আওয়ার ইসলাম ডেস্ক: আস্থা, সংকট ও রাজনৈতিক দলের বিরোধিতার মধ্যেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আগামী ১৫ মাসের মধ্যে তাদের এই নির্বাচন করতে হবে। এ লক্ষ্যে পূর্বসূরিদের অনুসরণ করে কর্মপরিকল্পনা প্রকাশ করেছে কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন।
এতে নির্বাচনকে সামনে রেখে বর্তমান কমিশন তার চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করেছে। পাশাপাশি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় করণীয়ও নির্ধারণ করেছে। রোডম্যাপে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে তাদের সামনে ১৪টি চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তাদের ১৯টি করণীয় রয়েছে।
গতকাল বুধবার সকালে আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কর্মপরিকল্পনা’ প্রকাশ করে ইসি। এ সময় উপস্থিত ছিলেন না প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। সিইসির অনুপস্থিতিতে কমিশনার আহসান হাবিব খান প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
সাংবাদিকদের সামনে ইসির ‘রোডম্যাপ’ উপস্থাপন করে আহসান হাবিব খান বলেছেন, কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্দেশ্য একটাই- ‘অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক’ নির্বাচন করা। আমরা কিছুটা হলেও আগের থেকে আস্থা অর্জনে এগিয়ে গেছি। এ কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে নিজেদের ‘জবাবদিহিতা ও বিবেকের কাছে দায়বদ্ধতাও’ বাড়বে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
আহসান হাবিব খান বলেন, দায়িত্ব নেওয়ার পর বিভিন্ন বিষয়ে রাজনৈতিক বিভেদ আর প্রশ্নের মোকাবিলা করতে হয়েছে। তার পরও গত ছয় মাসে ‘কিছুটা হলেও’ আস্থা অর্জনের দিকে ইসি এগিয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের বাকি আর সাড়ে ১৫ মাস; এই সময়ের মধ্যে সব দলের আস্থা অর্জন করে ‘অংশগ্রহণমূলক’ নির্বাচন আয়োজনের প্রত্যাশার কথা বললেন এই নির্বাচন কমিশনার।
নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা এমিলি বলেন, পরিকল্পনা ধরেই এগিয়ে যাব আমরা। সবার সহযোগিতা পেলে অংশগ্রহণমূলক ও সুন্দর নির্বাচন উপহার দিতে সক্ষম হব।
নির্বাচন কশিমনার মো. আলমগীর বলেন, এ কর্মপরিকল্পনায় সবার মতামত রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। যেসব বিষয় কমিশনের আওতায় রয়েছে তা রাখা হয়েছে। তবে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক সুপারিশগুলো রাখা হয়নি। রোডম্যাপের চ্যালেঞ্জগুলো ধরে, সেগুলো মোকাবিলা করে সব কাজ বাস্তবায়ন করা হবে। তিনি বলেন, ভোটের এখনো এক বছর চার মাস বাকি। অনেকে ইসি নিয়ে আস্থাহীনতায় থাকলেও আগামীতে কর্মকা- দেখে আস্থাশীল হবেন।
ইসি আলমগীর বলেন, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের শেষে অথবা ২০২৪ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে। আর সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে ২০২৩ সালের নভেম্বরে।
‘বাস্তবভিত্তিক ও সময়ভিত্তিক’ এ রোডম্যাপ বাস্তবায়ন হলে ইসির কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে মন্তব্য করে নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান বলেন, সেজন্য অংশীজনদের সবার সহযোগিতাও দরকার হবে।
