সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
চিকিৎসকরা বছরে দুইবারের বেশি বিদেশ যেতে পারবেন না ঢাকা থেকে ভাঙ্গা হয়ে খুলনায় গেলো পরীক্ষামূলক ট্রেন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করবেন প্রধান উপদেষ্টা: প্রেস উইং ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সাম্যের ভিত্তিতে সংবিধান রচনার আহ্বান নেপালে ফের কুরআন প্রতিযোগিতার আয়োজন করছে সৌদি আগামীকাল সংবিধান সংস্কার কমিশনে প্রস্তাবনা পেশ করবে ইসলামী আন্দোলন ‘আল্লামা আতহার আলী রহ. জীবন, কর্ম, অবদান’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন আগামীকাল হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রহ. : কে এই মহান ব্যক্তি হাজিদের স্বার্থ রক্ষায় সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ : ধর্ম উপদেষ্টা মহানবীকে সা. নিয়ে কটূক্তি করলে সংবিধানে শাস্তির বিধান রাখার প্রস্তাব পার্থের

ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায় অসুস্থ ব্যক্তির সেবা শুশ্রুষা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

|| মুফতি আলী হুসাইন ||

ইসলাম একটি সর্বজনীন জীবনব্যবস্থা। এর প্রতিটি আদেশ ও নিষেধের মাঝে রয়েছে মানবজাতির ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণ। ইসলামের ফরজ বিধান পালনে যেমন নেকি আছে তদ্রুপ নফল আমলগুলোতেও আছে অফুরন্ত নেকি। কিন্তু আফসোস হলো এসকল নফল আমলে আমরা তেমন গুরুত্ব দেই না। অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়া এবং তার সেবা শুশ্রুষা করা একটি গুরুত্বপূর্ণ নফল ইবাদত এবং রাসুলুল্লাহ সা:-এর একটি বিশেষ সুন্নত।

আমাদের প্রিয় নবি সা: এ ব্যাপারে খুব গুরুত্বারোপ করেছেন। নিজেও রোগীর সেবা-শুশ্রুষা করে উম্মতকে শিক্ষা দিয়েছেন, একটি মহান ইবাদত। তাছাড়া মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেও অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়া এবং তার সেবা-শুশ্রুষা করা, একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর মধ্যদিয়ে পারিবারিক ও সামাজিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্প্রীতি মজবুত হয় এবং পরস্পর নিবিড় ভালোবাসার সম্পক সৃষ্টি হয়। তবে রোগী দেখার কিছু আদব ও সুন্নত রয়েছে। আমাদের সেগুলোর প্রতি খেয়াল রাখতে হবে।

১. অজুসহকারে রোগী দেখতে যাওয়া।
রাসুলুল্লাহ ﷺ ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি উত্তমরুপে অজু করে সাওয়াবের উদ্দেশ্যে কোনো অসুস্থ মুসলমানকে দেখতে যায়, তাকে জাহান্নাম থেকে ৬০ বছরের সমপথ দূরে রাখা হবে। [সুনানে আবু দাউদ: ৩০৯৭]

২.যথাসম্ভব রোগীর শরীরে হাত দিয়ে অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা। [মুসনাদে আহমাদ: ২২২৩৬]
বুখারি ও মুসলিম গ্রন্থে এসেছেÑ রাসুলুল্লাহ ﷺ যখন সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস [রাদিয়াল্লাহু আনহু] কে দেখতে গেলেন, তখন তাঁর বরকতময় হাত সাদ এর কপালের ওপর রাখলেন এবং চেহারা ও পিঠের ওপর হাত বুলিয়ে দিলেন। আর বললেন- اَللَّهُمَّ اشْفِ سَعْدًا.

