি আকিদা।
ষষ্ঠ শ্রেণির সমাজবিজ্ঞান অনুশীলন বইয়ের ৯৯ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে; মুসলিম শাসকরা ছিলেন ক্ষমতালিপ্সু। ধর্মকে রাজনৈতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। ধর্মের মাধ্যমে বিভিন্নভাবে স্বার্থ হাসিল করেছেন। এরচে বড় এক পেশে, বিকৃত ও সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক ইতিহাস বর্ণনা আর কী হতে পারে? অথচ বিশ্বর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় তা স্থান পেয়েছে। এভাবেই এ ভূমি থেকে আমাদের ১৩শ বছরের শেকড় উপড়ে ফেলার আয়োজন চলছে।
যষ্ঠ শ্রেণির সমাজবিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ বইয়ের ২৪ পৃষ্টায় বলা হয়েছে; ‘আমাদের প্রথমে মনে রাখতে হবে যে আধুনিক মানুষ ও বানর-গোত্রের নানা প্রাণী (যেমন : শিম্পাঞ্জী, গলিলা) একটি সাধারণ প্রাইমেট জাতীয় প্রজাতি থেকে তাদের যাত্রা শুরু হয়েছে।’
তারপর লক্ষ লক্ষ বছর যাবত বিবর্তন হয়ে মানুষ এই পর্যায়ে এসেছে বলে বড় একটা গালগল্প দেয়া হয়েছে। যে বক্তব্যে আল্লাহ বা সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব বা কোন ভূমিকার কথা বলা হয়নি। এমন বক্তব্য সুস্পষ্ট কুফুর।
একই বইয়ের ২৩ নম্বর পৃষ্টায় সুন্দর কৌশলে অস্বীকার ও লংঘন করা হচ্ছে ইসলামি আকিদাকে। বলা হয়েছে; ‘আমাদের পূর্ব প্রজন্মের মানুষেরা লক্ষ লক্ষ বছর আগে কি আসলেই বানর ছিলো? নাকি পৃথিবীতে আমাদের আর্ভিবাব হয়েছে এমন যেমন আছি তেমন মানুষ হিসেবে?
উপরে উল্লেখিত প্রশ্নের দ্বিতীয় অংশটি ইসলামি আকিদা। কারণ কোরআন সুন্নাহর ভাষ্য বলে মুসলিম মাত্রই মনে করে, মানুষ এভাবেই পৃথিবীতে আবির্ভুত হয়েছে। কিন্তু পাঠ্যপুস্তকে ইসলামের এই বিশ্বাসকে বিবর্তনবাদের মোকাবেলায় দাঁড় করিয়ে প্রশ্ন করা হলো। তারপর যে বয়ান দেয়া হলো তা বিবর্তনবাদকে প্রমাণ করে এবং ইসলামি বিশ্বাসকে নাকচ করে দেয়। এভাবেই বিষ ঢেলে দেয়া হলো আমাদের শিশুদের আকিদায়।
একই বইয়ের ১১৫ পৃষ্টায় ‘বিভিন্ন সময়ের মানুষ’ শিরোনাম দিয়ে আবারও তুলে দেয়া হলো সেই ছবি। বিবর্তনবাদের কুফুরি আকিদা যাতে শিক্ষার্থীদের মনে বদ্ধমূল হয়ে যায় সেজন্য সুপরিকল্পিতভাবে বারবার তাদের সামনে বিষয়টি বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করা হয়েছে। ষষ্ঠশ্রেণীর সমাজবিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ বইয়ের ৩০ নং পৃষ্টায় শিক্ষার্থীদেরকে ‘মানুষ কোথা থেকে এলো?’ এই প্রশ্নের সিদ্ধান্তমূলক বক্তব্য শেখানো হচ্ছে। বিবর্তনের যে ধারা বইয়ে উপস্থাপন করেছে তার একটি তালিকা করতে বলা হয়েছে শিক্ষার্থীদের। যাতে তাদের মস্তিস্কে বিষয়টি বদ্ধমূল হয়। এমনকি বিবর্তনের বিভিন্ন ছবি যেন তারা সংগ্রহ করে ও আঁকে এ ব্যাপারেও তাদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। শিশুরা এসব পড়ে অনলাইনে ঘাটাঘাটি করবে এবং এসব ছবি সংগ্রহ করবে।
এনসিটিবির ২০২৩ সালের পাঠ্যপুস্তকে আপনি আযান, ঈদ, কুরবাণী, হজ, ওমরা, রোজা, নামায না পেলেও সংস্কৃতি হিসেবে পেয়ে যাবেন গায়ে হলুদ, জন্মদিন, মুখেভাত ও পহেলা বৈশাখের মত বহু কুসংস্কারকে। তৃতীয় শ্রেণীর কোমলমতি শিশুদের বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইয়ের ৬৬ পৃষ্ঠায় বাংলাদেশের সংস্কৃতি হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে পহেলা বৈশাখ ও মঙ্গল শোভাযাত্রাকে। চতুর্থশ্রেণীর বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইয়ের ৮৪ পৃষ্ঠায় বাংলাদেশের সংস্কৃতি হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে জন্মদিন, মুখেভাত ও গায়ে হলুদকে।
