মুফতি সাদেকুর রহমান: বিশ্ব ইজতেমা দীন প্রতিষ্ঠার এক নিরব আন্দোলন। দায়ীদের এক বৈশ্বিক সম্মেলন। আল্লাহ ওয়ালা এবং আল্লাহ ভোলা বান্দাদের এক সেতু বন্ধন। দুনিয়ামুখী বান্দাদের আল্লাহ মুখী করার কৌশল নির্ধারণের সম্মেলন।
সেখানে গুরু গম্ভীর ভাষায় মহান আল্লাহর বড়ত্ব ও মহিমা বর্ণনা করা হয়। দীন প্রতিষ্ঠায় প্রিয় নবিজির মেহনত- মুজাহাদা, ত্যাগ- তিতিক্ষার আলোচনা হয়। রাসুলের হেফাজত ও দীনের আমানত রক্ষায় প্রাণ বিসর্জনকারী সাহাবায়ে কেরামের জীবনী আলোচনা হয়। তা শ্রোতাদের ভিতর ঈমানী চেতনা ও আমলের স্পৃহা জাগ্রত করে। দীনের বাণী অন্যের কাছে পৌঁছানোর প্রেরণা তৈরি হয়। সৃষ্টি হয় খোদাভীরুতা, আখেরাত মুখিতা ও দুনিয়া বিমুখতা,সহনশীলতা ও ধৈর্যশীলতা।
জাগ্রত হয় ভ্রাতৃত্ব ও সহমর্মিতা, অপরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও অগ্রাধিকার দেওয়ার মন মানসিকতা। অঙ্কুরিত হয় বিনয় ও নম্রতা এবং নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার মন মানসিকতা। সর্বোপরি ব্যক্তি জীবনে সুন্নাহ পালনের এক দৃঢ় ইচ্ছা ও প্রতিজ্ঞা।
এই ইজতেমার লক্ষ্য ও প্রধান উদ্দেশ্য হল, দুনিয়ার বুকে পুনরায় পূর্ণাঙ্গ দীনের প্রতিষ্ঠা ও বাস্তবায়ন। এবং তার অনুসারীদেরকে শতভাগ দীনের উপর প্রতিষ্ঠিত করন। যা সাহাবায়ে কেরাম ও খোলাফায়ে রাশেদীনের জমানায় বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করে ছিল।
আর এই লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য তারা মৌলিকভাবে তিনটি পন্থা গ্রহণ করেছেন। এক, দাওয়াতের পন্থা। যে পন্থা অবলম্বন করেছিলেন আমাদের প্রিয় নবি সহ সকল নবি ও রাসূলগণ। এই দাওয়াতের মাধ্যমেই আখেরী নবি সা. মানব ইতিহাসে সবচেয়ে অসভ্য, মূর্খ জাতিকে আমূল পরিবর্তন করে এক সভ্য, ভদ্র এবং আদর্শ জাতিতে রূপান্তরিত করেছিলেন। কারণ মানব হৃদয় হলো ফসলি জমির মত। জমিতে ফসলের বীজ বপন করার পূর্বে সেখানে অনেক রকমের আগাছা-পরগাছা, ঘাস- তৃণলতা জন্মে। কৃষক বিভিন্ন ধাপে কঠোর পরিশ্রম করে সেই আগাছা- পরগাছা গুলো দূর করে। এবং জমিকে ফসল উপযোগী করে তোলে।
সবশেষে বীজ বপন করে। যথাসময়ে সেই বীজের পরিচর্যা করে। একসময় তা বড় হয়ে সোনালী ফসল জন্ম দেয়। আর তখন কৃষকের মুখে হাসি ফোটে। দেশ ও জনগণের প্রয়োজন পূরণ হয়। ঠিক তেমনি প্রতিটি মানবহৃদয় ইসলাম গ্রহণের স্বভাব নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু তার মা-বাবা সমাজ ও পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন কারণে সেই স্বভাব পরিবর্তন হয়ে যায়। বিভিন্ন গুনাহের দ্বারা তা কলুষিত হয়ে যায়। ফলে সে হৃদয় মরে যায়।