হে আল্লাহ! আপনি সাদকে সুস্থ করে দিন। [সহিহ বুখারি: ৫৬৫৯]
রোগীর শরীরে হাত বুলালে সে শান্তনা লাভ করে। তাছাড়া তার অবস্থা সম্পর্কে ভালোভাবে জানা যায়। এটাও তার প্রতি এক প্রকারের অনুগ্রহ ও দয়াসুলভ আচরণ।

৩. রোগীকে শান্তনার বাণী শোনানো।
আবু সাঈদ খুদরি [রাদিয়াল্লাহু আনহু] বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ ﷺ ইরশাদ করেছেন, তোমরা যখন কোনো রোগীর কাছে যাবে, তার জীবন সম্পর্কে আনন্দদায়ক কথা বলবে। তাকে শান্তনা দেবে। যদিও ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে পারবে না, যা ঘটার তাই ঘটবে তবুও তার মনে শান্তনা লাভ হবে, যা রোগী দেখতে যাওয়ার মূল উদ্দেশ্য। [তিরমিযি: ২০৯৪]

৫.রোগীর কাছে বেশিক্ষণ অবস্থান করবে না।
কারণ, এতে রোগীর কষ্ট হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। হ্যাঁ, রোগীর কাছে অবস্থান করা যদি তার অন্তরের প্রশান্তি ও শান্তনার কারণ হয়, তাহলে দীর্ঘ সময় অবস্থান করাতে কোনো সমস্যা নেই।

৪.চিকিৎসকের পক্ষ থেকে রোগীর সাথে দেখা-সাক্ষাতের কোনো পরামর্শ থাকলে তার প্রতি লক্ষ রাখা।
অনেক সময় আমরা আবেগতাড়িত হয়ে এসবের প্রতি তোয়াক্কা না করে রোগীকে দেখতে যাই। এতে রোগীর কোনো উপকার পৌঁছায় না।

৬.রোগীর কোনো চাহিদা আছে কি না জিজ্ঞাসা করা। খাবার বা অন্য কোনো বৈধ চাহিদা থাকলে যথাসম্ভব পূরণ করার চেষ্টা করা।

৭. রোগীর কাছে উঁচু আওয়াজে কথা বলবে না।
ইবনে আব্বাস [রাদিয়াল্লাহু আনহু] থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লহ ﷺ ইরশাদ করেছেন, সুন্নত হল রোগীর পাশে দীর্ঘ সময় না-বসা এবং উঁচু আওয়াজে কথা না বলা।

৮. রোগীর মাথার পাশে বসে তার সুস্থতার জন্য দোয়া করা।
ইবনে আব্বাস [রাদিয়াল্লাহু আনহু] থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, রাসুলুল্লাহ ﷺ যখন রোগীর কাছে যেতেন, তখন তিনি তার মাথার পাশে বসতেন এবং নিম্নোক্ত দোয়াটি সাতবার পাঠ করতেন-

أَسْأَلُ اللهَ الْعَظِيْمَ رَبَّ الْعَرْشِ الْعَظِيْمِ أَنْ يَشْفِيَكَ

আমি মহান আরশের অধিপতি মহা মালিকের কাছে তোমার সুস্থতা কামনা করছি।
তারপর যদি রোগীর হায়াত অবশিষ্ট থাকত, তাহলে সে দ্রুত আরোগ্য লাভ করত। [আল-আদাবুল মুফরাদ: ৫৩৬]

৯. রোগীর কাছে নিজের জন্য দোয়া চাওয়া। ওমর [রাদিয়াল্লাহু আনহু] থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ ﷺ ইরশাদ করেছেন, তোমর যখন রোগীকে দেখতে যাবে,তার কাছে দোয়া চাইবে। কারণ, তাদের দোয়া ফেরেশতাদের দোয়ার মতো কবুল হয়। [ইবনে মাজাহ:১৪৪১]

উম্মে সালামা [রাদিয়াল্লাহু আনহা] থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ ﷺ ইরশাদ করেছেন, যখন তোমরা মুমুর্ষ ব্যক্তির নিকট যাও, তখন ভালো কথা বলবে, কেননা ফেরেশতারা তোমাদের সাথে আমীন বলে। [ সহিহ মুসলিম: ৯১৯]

