মুফতি তাকি উসমানি
বাস্তব কথা হল আমি বয়ান করার কোনো যোগ্যতাই রাখি না। বক্তা ও ওয়ায়েজদের মতো আমি কোনো বক্তব্য বা ওয়াজও করতে পারি না। তবে দ্বীনী কথাবার্তা কোনো বক্তৃতা, ওয়াজ বা বয়ানের মুখাপেক্ষী নয়। ইখলাসের সাথে সাধারণ কথাবার্তাও অনেক উপকারী হয়। কিন্তু (আল্লাহ না করুন) যদি ইখলাস না থাকে তাহলে লম্বা লম্বা ওয়াজও নিরর্থক হয়ে যায়।
এই মুহূর্তে যে কথাটা দিলে এসেছে সেটি হচ্ছে, আমরা যত কাজ করছি, আল্লাহ তাআলার ফযল ও করমে আমাদের দ্বারা যত ইলমী ও দ্বীনী কাজ হচ্ছে-চাই তা শিক্ষা-দীক্ষা হোক, লেখালেখি হোক, ফতোয়া বা ইমামতি, যাই হোক-এসবের সম্পর্ক সরাসরি দ্বীনের সাথে। এবং এটা আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে অনেক বড় রহমত যে, তিনি আমাদেরকে এই মহান কাজের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন।
অন্যথায় আমরা অন্য যে কোনো ব্যস্ততায় আবদ্ধ হয়ে যেতে পারতাম। নিজের পেট চালানোর জন্য মানুষ কত উপায়ই না গ্রহণ করছে। আমরাও হয়তো কোনো একটা বেছে নিতাম। কিন্তু আল্লাহ তাআলা তার অশেষ রহমতে আমাদেরকে কোনো না কোনো এমন কাজের সাথে সম্পৃক্ত রেখেছেন যার সম্পর্ক সরাসরি দ্বীনের সাথে। এর শোকর আদায় করে আমরা শেষ করতে পারব না। কেননা এটা একমাত্র আল্লাহ তাআলার তাওফীক ও দয়া। তিনি যাকে ইচ্ছা দয়া করে তার দ্বীনের কাজে লাগিয়ে দেন।
অনেক সময় বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং এমন উপায়-উপকরণ সামনে চলে আসে যে, মানুষ ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় এ জাতীয় দ্বীনী কাজের সাথে লেগে থাকে। আমি আমার নিজের অবস্থাই বর্ণনা করি। ছোটকালে আমার কবিতা বা শে’র-এর প্রতি খুব আগ্রহ ছিল। আমার বয়স যখন ৪/৫ বছর তখন আমি যেকোনো বিষয়ে কবিতা বলতে পারতাম। এমনকি আমাদের বোনেরা, যারা কখনো স্কুলের ধারেকাছেও যায়নি-তারাও কবিতা বলতে পারত। আমার মামা খুব ভালো কবি ছিলেন। ওই বয়সে যখন কোনো কবিতা শুনতাম তখন তা নিয়েই ব্যস্ত থাকতাম এবং মুখে মুখে আবৃত্তি করতাম। একটু বড় হওয়ার পর বড় বড় কবিদের বই পড়তে আরম্ভ করলাম এবং নিজেই সুন্দর সুন্দর কবিতা বলতে লাগলাম। ১২ বছর বয়সে গজল বলা আরম্ভ করলাম। এভাবে সাহিত্য-কবিতা ইত্যাদির প্রতি ওই বয়সে একটা ঝোঁক তৈরি হয়ে গিয়েছিল।
এর কারণ ছিল, আমি যখন দারুল উলূমে পড়ি তখন যে শিক্ষকের কাছে আমরা নাহবেমির থেকে শরহে জামী পর্যন্ত পড়েছি মাওলানা সাহবান মাহমুদ ছাহেব, তিনি খুব ভালো কবি ছিলেন। এমনকি দরসের মধ্যেও তিনি কবিতা বিষয়ে আলোচনা করতেন। এতে কবিতার দিকে আমাদের আগ্রহ হয়।
