|| ফাহিম সিদ্দিকী ||
জামিয়া মাদানিয়া বারিধারার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও শায়খুল হাদীস, রাহবারে মিল্লাত আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী রহ. দ্বীনি মাদারেসের শিক্ষকবৃন্দের উদ্দেশ্যে দরদমাখা কিছু অমূল্য উপদেশ দিয়েছিলেন।
বিষয়বস্তুর গুরুত্ব বিবেচনা করে এবং শিক্ষকসমাজের জন্য পাথেয় হতে পারে- এই আশায় পাঠক সমীপে মূল্যবান উপদেশসমূহ নিম্নে পত্রস্থ করা হল।
মূলত আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী রহ. প্রধানত: তিনটি নছীহত করেছেন- ১. উস্তাদের নিজস্ব গুণাবলি, ২. ছাত্র সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি এবং ৩. তরীকায়ে তা’লীম।
হুযুর বলেন, বর্তমান যুগে সবচেয়ে বড় অভাব, মে’য়ারী তথা যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকের। তাই নতুন কোনো যোগ্য শিক্ষক তৈরি হচ্ছে না। নেছাব পড়ানো নয়, বরং নেছাব হলো গড়া। চাকরী উদ্দেশ্য নয়, খেদমতই কাম্য। অথচ বর্তমানে এরই সবচেয়ে বড় অভাব। দরদ ব্যাথা, ব্যকুলতা-অস্থিরতা, যা একজন আদর্শ শিক্ষকের মূল পূঁজি, তা থেকে শিক্ষকরা গাফেল। ফলে তা’লীম ও তারবিয়তের ময়দানে ব্যাপক শূন্যতা ও হাহাকার বিরাজ করছে।
পাঠদান নির্দেশিকা-
উস্তাদের নিজস্ব গুণাবলি
১. তাছহীহে নিয়্যত: সকল কাজ একমাত্র আল্লাহ তাআলার রেজামন্দী ও সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে করা। গরজে নফসানী বা অন্য কিছু উদ্দেশ্যে না করা।
২. তাকওয়া: গুনাহমুক্ত যিন্দেগী। তাকওয়ার দুই শাখা: (ক) মামুরাতে শরয়ী – শরিয়তের সকল বিধি-বিধান পাবন্দীর সাথে আদায় করা। (খ) মানহিয়্যাতের বিরোধী যে কোনো কাজ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা।
আল্লামা আলূসী রাহ. রুহুল মাআনীতে বলেন-
التقوى: أن لا يراك الله حيث نهاك ولا يفقدك حيث أمرك আল্লাহ যে বিষয় নিষেধ করেছেন সেখানে যে তোমাকে না দেখেন, আর যা করার আদেশ করেছেন সেখানে যেন তোমাকে অনুপস্থিত না পান।
৩. খেদমতের মানসিকতা: العلماء ورثة الأنبياء এই দায়িত্ববোধ সর্বদা জাগ্রত থাকা। চাকরির মানষিকতা পরিহার করা।
৪. নেসাব হলো ছাত্র গড়ার নাম, পড়ানো নয়।
৫. ছাত্র গড়ার জন্য উস্তাদের অন্তরে ব্যথা বেদনা, অস্থিরতা ও ব্যকুলতা থাকতে হবে।
৬. আদর-সোহাগ, স্নেহ, মায়া-মমতা দ্বারা ছাত্র গড়তে হবে। সকল ধরণের কঠোরতা পরিহার করতে হবে। ছাত্রের মন জয় করে তাকে শিখাতে হবে। বেত ব্যবহার করা যাবে না, অভদ্র ভাষা ব্যবহার করা যাবে না, গালিগালাজ করা যাবে না।
