মুফতি মোজ্জাম্মেল হক রাহমানী: আল্লাহ তায়ালা সমগ্র মহাবিশ্বকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের মধ্যে কিছু বস্তুকে অন্য বস্তুর উপর শ্রেষ্ঠত্ব-কৃতিত্ব দিয়েছেন। সাত দিন তৈরি করেছেন, তন্মধ্যে অন্যান্য দিনের তুলনায় জুমার দিনকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। জুমার দিনের ফজিলতের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, সপ্তাহের সাত দিনের মধ্যে আল-কোরআনে শুধু মাত্র জুমার নামে একটি সূরা অবতীর্ণ হয়েছে।
জুমার দিনের গুরুত্ব:
এ সম্পর্কে মুসলিম শরীফের বর্ণনায় এসেছে:
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رضی الله عنه یَقُوْلُ : قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ : خَيْرُ یَوْمٍ طَلَعَتْ عَلَيْهِ الشَّمْسُ یَوْمُ الْجُمُعَةِ فِيْهِ خُلِقَ آدَمُ وَفِيْهِ أُدْخِلَ الْجَنَّةَ وَفِيْهِ أُخْرِجَ مِنْهَا۔
অর্থাৎ হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: যে দিনগুলোয় সূর্য উদিত হয় তন্মধ্যে সর্বোত্তম হলো জুমার দিন। যেদিন হযরত আদম (আ.)-এর জন্ম হয়েছিল, যেদিন তাঁকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়েছিল এবং যেদিন তাঁকে জান্নাত থেকে পৃথিবীতে অবতরণ করা হয়েছিল। (মুসলিম ৮৫৪,নাসায়ি ১৩৭৩, তিরমিজি ৩৮৮)
রাসুলুল্লাহ (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের সময়, মদিনার নিকটবর্তী আমর ইবনে আউফ গোত্রের বসতি কুবায় কয়েকদিন অবস্থান করেন। কুবা থেকে রওনা হওয়ার একদিন আগে, বৃহস্পতিবার রাসুলুল্লাহ (সা.) মসজিদে কুবার ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন, এটিই ইসলামের প্রথম মসজিদ, যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল খোদাভীতি-তাকওয়ার উপর। শুক্রবার সকালে রাসুলুল্লাহ (সা.) কুবা থেকে মদিনার উদ্দেশ্যে রওনা হন। যখন সালিম ইবনে আউফ গোত্রের উপত্যকায় পৌঁছেন, তখন জুমার সময় হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) যেখানে বর্তমানে 'মসজিদে জুমা' রয়েছে, সেখানে জুমার নামাজ আদায় করেন। এটি ছিল রাসুলুল্লাহ (সা.) এর প্রথম জুমা। (আল্ বিনায়াহ্ ৩/৫৩)
ফজরের নামাজে সূরা আলিফ-লাম-মিম-সাজদা ও সূরা দাহার তেলাওয়াত করা সুন্নাত:
জুমার দিন ফজরের নামাযে প্রথম রাকাতে সূরা আলিফ-লাম-মিম-সাজদা ও সূরা দাহার তেলাওয়াত করা সুন্নাত। হাদীস শরীফে এসেছে:
كان رسولُ اللهِ صلَّى اللهُ عليهِ وسلَّمَ يقرأُ يومَ الجمعةِ في الفجرِ {الم تنزيلُ السجدةِ و هَلْ أَتَى عَلَى الْإِنْسَانِ حِينٌ مِنَ الدَّهْر.
অর্থাৎ হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) জুমার দিন ফজরের নামাজে সূরা আলিফ-লাম-মিম সাজদা এবং সূরা দাহর পড়তেন। (বুখারী শরীফ ৮৯১)
জুমার দিন ফজরের নামাযে সর্বদা এই সূরাগুলো পাঠ করলে দোষের কিছু নেই, তবে যদি জুমার দিন ফজরের নামাযে এ দুটি সূরা পাঠ করাকে মানুষ জরুরি মনে করতে শুরু করে, তাহলে মাঝে মধ্যে এইগুলো পাঠ করবে না, অন্য সূরা পড়বে।
সকাল সকাল মসজিদে গমন করা:
এ ব্যাপারে হাদিস শরীফে এসেছে,
عن أوس بن أوس الثقفي رضي الله عنه قال: سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول من غسَّل يوم الجمعة واغتسل وبكر وابتكر، ومشى ولم يركب، ودنا من الإمام فاستمع ولم يلغ؛ كان له بكل خطوة عمل سنة أجر صيامها وقيامها،
অর্থাৎ হযরত আউস ইবনে আউস সাক্বাফি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন আমি রাসুলুল্লাহ (সা.) কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি জুমার দিন সুন্নত তরিকায় ভালোভাবে গোসল করবে, সকাল সকাল মসজিদে আসার জন্য রওনা দিবে, হেঁটে আসবে, ইমামের নিকটে বসবে, গুরুত্বসহকারে খুৎবা শ্রবণ করবে এবং অহেতুক কাজ ও কথা থেকে বিরত থাকবে। আল্লাহ তায়ালা তাকে পূর্ণ এক বৎসর নফল রোজা ও এক বৎসর নফল নামাজ পড়ার সওয়াব দান করবেন।