আবার কখনো আরবী সাহিত্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার আগ্রহ জেগে উঠত। কিন্তু সে পথে বেশি দূর যাওয়া হয়নি। যদি নিজের আগ্রহ মোতাবেক চলতাম তাহলে আল্লাহ জানেন আজ কোথায় কি হত। আমার আববাজান রাহ. এই কাজে (ফতোয়া) লাগিয়ে দিয়েছেন। মানুষের ঝোঁক থাকে একদিকে, কিন্তু আল্লাহ তাআলা তার ফযল ও করমে সে ঝোঁকের গতি পরিবর্তন করে দেন অন্যদিকে।
এজন্য এটা আল্লাহ তাআলার অনেক বড় দয়া ও মেহেরবানি যে, তিনি আমাদেরকে দ্বীনী কাজের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন। আমরা এর শোকর আদায় করে কখনো শেষ করতে পারব না। কিন্তু এই কাজকে উপকারী বানানোর জন্য, দুনিয়া ও আখিরাতে এর দ্বারা ফায়দা হাসিলের জন্য এ কাজের রূহ বা প্রাণটাকে আগে চিনতে হবে ও অবলম্বন করতে হবে। প্রতিটি দ্বীনী কাজের একটি রূহ রয়েছে। যতণ পর্যন্ত ওই রূহ অর্জিত না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত ওই দ্বীনী কাজ দ্বারা ফায়দা হাসিল করা সম্ভব হয় না; বরং অনেক সময় তা অনেক বড় ফেতনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এজন্যই দুআ করা হয়-
اللهم إني أعوذ بك من علم لا ينفع
ইলম তো চাই, কিন্তু এমন ইলম নয়, যার কোনো ফায়দা নেই।
তো এ ইলম উপকারী হওয়ার জন্য এবং এই ইলমকে উপকারী বানানোর জন্য তাতে রূহ থাকতে হবে। ইলমের মধ্যে যখন ওই রূহ এসে যাবে তখন এটা উপকারী হয়ে যাবে। মানুষ এর দ্বারা উপকৃত হবে। এর সৌরভ চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে। গোটা জগত এর দ্বারা উপকৃত হতে থাকবে। ওই ব্যক্তির জন্য তা সদকায়ে জারিয়া হয়ে যাবে। আল্লাহর কাছে পৌঁছার পর আল্লাহর সন্তুষ্টি তার নসীব হবে। আর যদি ওই ইলম (আল্লাহ না করুন) উপকারী না হয়, এতে রূহ না থাকে তাহলে তা একটি প্রাণহীন শরীর হিসেবে গণ্য হবে। যার কোনো রূহ নেই। দেখতে সবকিছুই ঠিকঠাক। হাত, পা, কান, সব ঠিক। কিন্তু তার মধ্যে রূহ নেই। তখন তো সেটা আর মানুষ থাকেনি; বরং তা প্রাণহীন জড় বস্তর মধ্যে গণ্য হয়। (আল্লাহ না করুন) ওই ইলমের মধ্যেও যদি রূহ না থাকে তখন তাও এ রকম মৃত লাশের মতো; বরং মৃত লাশের তো কোনো উপকার করার শক্তি নেই, আবার অপকার করারও শক্তি নেই। কিন্তু ইলম যদি উপকারী না হয়, এতে রূহ না থাকে তাহলে তা শুধু এমন নয় যে, কোনো উপকার করে না; বরং তা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এর দ্বারা ফেতনা সৃষ্টি হয়। এজন্যই আমাদের ইলমের মধ্যে যেন রূহ সৃষ্টি হয়-এর ফিকির করতে হবে।
ওই রূহটা কী? যদি একশব্দে তা বলতে চাই তাহলে সেটা হল, ইখলাস। ইলম যদি ইখলাসের সাথে শেখা ও শেখানো হয় অর্থাৎ এই ইলম আমি এজন্য শিখছি এবং অন্যের কাছে পৌঁছে দিচ্ছি যেন আমার আল্লাহ আমার ওপর রাজি হয়ে যান তাহলে তার রূহ বা প্রাণটা ঠিক থাকবে। এটাই হল সমস্ত আমলের রূহ।