১০. রোগী মুমুর্ষ হলে তার নিকট সুরা ইয়াসিন পাঠ করা।

১১.অসুস্থ ব্যক্তির অবস্থা সম্পর্কে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা না করা। কারণ, অনেক সময় এতে রোগী বিব্রত বোধ করে। অবশ্য চিকিৎসকের বিষয়টি ভিন্ন।

১২.রোগীর সাক্ষাতের জন্য উপযুক্ত সময় নির্বাচন করা, যাতে তার কোনো অসুবিধা না হয়। রোগীর সাক্ষাতে গিয়ে তাকে আনন্দ দেয়ার চেষ্টা করব। তার সাথে বন্ধুত্ব সুলভ আচরণ করবে। সাহস দিয়ে বলবে, আল্লাহ খুব দ্রুত সুস্থ করে দিবেন। এই অসুস্থতায় তিনি নেকি দিবেন এবং গুনাহসমূহ মিটিয়ে দিবেন, ফলে সে পবিত্র হয়ে যাবে।

১৩. রোগী দেখার সময় হাদিসে বর্ণিত নিম্নোক্ত দোয়াটি পড়াÑ
ইবনে আব্বাস [রাদিয়াল্লাহু আনহুমা] থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ ﷺ একজন অসুস্থ বেদুঈনকে দেখতে গেলেন। তিনি যখন কোনো রোগী দেখতে যেতেন, তখন এই দোয়া পড়তেন-

لَا بَأْسَ طَهُوْرٌ إِنْ شَاءَ اللهُ.

কোনো সমস্যা নেই। (এ অসুস্থতা গুনাহসমূহকে) পবিত্র করে দেবে।
সেই বেদুঈন বলল, আপনি তো বলছেন, অসুস্থতা গুনাহ থেকে পাক করবে, কিন্তু (তা নয়) এটা তো এমন জর যা বৃদ্ধের ওপর চড়াও হয়েছে, তাকে কবরে নিয়ে ছাড়বে। রাসুলুল্লাহ ﷺ বললেন, তাহলে তাই হবে।
[ সহিহ বুখারি: ৫৬৫৬]

এই হাদিসের মূল ভাষ্য হল-

لَا بَأْسَ هُوَ طَهُوْرٌ لَكَ مِنْ ذُنُوْبِكَ إِنْ شَاءَ اللهُ.

কোনো সমস্যা নেই। এই অসুস্থতা তোমার গুনাহসমূহ মিটিয়ে দেবে।

১৩. সম্ভব হলে নিম্নে বর্ণিত দোয়াটি পড়া
আবু সাঈদ খুদরি [রাদিয়াল্লাহু আনহু] থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, জিবরিল (আ.) রাসুলুল্লাহ ﷺ এর নিকট এসে বললেন, আপনি কোনো ব্যথা অনুভব করছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। জিবরিল (আ.) বললেন-

بِسْمِ اللهِ أَرْقِيْكَ مِنْ شَيْءٍ يُؤْذِيْكَ مِنْ شَرِّ كُلِّ نَفْسٍ أَوْ عَيْنٍ حَاسِدٍ اللهُ يَشْفِيْكَ بِسْمِ اللهِ أَرْقِيْكَ.