ভালো- মন্দের পার্থক্য নিরূপণে অক্ষম হয়ে যায়। সে হৃদয়ে কুফর- শিরক ,রুসুম- রেওয়াজ, নাফরমানি ও অবাধ্যতার পরগাছা জন্ম নেয়। আর তখন প্রয়োজন দেখা দেয় সেই পরগাছা গুলো দূর করার। আল্লাহর পক্ষ থেকে তার নির্বাচিত বান্দা তথা রাসূল ও নবিগণ দুনিয়াতে আগমন করে সর্বপ্রথম সেই গুরু দায়িত্বটাই সফলভাবে আঞ্জাম দেন। আল্লাহর বড়ত্ব- মহত্ব ও মহিমার প্রতি দাওয়াত দিয়ে মানব হৃদয় থেকে সেই পরগাছা গুলো দূর করেন। হৃদয় গুলোতে আল্লাহর প্রতি মহব্বত -ভালোবাসা, ভক্তি-শ্রদ্ধা এবং আনুগত্যের বীজ বপন করেন। তারপর দীনের খুঁটিনাটি যাবতীয় বিষয়াষয় শিক্ষা দেন এবং দীনের পূর্ণাঙ্গ অনুসারী করে মহান আল্লাহর খাঁটি বান্দা এবং প্রেমিক হিসেবে গড়ে তোলেন।
নবি-রাসূলের আগমনের ধারা সমাপ্ত হয়ে গিয়েছে। তাই তাঁদের উত্তরসূরী ওলামায়ে কেরামের নেগরানীতে এই গুরু দায়িত্ব আঞ্জাম দেওয়া উম্মতের প্রতিটি সদস্যের ওপর আবশ্যক। মহান আল্লাহ বলেন, তোমরা শ্রেষ্ঠ জাতি তোমাদেরকে মানুষের কল্যাণের তরে বের করা হয়েছে। তোমরা মানুষকে সৎ কাজে আদেশ করবে এবং অসৎ কাজ থেকে বাধা প্রদান করবে। (সূরা আলে ইমরান-১১০)
রাসূলে কারীম সা.বলেন, তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকেই স্বীয় দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। (সুনানে তিরমিজি-১৭০৫)
আজ বিশ্বব্যাপী দাওয়াত ও তাবলিগের নামে যে মেহনত চলছে তা, মৌলিকভাবে নবিওয়ালা সেই গুরু দায়িত্বটাই আঞ্জাম দিচ্ছে। এবং দীন কায়েমের শাশ্বত ও আদর্শ পন্থাকেই মজবুতির সাথে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। এবং তা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিয়ে ক্রমান্বয়ে পূর্ণাঙ্গ দীন বাস্তবায়নের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে।
দুই. বিশ্ব ইজতেমার আরেকটি অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হল, উম্মতকে আল্লাহমুখী করার জন্য দায়ীদের এমন একটি জামাত তৈরি করা, যারা উলামায়ে কেরামের তত্ত্বাবধানে দিবানিশি উম্মতের হেদায়েতের জন্য ফিকির ও কঠোর মুজাহাদা করবেন। রাতের নির্জনতায় উম্মতের জন্য মহান রাব্বুল আলামিনের দরবারে রোনাজারি ও কান্নাকাটি করবেন।
আল্লাহর দেওয়া জান, মাল ও সময় নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় বের হয়ে মানুষকে আল্লাহর দিকে আহবান করবেন। এর জন্য কারো কাছে কোন বিনিময় চাইবেন না। তারা দুনিয়ার চাকচিক্যের প্রতি ভ্রূক্ষেপ করবেন না। তাদের দৃষ্টি সর্বদা মহান স্রষ্টার প্রতি নিবদ্ধ থাকবে। তারা তাদের রবের কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করবে। গাইরুল্লাহ থেকে সম্পূর্ণ অমুখাপেক্ষী থাকবে। তাদের ঈমান,আমল-আখলাক হবে সাহাবী ওয়ালা ঈমান আমল ও আখলাকের মতো। তারা আপাদমস্তক সুন্নতের অনুসারী হবে।