আর যদি (আল্লাহ না করুন) ইখলাস না থাকে তাহলে এই ইলমের কারণে আমার দ্বারা ফেতনা স"ষ্টি হবে। যখন এই ইলম ইখলাসের সাথে না হয়, একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে না হয়ে মাখলুকের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হয় মানুষের প্রশংসা অর্জনের উদ্দেশ্যে হয়, মানুষের মাঝে নিজের প্রসিদ্ধি অর্জনের উদ্দেশ্যে হয়, মানুষ থেকে দুনিয়াবী ফায়েদা হাসিলের উদ্দেশ্যে হয়-তখন ওই ইলম থেকে ফেতনা জন্ম নেয়।
পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়। ভাবনা আসে, অমুকের প্রসিদ্ধি বেশি হয়ে গেছে আমারও ওই রকম প্রসিদ্ধি অর্জন করতে হবে। মানুষের মাঝে অমুকের গ্রহণযোগ্যতা বেশি হয়ে গেছে এখন সে এই চেষ্টায় লেগে গেছে যে, আমি তার থেকেও এগিয়ে যাই। অথবা সে আমার থেকে পেছনে পড়ে যাক। আমার প্রসিদ্ধি বেশি হোক। মানুষ আমাকে বেশি মানুক ইত্যাদি। যখন এসব এসে যায় তখন ইখলাস শেষ হয়ে যায়। এর পরিণতিতে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব শুরু হয়। বিভিন্ন গ্রুপিং সৃষ্টি হয়। মানুষ বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং একে অন্যের প্রতি হিংসা-দলাদলির ধারাবাহিকতা শুরু হয়ে যায়। এত কিছু কেন হয়? এজন্য যে, ইখলাস-যা ইলমের রূহ, তা উপস্থিত নেই।
আর যদি ইখলাস থাকত (আল্লাহ তাআলা দয়া ও মেহেরবানি করে আমাদের সকলকে ইখলাসের দৌলত নসীব করুন) তাহলে এর ফলাফল এই হতো যে, যে ব্যক্তি দ্বীনের কাজ করছে, যার দ্বারা কোনো না কোনোভাবে দ্বীনের উপকার হচ্ছে তার সম্পর্কে সে ভাবত, এটা তো আমারই কাজ ছিল। সে এই কাজটা করছে। এতে সে আমারই উপকার করছে। এটা তো মেহনত করে আমারই করতে হত। ওই আল্লাহর বান্দা আমার প থেকে কাজটা করে দিয়েছেন। অন্তরে এই অনুভূতি বসে গেলে পারস্পরিক মুহাববত সৃষ্টি হবে। ভাবনাটাই হবে এমন যে, ওই কাজ তো আমার করার দরকার ছিল। এটা তো আমার জন্য আনন্দের ব্যাপার, খুশির ব্যাপার যে, সে আমার কাজ করে দিচ্ছে। আমি তার সাথে লড়তে যাব কেন? সে কেন এটা অর্জন করে ফেলল-এজন্য হিংসা করতে যাব কেন। এটাই হল ইখলাস ও ইখলাসশূন্যতার মধ্যে পার্থক্য।
হযরত মাওলানা ইদ্রিস কান্ধলভী রাহ.। অনেক বড় বুযুর্গ এবং অত্যন্ত সরল-সাদাসিধা মানুষ ছিলেন। আমার আববাজান রাহ.কে খুব মুহাববত করতেন। একবার আমি তাঁর খেদমতে গিয়েছি। তিনি তখন পায়চারি করছিলেন। আমাকে বললেন, মৌলভী শফীকে আমার সালাম বলবে। সবসময় বলতেন, মৌলভী শফী। তাঁর নামের আগে-পরে এত লম্বা-চওড়া লকব-উপাধি লাগানোকে পছন্দ করতেন না। এরপর বললেন, আচ্ছা মৌলভী সাহেব, আরেকটা কথা শোনো। আমি বললাম, জ্বী। তিনি বললেন, মৌলভী শফী সাহেবের সাথে আমার ৫২ বছরের সম্পর্ক। (সাহেব বলেছেন কি না আমার মনে নেই) এবং মুহাববতের সম্পর্ক। এই মুহাববতের সম্পর্ক দিন দিন বেড়েই চলেছে। এই লম্বা সময়েও ওই