রোডম্যাপে ইসির চ্যালেঞ্জগুলো হলো- ১. নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি আস্থা সৃষ্টি; ২. নির্বাচনের দায়িত্বে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের, বিশেষ করে পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন; ৩. ব্যবহৃত ইভিএমের প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা সৃষ্টি; ৪. অর্থ ও পেশীশক্তির নিয়ন্ত্রণ; ৫. নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা; ৬. সব রাজনৈতিক দল কর্তৃক নির্বাচনী আচরণবিধি অনুসরণ; ৭. নিয়মতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রচারের ক্ষেত্রে বিপক্ষ/প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী/সমর্থক/পুলিশ/প্রশাসন কর্তৃক কোনোরকম বাধার সম্মুখীন না হওয়া; ৮. জালভোট/ভোটকেন্দ্র দখল/ব্যালট ছিনতাই রোধ; ৯. প্রার্থী/এজেন্ট/ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে অবাধ আগমন; ১০. ভোটারদের পছন্দ অনুযায়ী প্রার্থীকে ভোট প্রদানের সুযোগ সৃষ্টি; ১১. নির্বাচনী দায়িত্ব পালনকারী বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তা/কর্মচারীকে প্রশিক্ষণ প্রদান; ১২. পর্যাপ্তসংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য নিয়োজিতকরণ; ১৩. পর্যাপ্তসংখ্যক নির্বাহী/জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োজিতকরণ; ১৪. নিরপেক্ষ দেশি/বিদেশি পর্যবেক্ষক নিয়োজিতকরণ।
রোডম্যাপে চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি উত্তরণের উপায়গুলোও উল্লেখ করা হয়েছে। তা হলো- ১. বিশিষ্ট নাগরিক ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় সভায় সংবিধান ও নির্বাচনী আইন অনুযায়ী যে সুপারিশগুলো অধিকাংশজন করেছেন তা বাস্তবায়ন; ২. সব রাজনৈতিক দল যাতে নির্বাচনী প্রচারকাজ নির্বিঘেœ করতে পারে সে বিষয়ে সরকারের কাছে প্রস্তাব রাখা; ৩. সরকারের কোনো সংস্থা কর্তৃক হয়রানিমূলক মামলা না করা; ৪. প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী-সমর্থক দ্বারা প্রার্থী, সমর্থক ও তাদের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আক্রমণ না করা। এমন হলে আইন অনুযায়ী দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ; ৫. নির্বাচনের পূর্বে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা, বৈধ অস্ত্র জমা নেওয়া; ৬. মন্ত্রিপরিষদ সচিব, জনপ্রশাসন, জননিরাপত্তা, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব, পুলিশ, র?্যাব, বিজিবি, কোস্টগার্ড, আনসার ও ভিডিপির প্রধানদের সঙ্গে সভা করে তাদের অধীনস্থ কর্মকর্তা যারা নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করবেন, তারা যেন আন্তরিকতা ও নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করেন সে বিষয়ে অধীনস্তদের নির্দেশ দেওয়া; ৭. প্রত্যেক ভোটকক্ষে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন; ৮. ভোটকেন্দ্রগুলোয় পর্যাপ্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য মোতায়েন; ৯. ইভিএমের ব্যবহার সবোর্চ্চ ১৫০ আসনে সীমাবদ্ধ রাখা। শুধু মেট্রোপলিটন ও জেলা সদরের আসনগুলোয় ব্যবহার করা; ১০. নির্বাচনের শিডিউল ঘোষণার পরদিন থেকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর স্ট্রাইকিং ফোর্স নিয়োগ; ১১. নির্বাচনী আচরণবিধি কঠোরভাবে প্রয়োগ, ভঙ্গকারীর বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক সঙ্গে সঙ্গে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ; ১২. আরপিও ও নির্বাচনী আচরণবিধিতে কতিপয় প্রয়োজনীয় সংশোধনের প্রস্তাব করা; ১৩. রিটার্নিং অফিসার, সহকারী রিটার্নিং অফিসার যতদূর সম্ভব নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে নিয়োগ দেওয়া; ১৪. রিটার্নিং অফিসার, সহকারী রিটার্নিং অফিসার, প্রিসাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারদের একটি তালিকা তৈরি করে তাদের প্রশিক্ষণ নির্বাচনের সিডিউল ঘোষণার পূর্বেই শুরু করা- যাতে যথাযথভাবে তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা সম্ভব হয়; ১৫. যেসব প্রিসাইডিং/সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারের বিষয়ে প্রার্থীর যুক্তিসঙ্গত আপত্তি থাকবে তাদের নিয়োগ না দেওয়া; ১৬. দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক নিয়োগ ও তাদের জন্য কমিশনের পক্ষ থেকে ব্রিফিং করা; ১৭. গণমাধ্যম কর্মী নিয়োগ ও তাদের জন্যও ব্রিফিংয়ের ব্যবস্থা করা; ১৮. নিরপেক্ষ দায়িত্ব পালনে অনীহা, পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন-১৯৯১ অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা; ১৯. প্রার্থীদের জনসভা করার জন্য স্থান, তারিখ, সময় সিডিউল করে দেওয়া।
