মাওলানা দৌলত আলী খান- মানবজাতির ব্যক্তিজীবন থেকে আরম্ভ করে সমষ্টিগত জীবন পর্যন্ত সর্বস্তরে মহান আল্লাহর সার্বভৌমত্ব এবং রাসুলুল্লাহ সা. এর রিসালাতের ব্যাপক প্রচার-প্রসারের উপকরণ হলো তাবলিগ।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহা মানব ও মুক্তির দূত হজরত মুহাম্মদ সা. কোরআনের তাবলিগ দ্বারা মানব জাতিকে সত্যের পথে সুসঙ্গবদ্ধ করে বিশ্ব ভূমণ্ডলে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এ তাবলিগই পরিবার থেকে সংসদ পর্যন্ত দ্বীনকে পৌঁছিয়ে দিতে পারে। মানুষের অন্তরকে পরিশুদ্ধ ও দ্বীনের আলোয় আলোকিত করতে পারে। কলুষমুক্ত মানবসমাজ গড়তে পারে।
তাবলিগ শব্দটি আরবী। এর আভিধানিক অর্থ হলো প্রচার করা বা পৌঁছিয়ে দেয়া। ইসলামী পরিভাষায়-দ্বীনের আহকাম, বিধি-নিষেধ ও শিক্ষা-দীক্ষাকে অন্যের নিকট প্রচার করা বা পৌঁছিয়ে দেওয়ার নামই তাবলিগ। তাবলিগের লক্ষ্য হচ্ছে , প্রধানত দ্বীন প্রতিষ্ঠা। যদ্বারা সমগ্র মানব গোষ্ঠীর ইহ-পরকালীন শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। যুগে যুগে নবী-রাসুলগণ এবং দ্বীনের যুগসংস্কারকগণ কর্মসূচী প্রদানের মাধ্যমে বিপদগামী ও কুসংস্কারে নিমজ্জিত মানব সমাজকে মুক্তি ও কল্যাণের পথে ফিরিয়ে এনেছেন।
এখানে একটি কথা স্মরনীয় যে, তাবলিগের লক্ষ্য নিছক কালিমা পাঠক মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি করাই নয়, বরং অমুসলিমকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার সাথে সাথে মুসলিম সমাজে দ্বীন প্রতিষ্ঠা করাও এর প্রধান লক্ষ্য। আর দাওয়াত ও তাবলিগ বিষয়ে “মাগলুবুল হাল” বজর্নীয়। কারণ, মাগলুবুল হাল ব্যক্তি ভূল-ভ্রান্তিমূলক কথা বলে দ্বীনি দাওয়াতে বিঘ্নতা সৃষ্টি করবে। ফলে মানুষের মাঝে ভ্রান্ত আকিদার জন্ম দিবে। তাই মুবাল্লিগদের সুস্থ মস্তিস্ক ও মেধাসম্পন্ন ব্যক্তি হতে হবে।
১. কোরআনে তাবলিগের নির্দেশ : কোরআন মুসলিম উম্মাহর জীবনবিধান। এ বিধান অনুযায়ী মুসলমানদেরকে সকল কাজ করতে হবে। তাই তাবলিগের কাজও আল্লাহর নির্দেশিত আহকাম অনুযায়ী হতে হবে। রাসুল (সা.) এর তরিকা মতো হতে হবে। তাবলিগের তরিকা ও ফজিলতের আলোচনা কোরআনের একাধিক স্থানে রয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন, হে রাসূল! আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে যা কিছু অবতীর্ণ করা হয়েছে আপনি তা প্রচার করুন। (সূরা মায়িদা : ৬৭)
আরও বলেন, আপনার পালনর্কতার পথের প্রতি আহবান করুন জবানের কথা বুঝিয়ে ও উপদেশ শুনিয়ে উত্তমরুপে তাদের সঙ্গে বির্তক করুন পছন্দযুক্ত পন্থায়। (সূরা নাহল : ১২৫)