৭. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার এহতেমাম করা। নিজের শরীর থেকে নিয়ে দরসগাহ, হাম্মাম, ছেহেন ও ঘরের আঙ্গিনাসহ সকল ক্ষেত্রে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখবে। কেননা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- النظافة من الإيمان – পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ। আরো ইরশাদ করেছেন- نظّفوا أفنيةَ بيوتكم – তোমরা তোমাদের বাড়ির আঙ্গিনাকে পরিচ্ছন্ন রাখো।
ছাত্র সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি:
১. ছাত্র হল ই’তায়ে খোদাওয়ান্দী। আল্লাহ পাকের দান। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন-
منْ يُؤتى الحكمة فقد اوتي خيرا كثيرا – যাকে চান (আল্লাহ তায়ালা) হিকমত (প্রজ্ঞা) দান করেন।
নবী কারীম স. ইরশাদ করেন- من يرد الله به خيرا يفقّهه في الدين – আল্লাহ পাক যাকে ইচ্ছা তাকে দীনের সমঝ (বুঝ) দান করেন
২. ছাত্র মেহমানে রাসূল হিসেবে তার সম্মান করতে হবে। তার সাথে দুর্ব্যবহার করা যাবে না।
৩. ছাত্রের খামী বা দুর্বল দিকগুলো শফকত ও রাফাতের সাথে দূর করতে হবে। সখতীর সাথে নয়।
৪. ছাত্রের ব্যপারে গোস্যা আসলে নিজের গুনাহ খাতা ইসতেহযার করতে হবে। আল্লাহ পাক আমার গুনাহগুলো ঢেকে রেখেছেন। আমি তো অপরাধী, সে হিসেবে ছাত্রদের ত্রুটি বিচ্যুতিগুলোকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে হবে।
৫. ছাত্র উস্তাদের জন্য মুহসিন। কেননা, ছাত্র তার সীনার জমীন পেশ না করলে উস্তাদ তার ইলমের বীজ বোপন করতে পারতেন না। তার ইলম মুতাআদ্দি হতো না। সুতরাং هل جزاء الاحسان إلا الاحسان এ দৃষ্টিভঙ্গি সামনে থাকতে হবে।
তরীকে তালীম:
১. দোয়ার ইহতেমাম: সবকের যাওয়ার পূর্বে দু’রাকাত নফল নামাজ পড়ে উস্তাদ, ছাত্র, আত্মীয়-স্বজন সকলের জন্য দোয়া করে সবক পড়াতে যাবে।
২. সবকের পরিমাণ প্রথম প্রথম কম হবে।
৩. সবক পাকা ইয়াদ করাতে হবে। কাঁচা ইয়াদ চলবে না। মুখস্থ সবক শোনার বেলা এক টানে এক নিঃশ্বাসে সবক শুনতে হবে। মাঝে নিঃশ্বাস নেওয়া ও থামা যাবে না। আঁ উঁ … ইত্যাদি করা যাবে না।
৪. সবক শোনা: প্রথম সবক জামাতের সকল ছাত্র থেকে শুনতে হবে। একজনও বাদ যাবে না। যতক্ষণ জামাতের সকল ছাত্র প্রথম সবক শুনাতে সক্ষম না হবে, ততক্ষণ দ্বিতীয় সবক দেওয়া যাবে না। অনুরূপ দ্বিতীয় সবকও সকলের কাছ থেকে শুনতে হবে। সকলের ইয়াদ হলে তৃতীয় সবক দেওয়া হবে। এমনিভাবে সবক চলতে থাকবে। বিশটি সবক যদি এই পদ্ধতিতে পড়ানো যায়, তাহলে ছাত্রদের ইস্তে’দাদের ভিত্তি পয়দা হবে, ইনশাআল্লাহ।
৫. মশক ও তামরীন: প্রতিটি সবকের মশক ও তামরীন ব্যপকভাবে করাতে হবে, যাতে করে পড়া তাদের হৃদয়ে গেঁথে যায়। মশক ও তামরীন ছাড়া পড়ানোর উদাহরণ হলো মহিলাদের তরকারী কেটে প্রস্তুত করে রান্না না করার মতো। -লেখকের ফেসবুক থেকে নেয়া।
কেএল/