সূরা কাহাফ তেলাওয়াত করা:
জুমার দিন সূরা কাহাফ তেলাওয়াত করা মুস্তাহাব হাদীস শরীফে এসেছে,
عن ابى سعيد الخدرى أن النبى صلى الله عليه وسلم قال من قرأ سورة الكهف في يوم الجمعة اضاء له من النور ما بين الجمعتين
অর্থাৎ হযরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি জুমার দিন 'সূরা কাহাফ' তেলাওয়াত করবে, তাঁর জন্য এমন নূর আলোকিত করা হবে, যা সে জুমা থেকে পরের জুমা পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হবে। (সুনানে কুবরা ৩/৩৫৩)
অন্য বর্ণনায় এসেছে
اضاءله من النور ما بينه وبين البيت العتيق
অর্থাৎ তাঁর জন্য এমন নূর আলোকিত করা হবে, যা তেলাওয়াতকারী থেকে বাইতুল্লাহ শরীফ পর্যন্ত বিস্তৃত থাকবে। (বাইহাক্বি শরীফ ৩/১১৩)
বিশেষ দুরুদ শরীফের আমল:
হাদীস শরীফে এসেছে,
عن ابى هريرة رضي الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم من صلى صلاة العصر من يوم الجمعة فقال قبل أن يقوم من مكانه"اللهم صل على محمد النبى الامى وعلى اله وسلم تسليما"ثمانين مرة غفرت له ذنوب ثمانين عاما وكتبت له عبادة ثمانين سنة.
অর্থাৎ হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি জুমার দিন আসরের নামাজের পর আপন স্থান থেকে ওঠার পূর্বে এই বিশেষ দুরুদ শরীফটি আশি বার পাঠ করবে, আল্লাহ তায়ালা তার আশি বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন এবং তাকে আশি বছর নফল ইবাদত করার সওয়াব দান করবেন। (আল্ ক্বাউলুল বাদী' ২৮৪)
জুমার দিন দোয়া কবুলের বিশেষ মূহুর্ত:
হাদিস শরীফে এসেছে,
عن جابر بن عبد الله عن رسول الله صلى الله عليه وسلم أنه قال: يوم الجمعة ثنتا عشرة يريد ساعة لا يوجد مسلم يسأل الله شيئا إلا اعطاه الله عز وجل فالتمسوها آخر ساعة بعد العصر
অর্থাৎ হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন জুমার দিন এমন একটি মুহূর্ত রয়েছে, যখন কোনো মুসলমান আল্লাহ তায়ালার কাছে যা কিছু প্রার্থনা করবে, আল্লাহ তায়ালা তাকে তা দান করবেন। কাজেই তোমরা আসরের পর দিনের শেষ মুহূর্তে সে সময়টা তালাশ করো।
মুসলিম শরীফের বর্ণনায় এভাবে এসেছে,
عَنْ أَبِي بُرْدَةَ بْنِ أَبِي مُوسَی الْأَشْعَرِيِّ قَالَ قَالَ لِي عَبْدُ اللَّهِ بْنُ عُمَرَ أَسَمِعْتَ أَبَاکَ يُحَدِّثُ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّی اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي شَأْنِ سَاعَةِ الْجُمُعَةِ قَالَ قُلْتُ نَعَمْ سَمِعْتُهُ يَقُولُ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّی اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ هِيَ مَا بَيْنَ أَنْ يَجْلِسَ الْإِمَامُ إِلَی أَنْ تُقْضَی الصَّلَاةُ
অর্থাৎ আবু বুরদা ইবনে আবু মুসা আশআরী (রা.) বলেন, হযরত ইবনে উমর (রা.) আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি তোমার পিতার কাছ থেকে জুমার প্রহরের মহিমা সম্পর্কে কোন হাদীস শুনেছ? আমি বললাম হ্যাঁ শুনেছি। তিনি বলেছেন আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, জুমার দিনে মহিমান্বিত মুহূর্তটি হচ্ছে ইমাম মিম্বারে বসা থেকে নামাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত। (মুসলিম শরীফ ১৯৭৫)
এ সকল হাদিসের আলোকে আলেমগণ জুমার দিন মহিমান্বিত প্রহর ও গ্রহণযোগ্য মূহুর্ত দু'টি নির্ধারণ করেছেন, ১. খুতবা শুরু ও নামাজ শেষ হওয়ার মধ্যবর্তী সময়। ২.আছরের পর সূর্যাস্তের কিছুক্ষণ পূর্বে।
আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে উক্ত হাদীসগুলোর উপর আমল করে বর্ণিত ফজিলত অর্জন করার তৌফিক দান করুন। আমীন।
লেখক: মুফতি মোজ্জাম্মেল হক রাহমানী
সিনিয়র শিক্ষক: মদিনাতুল উলুম মাদ্রাসা বসুন্ধরা, ঢাকা।
ই মেইল: [email protected]
-এসআর