আবদুল আউওয়াল: ‘মুখস্থ বিদ্যা ভয়ানক’বা ‘মুখস্থ করার চেয়ে বুঝে পড়া অনেক ভালো’ কথাগুলো সর্ববিষয়ে সর্বজনে প্রযোজ্য নয়। বিশেষ করে কোরআনের বেলায় কথাগুলো অগ্রাহ্য। আল-কোরআন মানব রচিত কোনো গ্রন্থ নয়; ফলে তাকে সাধারণ পুস্তকের সাথে তুলনা করাও অবান্তর।
কোরাআন মানব হৃদয় থেকে যাবতীয় অজ্ঞতা ও গোমরাহির ব্যধি দূর করে তাকে আরোগ্য করে তোলে। পাঠকারীর ওপর খোদার অফুরন্ত রহমতের অমিয়ধারা বর্ষণ করে। (সুরা ইসরা:৮২) তাই এটি অনন্য গ্রন্থ। তার সঙ্গে কোনো গ্রন্থের তুলনা বর্জিত।
আজকাল কোরআনের হাফেজদের নিয়ে কিছু মানুষ এমন উদ্ভট কথাবার্তা বলছেন যা দ্বারা সাধারণ মুসলমান বিভ্রান্ত হচ্ছেন। তাদের যুক্তি- এই তথ্য-প্রযুক্তির যুগে গুগল, ইন্টারনেটে কোরআন সংরক্ষিত আছে। কোরআনের কোনো রেফারেন্সের জন্য তা মুখস্থ করার দরকার নেই। সাথে একটি স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ থাকলেই কোরাআনের যাবতীয় বিষয় অনলাইনে পড়া যাবে, গবেষণা করা যাবে।
সুতরাং এ যুগে বাচ্চাদের কোরআন মুখস্থ করানো অযৌক্তিক ও অবৈজ্ঞানিক। তাই বিষয়টি পরিষ্কার হওয়া দরকারÑ কোরআন মাজিদ মুখস্থ করার কোনো ফায়দা আছে কি না?
প্রথম কথা, আমরা মুসলমান। আমরা জানি ও বিশ্বাস করি আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে তাঁর ইবাদাতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। ইবাদাতের মর্মকথা হলো, আল্লাহ তায়ালার আনুগত্য করা। আর তাঁর আনুগত্য করতে হলে জানতে হবে তাঁর আদেশ-নিষেধ। শুনতে হবে তাঁর কথা। জানার অন্যতম মাধ্যম হলো আল-কোরআন। এই জন্য কোরআন পড়া, বুঝা ও মুখস্থ করা সবগুলোই ইবাদাত।
এমনকি কোরআন অজুসহ স্পর্শ করা, তার প্রতি দৃষ্টি দেয়া ও তেলাওয়াত শ্রবণ করাও ইবাদাত। নবী কারিম সা. বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোরআনের একটি হরফ পাঠ করবে সে দশটি নেকি লাভ করবে।’ (তিরমিজি:২৯১) সুতরাং কোনো মুসলমান যদি পড়ে- আলিফ-লাম- মীম, তাহলে সে তিনটি হরফ পড়ার কারণে ত্রিশটি নেকি পাবে। পূর্ণ ‘বিসমিল্লাহ’তে ১৯টি বর্ণ আছে। কেউ তা পড়লে ১৯০টি নেকি পাবে। সম্পূর্ণ কোরআনে বর্ণ আছে- ৩২৩৬৭১টি (মতান্তরে কমবেশি রয়েছে)।
সুতরাং একবার কোরআন খতম করলে সওয়াব দাঁড়াবে সংখ্যাটির সাথে দশ গুণন দিলে যা হবে তার সমপরিমাণ। একজন কোরআনের হাফেজ পূর্ণ কোরআন মুখস্থ করতে কতবার একেকটি বর্ণ পড়ছেন তার কোনো হিসাব কারো কাছে আছে কি? তিনি কী পরিমাণ নেকি অর্জন করেছেন তাও কারো জানা নেই। সুতরাং মুসলমানদের কোরআন মুখস্থ করা অনর্থক কাজ নয়। দ্বিতীয় কথা, আল্লাহ তায়ালা বলেন,‘আমি কোরআন অবতীর্ণ করেছি এবং আমিই এর সংরক্ষণ করব।’ (সুরা হিজর:৯)
পূর্বেকার সকল আসমানি কিতাব মানুষ নিজেদের ইচ্ছামত পরিবর্তন করে দিয়েছিল। তাই আল্লাহ তায়ালা কোরআন নাজিলের সময় এই ঘোষণা দিলেন যে, এটি আমার বিশেষ নির্বাচিত কিতাব তাতে কেউ কোনো রকমের পরিবর্তন-পরিবর্ধন করতে পারবেনা।