২. হাদিসে তাবলিগের গুরুত্ব : মহানবী (সা.) মানব জাতির হেদায়তের জন্য তাবলিগের কথা শুধু মুখে বলে যাননি, বরং সুনিদির্ষ্ট পদ্ধতিও দেখাই গেছেন। এমনকি স্বীয় সাহাবাদেরকে তাবলিগ ও দ্বীনি দাওয়াতি কাজের পদ্ধতি প্রত্যক্ষভাবে শিক্ষা দিয়েছেন। এ নির্দেশিকার মাধ্যমে রাসুলুল্লাহ (সা.) মুসলিম জাতির সকল ব্যক্তিকে তাবলিগ বা দ্বীন প্রচারের দায়িত্বে দায়িত্বশীল করেছেন। এ মর্মে রাসুল (সা.) বলেন, একটি বাণী হলেও আমার পক্ষ থেকে তোমরা অন্যের নিকট পৌঁছিয়ে দাও।
আরও বলেন, সেই যাতের কসম, যার হাতে আমার প্রাণ তোমরা অবশ্যই সৎকাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করতে থাক। অন্যথায় অতিসত্বর আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তোমাদের ওপর আপন আজাব পাঠিয়ে দিবেন। অতঃপর তোমরা দোয়া করলেও আল্লাহ তায়ালা তোমাদের দোয়া কবুল করবেন না। (তিরমিজি : ২৩২৩)
৩. তাবলিগের মাধ্যম : যারা ইসলামী বিষয়ে জ্ঞান রাখেন তথা আলেম সমাজ তাদেরকে তাবলিগের কাজে এগিয়ে আসতে হবে। আলেমদের উপস্থিতি ছাড়া দাওয়াত ও তাবলিগের সুরক্ষা ও সফলতা নিশ্চত নয়।
যেমন- মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াছ (রহ.) তাবলিগ জামাত প্রতিষ্ঠা করে বিশ্বব্যাপী দ্বীনি দাওয়াতি কাজ চালু করে গেছেন। এর মাধ্যমে মানব জাতি দ্বীনি জ্ঞান লাভ করছে। অমুসলিমের প্রতি ইসলামের দাওয়াত পেশ করছে এবং মুসলমানদের নিকট দ্বীনের আহকাম তুলে ধরছে। এভাবে তাবলিগ জামাত যুগের পর যুগ দ্বীনি কাজ করে আসছে।
এছাড়াও নিম্নে উল্লেখিত পদ্ধতিতেও তাবলিগের কাজ করা যেতে পারে- ১. লিখনীর সাহয্যে, ২. বই-পুস্তক রচনা করা, ৩. ওয়েবসাইট ও ব্লগ চালু করা, ৪. দ্বীনি শিক্ষা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা, ৫. ইসলামী মাহফিলের আয়োজন করা, ৬. ইসলামী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা, ৭. মসজিদ প্রতিষ্ঠা করা ও ৮. হক্কানি পীর-বুজুর্গদের বায়আত গ্রহন করা ইত্যাদি।
কিন্তু তাবলিগের পূর্বশর্ত হচ্ছে মুবাল্লিগকে দ্বীনের আহকাম ও আকাঈদ সম্পর্কে জ্ঞান রাখতে হবে। সেই সাথে আমলের প্রতি তার শতভাগ গুরুত্ব থাকতে হবে। তাই, তিনি যা প্রচার করবেন, ব্যক্তিগত জীবনে তাকে তার যথার্থ অনুসরণ করতে হবে। কারন, মুবাল্লিগের তাবলিগের প্রচার কার্য দ্বারা অন্যরা তখনই প্রভাবিত হবেন যখন তার মধ্যে আমলের নিদর্শন পাওয়া যাবে।
সুতরাং তাকে নিখুত চরিত্রের অধিকারী, ইসলামী জ্ঞান সম্পন্ন এবং নিষ্ঠাবান হতে হবে। এ তাবলিগি কর্মসূচী চালিয়ে যাওয়া মুসলিম উম্মার সার্বজনীন দায়িত্ব। আর দ্বীন প্রতিষ্ঠার এটাই অন্যতম বাহন।
লেখক : শিক্ষক, নাজিরহাট বড় মাদ্রাসা, ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম।