ওমর ফারুক ফেরদৌস: কাউকে গালি দেয়া বা অপবাদ দেয়া, প্রমাণ ছাড়া কোনো অভিযোগে অভিযুক্ত করা ইসলামে অনেক বড় পাপ বা অপরাধ।
অফলাইনে বা সাধারণ দুনিয়ায় যেমন অপরাধ, অনলাইনে বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও একইরকম অপরাধ। বর্তমানে অনেকেই অনলাইনে নির্বিকারভাবে মানুষকে অপবাদ দেন বা গালাগালি করে বেড়ান, এটাকে কিছুই মনে করেন না।
এমনকি দীনি চেতনা বা ধর্মপ্রীতির নামেও এগুলো করছেন অনেকে। বিধর্মী বা ভিন্ন মতাবলম্বী কাউকে গালি গালাজ করা বা অপবাদ দেয়াকে পুণ্যের কাজ মনে করছেন। অথচ ইসলামে এগুলো জুলুম ও গুরুতর পাপ হিসেবে গণ্য হয়। কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে, তা সংরক্ষণ করার জন্যে রয়েছে সদা-প্রস্তুত প্রহরী।’ (সুরা কাফ : ১৮)
অর্থাৎ মানুষের প্রত্যেকটি কথা লিপিবদ্ধ হচ্ছে। প্রত্যেকটি কথার জন্যই মানুষকে হিসাব দিতে হবে। অনলাইনে কারো লেখা, কাজ বা মতামত পছন্দ না হলেই আমাদের আঙুল যখন কী বোর্ডে দৌড়াতে থাকে, আমরা কি এই ব্যাপারটা মনে রাখি?
আমরা কি ভাবি, আমার লেখা একটা শব্দ বা বাক্য আমাকে জাহান্নামে টেনে নিতে পারে? আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘মানুষ খুব বেশি চিন্তা ভাবনা না করেই এমন কথা বলে ফেলে, যে কথার কারণে সে জাহান্নামের এমন গভীরে নিক্ষিপ্ত হবে যার দূরত্ব পূর্ব এবং পশ্চিমের মধ্যস্থিত ব্যবধানের চেয়েও বেশি।’ (সহিহ বুখারি, মুসলিম)
কত ভয়াবহ সাবধানবাণী! এই সাবধানবাণী মানে থাকলে একজন মুমিন ব্যক্তি কোনোভাবেই অযাচিত, অনর্থক কথা বলতে পারে না। অন্যকে কষ্ট দিয়ে কথা বলতে পারে না। অপবাদ দেয়া বা গালাগালি করার তো প্রশ্নই আসে না। আরেকটি হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘মুমিন ব্যক্তি মানুষের ভুলত্রুটি নিয়ে কটাক্ষকারী, অভিসম্পাতকারী, অশ্লীলভাষী ও অভদ্র হতে পারে না।’ (সহিহ বুখারি)
কারো অন্যায় বা অপরাধের যৌক্তিক সমালোচনা নিশ্চই হতে পারে। কারো মতামত বা মতাদর্শ আপনার কাছে ভুল বা ভ্রান্ত মনে হলে তারও যৌক্তিক সমালোচনা হতে পারে।
সুন্দরভাবে তাকে বুঝিয়ে বলা যেতে পারে কেন তার অবস্থান আপনার কাছে সঠিক মনে হচ্ছে না। কেন তার মতামত আপনার কাছে ভুল বা ভ্রান্ত মনে হচ্ছে। কিন্তু আপনি তো অশ্লীল, অশালীন কথা বলতে পারেন না। প্রমাণ ছাড়া কাউকে কোনো অভিযোগে অভিযুক্ত করতে পারেন না। অপবাদ দিতে পারেন না। গালি দিতে পারেন না।
কোরআনে আল্লাহতায়ালা অমুসলিমদের উপাস্য বা সম্মানিত ব্যক্তিদেরও গালি দিতে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘এরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে যাদের পূজা করে তোমরা তাদেরকে গালাগালি করো না, তাহলে তারা অজ্ঞতা বশতঃ বৈরীভাবে আল্লাহকেই গালাগালি দিতে শুরু করবে। আমি প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর চোখে তাদের কাজ চাকচিক্যময় বানিয়ে দিয়েছি।