মুহাববতের সম্পর্কের মধ্যে কোনো কমতি আসেনি। আচ্ছা মৌলভী সাহেব! তুমি কি জান, কেন এত লম্বা সময়েও সম্পর্কে কোনো কমতি আসেনি? একথা বলে তিনি একটি সূক্ষ্ম ইলমী বিষয় টেনে আনলেন। বললেন, মৌলভী সাহেব! তুমি কাফিয়া পড়েছ? আমি বললাম, জ্বী, পড়েছি। বললেন, কাফিয়ার মধ্যে মাতবুআত-এর একটি অধ্যায় আছে। আমি বললাম, জ্বী আছে।
তাতে পূর্বের তাওয়াবে’-এর একটি ছিফত হয়। ঐ ছিফত দুই প্রকার। একটা ছিফত হয় মাতবু-এর। আরেকটা ছিফত হয় মুতাআল্লিকে মাতবু’-এর। যেমন-زيد عالم বললে যায়েদ-এর ছিফত হয় আলিম। আবার মুতাআল্লিকে মাতবু-এর ছিফত হয়। অর্থাৎ زيد العالم أبوه এখানে ‘আলআলিমু’ বাস্তব ছিফত হল ‘আবূহু’-এর। কিন্তু তারকীবের সময় ‘আলআলিমু’ শব্দটি ‘যায়েদ’-এর ছিফত হবে।
زيد العالم أبوه ـ أخوه এখানে ‘যায়েদ’ মওসুফ আর ‘আলআলিমু আবূহু’ হল তার ছিফত। কিন্তু আলিম মূলত ‘আবূহু’-এর ছিফত। এরপর তিনি বলেন, মৌলভী সাহেব। যখন মৌলভী শফীর কোনো ইলমী কাজ আমার সামনে আসে তখন আমি নিজেকে زيد العالم أبوه এর মতো মনে করি। অর্থাৎ আমার ভাই যে দ্বীনী কাজ করছে এটা তো আমারই কাজ। যখন তার কোনো তাসনীফ বা রচনা আমার সামনে আসে তখন আমি মনে করি যে, এটা আমারই কাজ ও কৃতিত্ব। তার সাথে আমার ৫২ বছরের সম্পর্ক। এই মনোভাব নিয়েই আমি চলছি। এতে কখনো সামান্য ফাটল সৃষ্টি হয়নি। এখন যদি কোনো আলিম কোনো দ্বীনী কাজ করে তখন অন্যজন সেটাকে নিজের জন্য অসম্মানের মনে করে। তাই মৌলভী সাহেব! এগুলো থেকে বেঁচে থাকবে।
দেখুন, মাত্র দুই শব্দে তিনি কত বড় হাকীকত বর্ণনা করে দিয়েছেন। যদি আমার মধ্যে এই চেতনা এসে যায় যে, যে-ই দ্বীনের কোনো উপকারী কাজ করছে সে আমারই কাজ করছে, তখন এই অনুভূতি তার ইলমের মধ্যে ইখলাস সৃষ্টি করবে। এবং এতে নূর পয়দা হবে। আন্তরিকতা সৃষ্টি হবে। পরস্পরের প্রতি ঘৃণা, দুশমনি দূর হয়ে যাবে। হিংসা-বিদ্বেষ থাকবে না।
কিন্তু কোথাও যদি এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে যায় যে, আমার নাম হোক, আমার কর্তৃত্ব অর্জিত হোক, আমার গলায় মালা পরানো হোক, আমার প্রসিদ্ধি-পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ুক তখন সেখান থেকেই ওই দোষগুলি আসা শুরু হয়ে যাবে। পরস্পরের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ সৃষ্টি হবে। এবং ইখলাস, যা দ্বীনের রূহ সেটা শেষ হয়ে যাবে। ইখলাসের সাথে যদি কোনো সংক্ষিপ্ত বাক্যও বলা হয় তাহলে তাও খুব ফায়েদা দেয়। শ্রোতার অন্তরে তার প্রভাব পড়ে। জীবনের গতি পরিবর্তন করে দেয়। আর ইখলাস ব্যতীত জ্বালাময়ী বক্তব্য দিয়ে দাও, অগ্নিঝরা বক্তা বনে যাও, বড় নামকরা ওয়ায়েজ হয়ে যাও, সে বক্তার কথা শ্রোতার এক কানে ঢুকবে অন্য কান দিয়ে বের হয়ে যাবে। অন্তরে কোনো প্রভাবই পরিলক্ষিত হবে না।