আল্লাহর নামে আপনাকে দম করছি, প্রত্যেক কষ্টদায়ক বস্তু থেকে যা আপনাকে কষ্ট দিচ্ছে। প্রত্যেক আত্মার অনিষ্ট থেকে অথবা হিংসুকের চক্ষু থেকে। আল্লাহ আপনাকে সুস্থতা দিবেন। আমি আল্লাহর নামে আপনাকে দম করছি। [ সহিহ মুসলিম: ২১৮৬]

১৪.রোগীর নিকট বসে নিন্মুক্ত দোয়াটি পড়া
আয়েশা [রাদিয়াল্লাহু আনহুমা] থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবি করিম ﷺ স্বীয় পরিবারকে এভাবে তাআউয করতেনÑ নিজের দুহাত হালকাভাবে বুলিয়ে দিতেন আর এই দোয়া পড়তেন-

اَللّهُمَّ رَبَّ النَّاسِ أَذْهِبِ الْبَأْسَ وَاشْفِهِ وَأَنْتَ الشَّافِيْ، لَا شِفَاءً إِلَّا شِفَاؤُكَ، شِفَاءً لَا يُغَادِرُ سَقَمًا.

হে আল্লাহ! মানুষের প্রতিপালক, অসুস্থতা দূর করে দিন, তাকে সুস্থতা দান করুন, আপনিই আরোগ্যদাতা। আপনার আরোগ্য ছাড়া কোনো আরোগ্য নেই। এমন আরোগ্য দিন, যা কোনো রোগী বাদ না-পড়ে।
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা] আরেকটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে, সেখানে তিনি বলেছেন, ‘যখন আমাদের পরিবারের কেউ অসুস্থ হত, রাসুলুল্লাহ ﷺ তার শরীরে ডান হাত বুলিয়ে দিতেন এবং এই দোয়া পড়তেন। অপর এক বর্ণনায় আয়েশা [রাদিয়াল্লাহু আনহা] বলেছেন, রাসুলুল্লাহ ﷺ দোয়া পড়ার সময় দম করতেন। তারপর আয়েশা [রাদিয়াল্লাহু আনহা] উপরিউক্ত দোয়াটি উল্লেখ করেছেন। [ সহিহ মুসলিম: ২১৯১]

১৫.রোগীর শরীরে ব্যথা থাকলে এই দোয়া পড়ে দম করা
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা] থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন কোনো ব্যথিত তার শরীরের কোনো অঙ্গে ব্যথা অনুভব করত অথবা শরীরের কোনো স্থানে ফোঁড়া দেখা দিত, তখন [ওই স্থানে] আঙ্গুল বুলাতে বুলাতে রাসুলুল্লাহ ﷺ এই দোয়া পড়তেন-

باسْمِ اللَّهِ، تُرْبَةُ أرْضِنَا، برِيقَةِ بَعْضِنَا، يُشْفَى سَقِيمُنَا، بإذْنِ رَبِّنَا.

আল্লাহর নামে (আরোগ্য চাচ্ছি) আমাদের জমিনের মাটি এবং আমাদের কারো থুতু মিশিয়ে, যাতে আমাদের রবের আদেশে আমাদের অসুস্থ ব্যক্তি সুস্থ হয়ে যায়। [বুখারি: ৫৭৪৫]

হাদিস দ্বারা বুঝা যায়, রাসুলুল্লাহ ﷺ মাটির সাথে নিজের থুতু মিশাতেন। তিনি হাতের তর্জনীতে থুথু নিয়ে তা মাটির সঙ্গে মেশাতেন। অত:পর ব্যথার জায়গায় মাটি মাখা আঙ্গুল বুলাতেন আর উপরিউক্ত দোয়াটি পড়তেন।
মাটি ও মানুষের থুতুর মাঝে আরোগ্য রয়েছে। মোল্লা আলী ক্বারী [রাহিমাহুল্লাহু] বলেন, ‘আমি চিকিৎসা শাস্ত্রের কিছু আলোচনায় নিরীক্ষণ করেছি, অসুস্থতার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া প্রতিরোধের ক্ষেত্রে মাটি ও থুতুর বিশেষ প্রভাব রয়েছে। [ মিরকাত]

১৬.সুরা ফাতেহা এবং তিনকুল পড়ে রোগীর শরীরে দম করবে।

লেখক: কলামিষ্ট, ইমাম ও খতিব, বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ।

কেএল/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