আযান, নামায, মসজিদ, মিনার, কোরআন, ঈদ ও কোরবানী হয়তো সেক্যুলারদের অরুচি এগুলো অসাম্প্রদায়িক ও সার্বজনীন না হওয়ার কারণে। কিন্তু নিরেট হিন্দুয়ানী প্রণাম, পুরাণ, গায়ে হলুদ ও নাসারাদের শিরকি আকিদা যীশুর জন্মদিনে তাদের কোন অনীহা নেই। এভাবেই জনগণের অর্থে ছাপাহওয়া পাঠ্যপুস্তক নিয়ে নোংরা খেলায় মেতে উঠেছে ইসলাম বিদ্বেষী সেক্যুলার শ্রেণী।
তাই এখনই আমাদের সচেতন হতে হবে। প্রত্যেক জায়গা থেকে পরিবর্তন ও সংশোধনের দাবি তুলতে হবে। বর্তমান শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তকের বিকৃতির ব্যাপারে আমাদের যথাসম্ভব জাতীয় পর্যায়ে আওয়াজ তোলাও জরুরি। বিভিন্ন পন্থায় সরকার ও প্রশাসনের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদেরকে অবহিত করা আমাদের কর্তব্য। ব্যক্তিগত পর্যায়ে আমরা সকলেই মহান আল্লাহর নিকট ভবিষ্যৎ বংশধর ও আমাদের নিকট সন্তানদের ঈমান আকিদা রক্ষার ব্যপারে জিজ্ঞাসিত হবো। তাই তাদেরকে দ্বীন ও ঈমান আকিদা শিক্ষা দেয়া আমাদের অবশ্য কর্তব্য। শিশুকাল থেকেই তাদের ঈমান শিক্ষার জন্য মকতবে পাঠানো, তাদের হাতে দ্বীনি বই পুস্তক তুলে দেয়া, দ্বীন শেখার জন্য তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করা, নিজেদের সাথে মসজিদে নিয়ে যাওয়া, মাদরাসা শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করা, শৈশবেই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পরিচয়, সাহাবীগণের আদর্শ ও আমাদের মহান পূর্বসূরীদের ইতিহাস তাদের সামনে তুলে ধরা আমাদের অবশ্য কর্তব্য। আমরা যদি এই কর্তব্যে অবহেলা করি তাহলে ঝুঁকির মুখে পড়বে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ঈমান। হুমকির মুখে পড়বে আমাদের অস্তিত্ব।
সরকারের কর্তব্য এসব ইসলামবিরোধী বিষয় পাঠ্যপুস্তক থেকে দ্রুত অপসারণ এবং নতুন সংশোধনী কমিটির নিকট এসব বিষয় তুলে ধরে সংশোধনের নির্দেশ প্রদান করা। আজকের সভা থেকে বেফাকের শুরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অভিপ্রায়ের বাইরে যে চক্রটি শতকরা ৯২ ভাগ মুসলমানদের দেশে জাতীয় শিক্ষাক্রমে আল্লাহর অস্তিত্ব, ধর্মীয় মূল্যবোধ, কোরআন সুন্নাহর আদর্শ, মুসলিম ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি, শালীনতা, পর্দা বিধান ইত্যাদির প্রতি অবহেলাকর পাঠ অন্তর্ভুক্ত করে থাকে, তাদের দুরভিসন্ধির হাত থেকে জাতিকে মুক্তি দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণের জোর দাবি জানাচ্ছে।
যৌথ বিবৃতি প্রদান করেন, বেফাক সভাপতি আল্লামা মাহমুদুল হাসান, সিনিয়র সহ-সভাপতি মাওলানা সাজেদুর রহমান, সহ-সভাপতি মুফতী মনসুরুল হক, মাওলানা আব্দুল হামীদ, মুফতী জাফর আহমাদ, মুফতী ফয়জুল্লাহ, মাওলানা মুসলেহুদ্দীন রাজু, মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হকসহ সারাদেশ থেকে আগত শুরার ৩ শতাধিক বেফাক শুরা সদস্য ও অসংখ্য উলামা মাশায়েখ।
কেএল/