আমার আববাজান রাহ.কে বলতে শুনেছি যে, হযরত আবদুল কাদের জিলানী রাহ.-এর একজন ছেলে ছিল। নতুন আলিম হয়েছে। দেশ-বিদেশ থেকে অনেক ইলম অর্জন করে এসেছে। ফিরে এসে আববাজানের খেদমতে উপস্থিত হল। হযরত শায়খ জিলানী রাহ. তার দরবারে উপস্থিত লোকদের সামনে মাঝে মাঝে বয়ান করতেন। এখন ছেলে যেহেতু নতুন নতুন ইলম শিখে এসেছে তাই তাকে বললেন, আজকে অনেক মানুষ উপস্থিত হয়েছে। আজ তুমিই বয়ান কর। তখন ছেলে তো নতুন নতুন ইলম অর্জন করে এসেছে। তাজা ইলম ছিল, আগ্রহ-উদ্দীপনাও ছিল প্রচুর। এক জ্বালাময়ী বক্তব্য দিয়ে দিলেন। ইলমের দরিয়া প্রবাহিত করে দিলেন। উপস্থিত লোকজন চুপচাপ শুনলেন। তাদের অবস্থা হল, আমাদের শায়খের ছেলে বয়ান করছে। শুনতে হচ্ছে, শুনছি। ব্যস, এতটুকুই। কারো মাঝে কোনো পরিবর্তন বা প্রভাব পরিলক্ষিত হয়নি। যখন তার বয়ান শেষ হল তখন শায়খ রাহ. বসলেন। বললেন, ভাই! আমি গত রাতে রোযা রাখার নিয়ত করেছিলাম। এজন্য এক পেয়ালা দুধ সাহরীর সময় পান করার জন্য তুলে রেখেছিলাম। এর মধ্যে রাতে বিড়াল এসে সব দুধ খেয়ে ফেলল। যার কারণে আমি আজ রোযা রাখতে পারিনি।’ একথা বলার সাথে সাথেই পুরা মজলিস হু হু করে কেঁদে উঠল।
তিনি কোনো সূক্ষ্ম ইলমী বিষয়ও বললেন না, কোনো ফাসাহাত-বালাগাতও বর্ণনা করলেন না। সাদাসিধাভাবে একটা ঘটনা শুনিয়ে দিলেন আর পুরা মজলিস গড়াগড়ি খেতে লাগল। পরে শায়খ রাহ. ছেলেকে বললেন, বেটা! তুমি যে ইলম অর্জন করে এসেছ। মাশাআল্লাহ, আল্লাহ তোমার ইলমে আরো উন্নতি দান করুন। এটা শুধু মানুষের কান পর্যন্ত পৌঁছেছে। এখন ঐ ইলম অর্জন করার চেষ্টা কর, যা দিলে প্রভাব ফেলে, অন্তরে নাড়া দেয়।
কখন অন্তরে নাড়া দিবে? যখন তা ইখলাসের সাথে হবে। যে কথা ইখলাসের সাথে দিল থেকে বের হয় তা মানুষের অন্তরে প্রভাব ফেলে। তুমি যখন ওই ইখলাস অর্জন করবে তখন যা বলবে তা মানুষের অন্তরে পৌঁছে যাবে। তাদের যিন্দেগী পরিবর্তন হয়ে যাবে। এতে তোমার ইলম সদকায়ে জারিয়া হবে। আখিরাতে কাজে আসবে।
সারকথা হল আমাদের ইলমের রূহ হল ইখলাস। এখন আমাদের কাজ হল, আমরা যে কাজই করব, শুধু আল্লাহর জন্যই করব। মাখলুক থেকে পরিপূর্ণভাবে দৃষ্টি সরিয়ে নেব। আমি যে কাজ করছি, মানুষ আমাকে এ ব্যাপারে ভালো বলছে কি খারাপ বলছে, প্রশংসা করছে কি নিন্দা করছে-এসব কিছু থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিজের দিলকে আল্লাহমুখী করে নিতে হবে যে, আমার আল্লাহ আমার এই কাজকে পছন্দ করছেন।
আববাজান রাহ. বলতেন, হিন্দিতে একটি প্রবাদ আছে, যার একটি অংশ হল-
پيا جسكو چاہے سهاگت وہی ہے.