শেষ পর্যন্ত তাদেরকে তাদের রবের কাছে ফিরে যেতে হবে এবং তিনি তাদের জানাবেন তারা কী কী কাজ করেছিল।’ (সুরা আনআম : ১০৮) এই আয়াত থেকে বোঝা যায় বিধর্মীদের উপাস্য বা দেবতাদেরও গালি দেয়া যাবে না। তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিতে হলে, তাদের ধর্মের অসারতা তাদেরকে বোঝাতে হলে তা করতে হবে যুক্তি দিয়ে, সুন্দর কথা দিয়ে। অশ্লীল কথা বলে, তাদের দেবতাদের গালি দিয়ে বা অসম্মান করে নয়।
দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে গ্রামাঞ্চলের মাহফিলগুলোতে যারা ওয়াজ করেন, তাদের অনেকে কোরআনের এই শিক্ষা ভুলে যান। বিধর্মীদের উপাস্য বা পূজ্যদের সম্পর্কে অশালীন কথা তাদের অনেকের মুখে শোনা যায়। অথচ আল্লাহ দীনের দাওয়াত দিতে বলেছেন, হিকমত, সুন্দর শোভন ওয়াজ ও সর্বোত্তম যুক্তিতর্কের মাধ্যমে।
আল্লাহ বলেন, ‘তুমি তোমরা রবের পথে হিকমত ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে আহ্বান কর এবং সুন্দরতম পন্থায় তাদের সঙ্গে বিতর্ক কর। নিশ্চয় একমাত্র তোমার রবই জানেন কে তার পথ ছেড়ে বিপথগামী হয়েছে আর কে সঠিক পথে রয়েছে।’ (সুরা নাহল : ১২৫)
অনলাইনে অপবাদও খুব স্বাভাবিক কাজ হয়ে গেছে অনেকের কাছে। দেখা যায়, যথাযথ প্রমাণ ছাড়াই বড় বড় দোষ কারো ওপর চাপিয়ে সমালোচনা করা হচ্ছে। অসমর্থিত সূত্রে কোনো উড়ো ভিডিও বা স্ক্রিনশট পেলেই মানুষের সম্মানহানি করা হচ্ছে, গালমন্দ করে শুইয়ে ফেলা হচ্ছে। সেগুলো যাচাই করে দেখারও প্রয়োজন বোধ করছে না কেউ।
অথচ অনেক সময়ই এগুলো ফেইক বা ভুয়া প্রমাণিত হয়। ইসলামে অপবাদ দণ্ডণীয় অপরাধ। কোরআনে আল্লাহতায়ালা অপবাদের জন্য আখেরাতের শাস্তির পাশাপাশি দুনিয়ার দণ্ডও ঘোষণা করেছেন। হাদিসে অপবাদকে গণ্য করা হয়েছে সাতটি বড় অপরাধের একটি হিসেবে। কারো কোনো অন্যায় কাজের ব্যাপারে তখনই বলা যায় বা কোনো অভিযোগে কাউকে তখনই অভিযুক্ত করা যায়, যখন তার অন্যায় যথাযোগ্য সাক্ষ্য-প্রমাণের মাধ্যমে নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়।
অন্যের দোষত্রুটি নিয়ে কথা বলার চেয়ে, অন্যকে শোধরানোর চেয়ে নিজের পরকালীন মুক্তির চিন্তাই গুরুত্বপূর্ণ হওয়া উচিত একজন মুসলমানের কাছে। অন্যের অপরাধের কথা বলতে গিয়ে, অন্যের সমালোচনা করতে গিয়ে আমরা যেন নিজেরাই সব হারিয়ে নিঃস্ব না হয়ে পড়ি। আমাদের নেক আমল যেন নষ্ট না হয়ে যায়।
হাদিসে এসেছে, ‘একদিন রাসুল সা. সাহাবিদের জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কি বলতে পার, নিঃস্ব বা দেউলিয়া কে? সাহাবিরা বললেন, যার টাকা কড়ি ও ধন-সম্পদ নেই, আমরা তো তাকেই নিঃস্ব মনে করি। রাসুল সা. বললেন, আমার উম্মাতের মধ্যে সেই প্রকৃত অভাবগ্রস্ত, যে ব্যক্তি কেয়ামতের দিন নামাজ, রোজা ও জাকাত নিয়ে আসবে; অথচ সে এই অবস্থায় আসবে যে, কাউকে গালি দিয়েছে, কাউকে অপবাদ দিয়েছে, কারো সম্পদ ভোগ করেছে, কাউকে পিটিয়েছে, কাউকে হত্যা করেছে।
তার কথা ও কাজের কারণে যারা নির্যাতিত হয়েছে, তাদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে তার থেকে নেক আমল দেয়া হবে, তার নেক আমল শেষ হয়ে গেলে তাদের পাপের একাংশ তার ওপর চাপানো হবে। এরপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।’ (সহিহ মুসলিম) আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন।
-এটি