প্রশ্ন জাগে, আল্লাহ তায়ালা তাঁর এই ওয়াদা দুনিয়ায় কিভাবে বাস্তবায়ন করবেন? এই প্রশ্নের জবাব তিনি এভাবে দিয়েছেন, ‘আমি কোরআন উপদেশের জন্য সহজ করেছি। আছো কি কেউ উপদেশ নেবে?’ (সুরা কামার:১৭) এই আয়াতের ব্যাখ্যা সমস্ত মুফাসসিরিন এভাবে করেছেন-‘আমি কোরআনের শব্দাবলি ও আদায় পদ্ধতি সহজ করেছি তা হিফজ করা ও জ্ঞানার্জনের জন্য।
আছো কি কেউ তা মুখস্থ করবে? জ্ঞান নেবে? আমি তা সহজেই তাকে দান করব। সুতরাং আমরা বলতে পারি আল্লাহ তায়ালা তাঁর কোরআন সংরক্ষণের ওয়াদা তাঁর বান্দাদের দ্বারাই রক্ষা করার কথা বলেছেন এবং তা খুব সহজেই বান্দাকে প্রদানের ওয়াদা করেছেন।
তাইতো দেখা যায় অনেক হাফেজ খুব কম সময়েই কোরআন মুখস্থ করে নেন। অতএব কোনো বান্দা যদি কোরআন মুখস্থ করে তাহলে সে আল্লাহ তায়ালার ওয়াদা বাস্তবায়নে কাজ করছে বলে বিবেচিত হবে। তাই তার মর্যাদা আল্লাহর কাছে সাধারণ মানুষ অপেক্ষা অনেক অনেক বেশি হবে। এক হাদিসে কোরআনের হাফেজকে নবীজি সা: আল্লাহর বন্ধু বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং বলেছেন, ‘যে তার সাথে বন্ধুত্ব রাখে আল্লাহ তার সাথে বন্ধুত্ব রাখেন আর যে তার সাথে শত্রুতা পোষণ করে আল্লাহও তার সাথে শত্রুতা পোষণ করেন।’ (জামে সগীর)
তৃতীয় কথা, মুসলমানদের কাছে ইমানের পর সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত হলো নামাজ। নামাজে কোরআন পাঠ বাধ্যতামূলক এবং তা মুখস্থ পাঠ করাও আবশ্যক। সুন্নাত কেরাত দিয়ে নামাজ পড়ার জন্য অন্তত আমপারা অংশটুকু হলেও মুখস্থ থাকা চাই।
তাছাড়া রমজানের খতম তারাবিহ যা সারা বিশ্বে লক্ষ লক্ষ মুসলমান আদায় করেন- কোরআন মাজিদ মুখস্থ না থাকলে অবস্থা কেমন দাঁড়াবে, চিন্তা করেছেন? তাই বিবেকের দাবি হলো, ইসলামি সমাজে কিছু মানুষ এমন থাকা চাই যারা কোরআন মুখস্থ করে জাতির দ্বীনি কাজ-কর্মে সহায়ক ভূমিকা পালন করবেন এবং আল্লাহর কোরআনকে যাবতীয় বিকৃতি থেকে হেফাজত করবেন।
এছাড়াও একজন কোরআনের হাফেজের মর্যাদা পরকালে অনেক বেশি হবে। হাদিস শরিফে এসেছ-‘কিয়ামতের দিন কোরআনের হাফেজকে বলা হবে, ‘কোরআন পড়তে থাকো এবং জান্নাতের মর্যাদার স্তর সমূহে উঠতে থাকো। তারতিলের সাথে পড়, যেভাবে দুনিয়ায় পড়তে। তোমার স্থান সেখানে হবে, যেখানে তোমার পঠিত শেষ আয়াত হবে।’ (তিরমিজি:১৩১৭)
অন্য একটি হাদিসে এসেছে-‘যে ব্যক্তি কোরআন হিফজ করে, তাতে বর্ণিত হালাল কে হালাল এবং হারামকে হারাম জানে, আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন এবং তার পরিবারের এমন দশজনের ব্যাপারে তার সুপারিশ কবুল করবেন, যাদের জন্য জাহান্নাম ওয়াজিব হয়ে গেছে।’ (তিরমিজি:২৯০৫) আবু দাউদ শরিফের এক হাদিসে এসেছে-‘কোরআনের হাফেজদের মা-বাবাকে হাশরের মাঠে সূর্য অপেক্ষা উজ্জরতর নুরের টুপি পড়ানো হবে।’
সুতরাং এ কথা হলফ করে বলা যায়, কোরআন মুখস্থ করা অনর্থক কাজ নয়। দুনিয়াতে রয়েছ তার ব্যাপক ফায়দা এবং পরকালে আছে মহাপুরস্কার। আল্লাহ আমাদের শুভবুদ্ধি দান করুন! আমীন!
শিক্ষক: জামিয়া সিদ্দিকিয়া কুলিয়ারচর, কিশোরগঞ্জ
-এটি