পিয়া বলা হয় প্রেমিকাকে। আর কোনো মেয়ে যখন বলে তখন তার অর্থ হবে, স্বামী। কেননা মেয়েদের জন্য তার বাস্তব প্রেমিক একমাত্র স্বামীই হয়ে থাকে। আর সোহাগত বলা হয় যে মেয়ের স্বামী আছে এবং জীবিত আছে। তো এই প্রবাদবাক্যের একটা পটভূমি আছে। তা হল, একটা মেয়ের নতুন বিবাহ হয়েছে। বিবাহের পর যখন স্বামীর সাথে তার শ্বশুরালয়ে যাওয়ার সময় হল তখন তার বান্ধবিরা তাকে সাজগোজ করতে লেগে গেল। তারা তাকে স্বামীর বাড়িতে পাঠানোর জন্য তৈরি করতে লাগল এবং তার সৌন্দর্যের প্রশংসা করতে লাগল। একজন এসে বলে, তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। আরেকজন এসে বলে, তোমাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে। আরেকজন এসেও একই কথা বলে। মোটকথা, যে-ই আসে সেই তার রূপ-সৌন্দর্যের প্রশংসা করে।
আর ওই মেয়ে চুপচাপ শুধু তাদের কথা শুনে যায়। তখন তার এক বান্ধবী বলল, (এই মেয়ে!) তোমার কী হয়েছে? তোমার বান্ধবীরা তোমার এত প্রশংসা করছে কেউ এটা বলছে। কেউ ওটা বলছে। কিন্তু তুমি না তাদের ধন্যবাদ দিচ্ছ, না তাদের কথায় কোনো আনন্দ প্রকাশ করছ। তোমার কী হয়েছে?’ তখন সে মুখ খুলল। বলল, হ্যাঁ, এটা তো আমার জন্য আনন্দের এবং আমি তাদের ধন্যবাদও দিচ্ছি।
কিন্তু তাদের প্রশংসায় আমার কি ফায়েদা হবে? আমি যার কাছে যাচ্ছি (একমাত্র তার প্রশংসাই আমার কাজে আসবে)। সে যদি বলে, তুমি সুন্দর তাহলে আমি খুশি। অপরদিকে এরা সবাই আমার প্রশংসা করল। কিন্তু আমি যার কাছে যাচ্ছি সে যদি বলে, তুমি অসুন্দর। তাহলে তো আমার পুরা যিন্দেগী বরবাদ। এদের প্রশংসায় আমার কী আসে যায়।
আমার আববাজান রাহ. বলতেন, এক অবলা মেয়ে, সেও জানে যে, কার প্রশংসা তার কাজের, আর কার প্রশংসা বেকার। তদ্রূপ আমাদেরও এটা বুঝতে হবে যে, কার প্রশংসা আমার প্রয়োজন। সারা দুনিয়া যদি আমার প্রশংসা করতে থাকে, আমার নামে বিভিন্ন লকব-উপাধি লাগাতে থাকে, আরো কত কী বলতে থাকে তাদের সেসব প্রশংসা তো হাওয়ায় উড়ে গেছে। প্রশংসা করেছে তো তা হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। তাতে আমার কি ফায়েদা। আমার তো ওখানের প্রশংসা দরকার, যেখানে আমি যাচ্ছি। সেখানে যদি বলে, (তরজমা) হে প্রশান্ত মন! তুমি তোমার পালনকর্তার নিকট ফিরে যাও সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে। অতপর আমার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ কর।
তখন তার প্রশংসা আমার কাজে আসবে। চির জীবনের নেয়ামত আর সুখ-শান্তি আমার অর্জিত হবে।
তো আমাদের জন্য এটা অনেক বড় ফেতনা যে, মাখলুকের রেযামন্দি, মাখলুকের পছন্দ-অপছন্দ আমাদের কাজের মাপকাঠি হয়ে দাঁড়িয়েছে, যার ফলে অনেক সময় আমাদের কাজে ইখলাস আর থাকে না। এ ব্যাপারেই তো হাদীস শরীফে এসেছে-