আল্লাহর অবাধ্যতায় লিপ্ত বান্দাদের দেখে তাদের হৃদয় বিগলিত হবে। চোখ থেকে অশ্রু ঝরবে। তাদের হেদায়াতের চিন্তায় দিল সদা বেচাইন থাকবে। হাতে তাসবীহ, মুখে জিকির ও দিলে ফিকির থাকবে। স্রোতের বিপরীত পথ চলায় পাহাড়সম দৃঢ় ও অবিচল থাকবে। বিপদ-আপদ, বালা- মুসিবতে সহনশীলতা ধৈর্যশীলতা, সহমর্মীতা, ত্যাগ ও তিতিক্ষার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করবে। পারস্পরিক হৃদ্যতা- ভালোবাসা ও ঐক্যের বন্ধনে সীসা-ঢালা প্রাচীরের মতো সুদৃঢ় থাকবে। তাদের মধ্যে হৃদয়ের উদারতা, চিন্তার প্রসারতা, চেতনার গভীরতা,চরিত্রের পবিত্রতা, উম্মতের প্রতি মায়া- মমতা, বিশ্ব মানবতার প্রতি দয়া ও করোনা এবং আল্লাহর কালেমাকে সকল কালেমার উপর বুলন্দ করার জন্য নিরন্তর জিহাদ ও মুজাহাদার জযবা সদা জাগরুক থাকবে। তাদের প্রতিটি আচরণে-উচ্চারণে, চলনে-বলনে, শয়নে- স্বপনে থাকবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের ব্যাকুলতা।
তিন. আল্লাহর রাস্তায় বেশি পরিমাণে জামাত বের করার প্রচেষ্টা। বিশ্ব ইজতেমায় দেশ-বিদেশ থেকে আগত লাখো মুসল্লিদের ব্যাপকভাবে উৎসাহ ও তারগীব দেয়া হয় যাতে তারা দাওয়াতের মহান মিশনকে নিয়ে দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। তারা দীর্ঘ সময় মসজিদের পরিবেশের থাকে। দ্বীনি আলোচনা শুনে। কিতাবি তালিমে বসে। আমলের মুজাকারা হৃদয়ঙ্গম করে। প্রত্যেক কাজ নবিজির সুন্নত অনুযায়ী করার চেষ্টা করে। ফলে তাদের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন হয়। অন্তরে আল্লাহর বড়ত্ব, মহব্বত-ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। দীন মানার, দীন অনুযায়ী নিজের জীবনকে পরিচালনার যোগ্যতা সৃষ্টি হয়।
এভাবে তারা আল্লাহর খাঁটি বান্দায় পরিণত হয়। দ্বিতীয়ত জামায়াত যে যে এলাকায় গমন করে সেখানকার লোকদেরকে তারা মসজিদমুখী করার চেষ্টা করে। ব্যাপকভাবে দাওয়াত দেয়। এতে এলাকাবাসীর উপকার হয়। তাদের মধ্যে দীনের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। তাদেরও অনেকে দীন শেখা- শেখানোর প্রেরণা বুকে ধারণ করে তাবলিগের জন্য বের হয়ে পড়ে। এবং দেশ-বিদেশে ছুটে বেড়ায়। এভাবে বিশ্বব্যাপী এক নীরব পরিবর্তনের ধারা এগিয়ে চলছে।
পর্যবেক্ষকদের মতে বিশ্ব ইজতেমা শত বাধা ও প্রতিকূলতা পেরিয়ে তার কাঙ্খিত লক্ষ্য- উদ্দেশ্য পানে ক্রমান্বয়ে এগিয়ে চলছে।
আয় রাব্বে কারিম! তুমি এই মোবারক মেহনতকে আরো গতিশীল ও প্রাণবন্ত করে দাও। এবং এই মেহনতকে সর্বপ্রকারের ফিতনা-ফাসাদ থেকে হেফাজত রাখো। আর আমাদের সেখানে অংশগ্রহণের সৌভাগ্য দান করো। আমিন।
লেখক: মুফতি ও মুহাদ্দিস, শেখ জনূরুদ্দীন রহ. দারুল কুরআন মাদ্রাসা, চৌধুরীপাড়া ঢাকা।