মাসউদুল কাদির।।
রাজধানীতে পড়াশোনার সোনালী সময় পার করেছি শেখ জনুরুদ্দীন রহ. দারুল কুরআন মাদরাসায়। জীবনের পরতে পরতে প্রতিষ্ঠানটির কথা মনে পড়ে। ভুলে যাওয়াটাই কঠিন। ১৯৯৮ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত আমার ভেতরকার সব শব্দ, লিপি, ভালোবাসা, রাগ-অনুরাগ তৈরিতে প্রতিষ্ঠানটি পরশপাথরের মতো কাজ করেছে।
পুরনো ভবনের এমন কোনো জায়গা ছিলো না, কোনা ছিলো না যা আমার বা আমাদের নখদর্পণের বাইরে। মূল নায়ক ছিলেন প্রিয় উস্তাদ আল্লামা মুহাম্মদ ইসহাক ফরিদী রহ.। তার কারণেই বিশ্বজুড়ে সুনাম কুড়িয়েছিল চৌধুরীপাড়া মাদরাসা। আজ মাদারাসাটির ৩০ সালা উপলক্ষে আয়োজন দেখে কী খুশি হতেন প্রিয় এই উস্তাদ- তা বলাবাহুল্য।
এ প্রতিষ্ঠানে আমার উস্তাদদের মধ্যে ইন্তেকাল করেছেন মুফতী মুতীউর রাহমান রহ., মাওলানা জাফর আহমদ আশরাফী ও প্রিয় উস্তাদ ইসহাক ফরিদী রহ.,।
জান্নাতে ভালো থাকুন আমার প্রিয় উস্তাদগণ। আমরা যখন মিজানে পড়ি, আমাদের ক্লাসসঙ্গী মুহাম্মদ ইসহাক তখন ইন্তেকাল করেছিল। মনে পড়ে, জাফর সাহেব ইসহাককে বকাবাদ্য করতেন। ক্লাসে দেরিতে বসার কারণে। তাকরারেও সে দেরিতে আসতো। ওটা আমারও ভালো লাগতো না। মিজানের বছর আমাদের সঙ্গীরা ওর জন্য অনেক কেঁদেছিল। জাফর সাহেব ওর মৃত্যুটা যেনো নিতেই পারছিলেন না। শিক্ষার্থীর প্রতি উস্তাদের প্রকৃত সেই দরদ আমি দেখেছিলাম।
আজকাল এমন উস্তাদীয় দরদ কতটুকু আছে তা বড় বিস্ময়। চৌধুরীপাড়ায় মান্যবর যেসব উস্তাদদের কাছে আমরা পড়েছি, যারা এখনো বেঁচে আছেন, তাদেরকে আল্লাহ তাআলা সুস্থ ও সুন্দর রাখুন। প্রিয় উস্তাদ রিদওয়ান হাবিবসহ অনেকেই অসুস্থ আছেন। আল্লাহ তাআলা তাদেরকে পূর্ণ সুস্থতা দান করুন।
চৌধুরীপাড়া মাদরাসা বড় আবেগের নাম। ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দু। এখানে আমরা ছিলাম মৌমাছি হয়ে। কী নিতে পেরেছি। কী পেয়েছি। তারচেয়ে বড় বিষয় হলো, আমাদের প্রিয় উস্তাদগণ অনেক বেশি দিতে চেয়েছেন। তাদের ভালোবাসার কোনো ঘাটতি কখনও দেখিনি। কী দরদমাখা সুরলহরি দিয়ে আমাদের গড়বার চেষ্টা করেছেন-তা মনে হলেই অস্থির হই। একজন উস্তাদ একদিন সম্মিলিত এক অপরাধের কারণে সবাইকে শাস্তি দিতে দিতে নিজেই কেঁদে ফেলেছিলেন। আমরা যে বলি, গুরু-শিষ্য সমান সমান বাপ-বেটা।
কেবল আমি নই, চৌধুরীপাড়ার নূর মসজিদের দ্বিতীয় তলায় তখন যারাই উপস্থিত ছিলেন সব্বাই দেখেছেন শিষ্য-পুত্রের প্রতি প্রিয় উস্তাদের কী নির্মল ভালোবাসা।
অনেকে বলবেন, একটানে আটবছর পার করে দিলেন চৌধুরীপাড়ায়? কোনো ক্লান্তি লাগেনি। কীভাবে? পেখম মেলে দাঁড়িয়ে ছিলো এক ময়ূর। পক্ষী। ফুল। চেহারায় আবছা আবছা মায়া মায়া রাগ ও ভালোবাসার সেই সে চাদর ইসহাক ফরিদী রহ.। একবার যার চোখে চোখ পড়েছে, শাসনে-ভালোবাসায় চাদরে মুড়ি দিয়ে অকাতরে ভালোবাসা বিলিয়েছেন তিনি। এখান থেকে আর কেউ ছাড়া পায়নি।
এমন এমন ভালোবাসার পারদ যেখানে প্রতিটি মুহূর্তে জ্বলে উঠতো, প্রতিটি ইট, বালি-কণার ভেতরে যে প্রেম লুকায়িত ছিল-তা ফেলে অন্যত্র ছুটে যাওয়া বড় কঠিন ছিল।
একজন উস্তাদের কথা বলি, তিনি যেকোনো কারণেই হোক, চৌধুরীপাড়া থেকে চলে গিয়েছিলেন। সে অনেক আগের কথা। তিনি একদিন আমাকে বললেন, দেখো মাসউদ, রিকশায় করে চৌধুরীপাড়া মাদরাসার সামনে দিয়ে যেতে বড় কষ্ট হয়। এরচেয়ে বড় জায়গায় চাকুরি করি। কাজ করি। কিন্তু মাদরাসাটির সামনে দিয়ে গেলে, একবার চোখ পড়লে জল-টলমল হয়ে যায়। আটকে রাখতে পারি না চোখের পানি।
এ যে প্রেম এটা ভিন্নকিছু।
প্রতিষ্ঠানটি উস্তাদ-শাগেরদকে দরদিয়া বানাতে সাহায্য করেছে যুগ যুগ ধরে। ভালোবাসার এ প্রতিষ্ঠানটির আজ ত্রিশসালা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এ ঘোর অন্ধকারে একপসলা আলোর বৃষ্টি। এ বৃষ্টি চিরকাল অব্যাহত থাকুক। বর্তমান সিপাহসালারদের অনেকেই আমার পরমপ্রিয় উস্তাদ। আমি তাদের দীর্ঘায়ু কামনা করি। আছেন প্রিয় বন্ধুবরেষু অনেকেই। তাদের প্রতিও শুভ কামনা সবসময়।
যারা দূর দূরান্ত থেকে ত্রিশসালার অনুষ্ঠানে যুক্ত হচ্ছেন আমি অধম স্বাগত জানাই সব্বাইকে। ব্যস্ত রাজধানীতে আপনার আগমন শুভ হোক।
লেখক: সহকারী সম্পাদক, দৈনিক আমার বার্তা
-এটি