তুমি যে উদ্দেশ্যে দুনিয়ায় ইলম শিখেছ-শিখিয়েছ তা বলা হয়ে গেছে। যা চেয়েছ ওখানে পেয়ে গেছ। এখানে তোমার জন্য আর কিছুই নেই।
আল্লাহ তাআলা তার ফযল ও করমে আমাদের সকলকে ইখলাসের দৌলত দান করুন। যেদিন আমাদের এই ইখলাস অর্জন হয়ে যাবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস ওইদিন আমাদের মধ্যকার সকল হিংসা-বিদ্বেষ, ঝগড়া-বিবাদ, গ্রুপিং-দলাদলি সব শেষ হয়ে যাবে। মনের ভেতরে জাগবে, যে দ্বীনের কাজ করছে সে আমারই কাজ করছে। তার যে উন্নতি হচ্ছে সেটা আমারই উন্নতি। যেদিন এই খেয়াল আমাদের অন্তরে বসে যাবে সেদিন ইনশাআল্লাহ আমাদের কাজে নূরও হবে, বরকতও হবে।
কিন্তু কখনো কখনো শয়তান আমাদেরকে বিভিন্নভাবে পথভ্রষ্ট করার চেষ্টা করে। আমার আববাজান রাহ. বলতেন যে, মৌলভীর শয়তানও মৌলভী হয়। সে কি কোন মৌলভীকে পথভ্রষ্ট করলে গুনাহকে সওয়াব বলে, খারাপকে ভালো আখ্যা দিয়ে পথভ্রষ্ট করবে? কখনো নয়, তার জানা আছে যে, এ মৌলভী। এ জানে কোনটা হালাল, কোনটা হারাম। কোনটা জায়েয আর কোনটা না-জায়েয।
সে তো পথভ্রষ্ট করার ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে। বলে যে, আমি যে আরেকজনের সাথে মতবিরোধ বা ইখতিলাফ রাখি সেই ইখতিলাফটাও দ্বীনের জন্যই রাখি। দ্বীনের চাহিদাই হল এটা যে, আমি তার সাথে ইখতিলাফ রাখি। তার থেকে আলাদা থাকি এবং নিজস্ব পরিচিতি গড়ে তুলি। কেননা সে দ্বীনের সঠিক ব্যাখ্যা, সঠিক মর্ম বর্ণনা করছে না। এজন্য নিজস্ব ক্ষেত্র তৈরি করব যাতে আমি দ্বীনের সঠিক ব্যাখ্যা, সঠিক মর্ম মানুষের সামনে উপস্থাপন করতে পারি। আমার আববাজান রাহ. বলতেন, শয়তান মৌলভীদেরকে এভাবেই ধোঁকা দেয়।
এজন্য একথা আমাদের খুব ভালোভাবে স্মরণ রাখতে হবে যে, অনেক সময় গন্তব্য এক হয়, কিন্তু
গন্তব্যে পৌঁছার রাস্তা বিভিন্ন হয়। আর রাস্তা কখনো মূল উদ্দেশ্য বা মাকসাদ হয় না। বরং তা গন্তব্যে পৌঁছার একটা মাধ্যমমাত্র। আমাদের মাঝে একটা বড় খারাবি এটাও ঘটে যে, কেউ একজন গন্তব্যে পৌঁছার জন্য একটা মাধ্যম গ্রহণ করল। আর ঐ মাধ্যমকেই নিজের মাকসাদ বানিয়ে নিল। আর এটাকে মাকসাদ বানানোর ফল এই দাঁড়াল যে, এই রাস্তা ব্যতীত অন্যগুলোর ব্যাপারে তার ধারণা গড়ে উঠল, এগুলি দ্বীনের সঠিক পথ নয়। তখন শয়তান আসে এবং রাস্তাকে মাকসাদ বানিয়ে দেয়। আঞ্চলিকতা, গোত্রপ্রীতি ইত্যাদি সৃষ্টি করে।
আমাদের সকলের গন্তব্য এক অর্থাৎ দ্বীন। আমরাও ওই গন্তব্যে পৌঁছব এবং অন্যদেরও পৌঁছানোর চেষ্টা করে যাব। এই গন্তব্যে পৌঁছার এক রাস্তা তাবলীগ, এক রাস্তা ওয়াজ ও বয়ান, এক রাস্তা লেখালেখি। গন্তব্যে পৌঁছার বিভিন্ন