ইসির ২০ পৃষ্ঠার রোডম্যাপে প্রতিটি ভোটকক্ষে সিসি ক্যামেরা রাখা এবং সর্বোচ্চ দেড় শ আসনে ইভিএম ব্যবহার করার কথা বলা হয়েছে। বলা হয়, সেক্ষেত্রে কেবল মহানগর এবং জেলা সদরের আসনগুলোয় ভোট হবে ইভিএমে।
ইভিএম ব্যবহারের বিষয়টি জানানোর পাশাপাশি কেন তারা এটি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেই যুক্তিগুলোও বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে রোডম্যাপে। ইভিএমে কোনো প্রকার জালজালিয়াতির সুযোগ নেই দাবি করে ইসি বলেছে, শুধু মনস্তাত্ত্বিক ধারণা থেকে কারচুপির অভিযোগ করা হচ্ছে।
ইসি রোডম্যাপে উল্লেখ করেছে, নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিষয়ে সংলাপে অংশগ্রহণকারী ২৯টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ইভিএমের পক্ষে মত দিয়েছেন ১৭টি রাজনৈতিক দল। বিপক্ষে মত দিয়েছেন ১২টি দল। বেশিসংখ্যক রাজনৈতিক দলের মত ইভিএমের পক্ষে থাকায় ইভিএম ব্যবহার না করা যুক্তিসঙ্গত হবে না বলে কমিশন মনে করে। উভয়পক্ষের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে তাই কমিশন অনূর্ধ্ব ১৫০টি আসনে ইভিএম ব্যবহার করা যুক্তিসঙ্গত মনে করছে।
ইসির রোডম্যাপে আরও যা বলা হয়েছে- ১. আইন সংস্কার: ২০২২ আগস্ট থেকে ২০২৩ ফেব্রুয়ারি; ২. সংলাপ : ২০২২ মার্চ- ২০২২ ডিসেম্বর; ৩. সংসদীয় আসন পুনর্বিন্যাস : ২০২৩ জানুয়ারি-২০২৩ জুন; ৪. আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার : আগস্ট ২০২২ থেকে ২০২৩ আগস্ট; ৫. নতুন দল নিবন্ধন : ২০২২ সেপ্টেম্বর-২০২৩ জুন; ৬. ভোটার তালিকা : ২০২২ হালনাগাদ শুরু মে, ২০২৩ মার্চে চূড়ান্ত প্রকাশ; তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সংসদীয় আসন অনুযায়ী ৩০০ এলাকার তালিকা প্রস্তুত; ৭. ভোটকেন্দ্র নির্ধারণ : ২০২৩ জুন-অগাস্ট ২০২৩; তফসিল ঘোষণার পর থেকে ভোটের অন্তত ২৫ দিন আগে গেজেট প্রকাশ; ৮. প্রশিক্ষণ : ২০২৩ জানুয়ারি থেকে তফসিল ঘোষণার পরেও চলবে; ৯. পযবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন : জানুয়ারি ২০২৩ থেকে আগস্ট ২০২৩।
পূর্বনির্ধারিত দিনক্ষণ অনুযায়ী রোডম্যাপ প্রকাশ অনুষ্ঠানে সিইসির উপস্থিত থাকার কথা ছিল। কিন্তু গতকাল অনুষ্ঠানে জানানে হয়, অসুস্থাতার কারণে সিইসি উপস্থিত হতে পারেননি। এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা চলছে।
গত ফেব্রুয়ারিতে দায়িত্ব নেয় কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের বর্তমান ইসি। এর পরপরই তারা রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম, পর্যবেক্ষক সংস্থা, নির্বাচন পরিচালনা বিশেষজ্ঞ, ইভিএম কারিগরি বিশেষজ্ঞ, শিক্ষাবিদদের নিয়ে সংলাপ শুরু করে। বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি দলের বর্জনের মধ্যে অনুষ্ঠিত সংলাপে পাওয়া মতামত পর্যালোচনা করে আইন সংস্কার, ইভিএমে ভোটগ্রহণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি। নতুন দলের নিবন্ধনের আবেদনও নেওয়া হচ্ছে। হালনাগাদ ভোটার তালিকার তথ্য সংগ্রহের কাজ চলমান।
এটিএম শামসুল হুদা নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের সময় সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা ধরে এগোনোর চল শুরু হয়। পরের কমিশনগুলো সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখলেও কিছুটা ভিন্নতা এনে ‘রোডম্যাপ’ উপস্থাপন করে আসছে।
২০১৯ সালের ৩০ জানুয়রি একাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়। সে অনুযায়ী ২০২৪ সালের ২৯ জানুয়ারির মধ্যে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন শেষ করার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
-এটি