রাস্তা রয়েছে। এখন যারা ওই গন্তব্যে পৌঁছার একটা রাস্তা বেছে নিল তারা মনে করে এটাই দ্বীন। বাকি যারা আরো অন্যান্য রাস্তায় চলছে তা দ্বীনই নয়। যেমন একজন তাবলীগের রাস্তা অবলম্বন করল। আমাদের তাবলীগী জামাত, মাশাআল্লাহ, সারা দুনিয়াব্যাপী আল্লাহ তাআলা তাদেরকে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা দান করেছেন এবং তাদের দ্বারা সারা দুনিয়ায় দ্বীনের যে উপকার হচ্ছে এরকম এককভাবে আর কোনো জামাত দ্বারা এত বেশি উপকার হচ্ছে না। কিন্তু কখনো কখনো তাদের অন্তরে এমন ধারণা সৃষ্টি হয় যে, আমরা যা করছি এটাই একমাত্র দ্বীনের কাজ। অন্য যারা আরো বিভিন্ন পন্থায় দ্বীনের কাজ করছে সেটা দ্বীনই নয়।
এক জায়গায় আমার জুমআর দিন আসরের পর বয়ানের প্রোগ্রাম ছিল। নামাযের পর সবাইকে উপস্থিত থাকার জন্য এলান করা হল। তখন আমাদের ওখানে মসজিদে যেসব তাবলীগী ভাইয়েরা আছেন তারা এসে আমাকে বলতে লাগল, আপনি বয়ানের জন্য ভুল সময় নির্ধারণ করেছেন। আমি বললাম, কেন? তারা বললেন, আজকের গাশতে মানুষ আসবে না। আমি বললাম, বয়ান কখন হয়? বললেন, মাগরিবের পর। আমি বললাম, আমাদের কথাবার্তা তো আসরের পর হবে। বললেন, না। আসরের পর যখন সবাই আপনার মজলিসে অংশগ্রহণ করবে তখন মাগরিবের পর আবার সময় দেওয়া তাদের জন্য কষ্টকর হয়ে যাবে এবং আমাদের গাশতের সমস্যা হয়ে যাবে। আমি বললাম, এটা তো কোনো সমস্যাই নয়। আমি নিজেই বলে দেব যে, মাগরিবের পর সবাই যেন শরিক থাকে। তারা বললেন, না। মানুষের জন্য কষ্টকর হয়ে যাবে। তারা বসবে না। বললাম, তাহলে আমার কি করার আছে? তখন তারা আমাকে বললেন, আপনি দ্বীনের কাজে বাধা সৃষ্টি করছেন। দ্বীনের তাবলীগের কাজে বাধা দিচ্ছেন।
তো কখনো কেউ কেউ এটা মনে করে যে, আমি যে পথ গ্রহণ করেছি এটাই দ্বীন। বাকি যারা আরো অন্যান্য পথে দ্বীনের কাজ করছে তা দ্বীনই নয়। এভাবে সে রাস্তাকেই মাকসাদ বানিয়ে নেয়।
এর দ্বারা আবার কেউ এটা মনে করবেন না যে, আমি তাবলীগের বিরোধিতা করছি। তাদের দ্বারা মাশাআল্লাহ দ্বীনের অনেক বড় কাজ হচ্ছে। কিন্তু অনেক সময় তাদের মধ্যে নিচের দিকে এমন লোকও আসে, যারা নিজেদেরকেও নিন্দিত করে এবং পুরা জামাতকে নিন্দার মুখোমুখি করে।
অতএব রাস্তা বা মাধ্যমকেই মাকসাদ বানিয়ে নেওয়া এটা শয়তানের এক বড় ধোঁকা। কেউ কোনো দ্বীনের কাজ করছে তো প্রথমে দেখতে হবে তার দ্বারা সামগ্রিকভাবে মানুষের উপকার হচ্ছে কি না? যদি তার দ্বারা কোনোভাবে মানুষের উপকার হচ্ছে-দেখা যায় তাহলে সে অনুমোদিত যে রাস্তাই গ্রহণ করুক ওই রাস্তা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ঐটাকে নিজের কাজ মনে করতে হবে। যখন আমাদের এই কাজের মধ্যে রূহ এসে যাবে তখন সেটা যে প্রকারের কাজই হোক না কেন চাই ওয়াজ-বক্তৃতা হোক, চাই মাদরাসায় পড়া-পড়ানো হোক, লেখালেখি হোক, ফতোয়া হোক, সবই নেক কাজ হবে। দ্বীনের কাজ হিসেবে গণ্য হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলের অন্তরে এই কথাগুলো বসিয়ে দিন এবং এর উপর আমল করার তাওফীক দান করুন।
-এটি