সাঈয়েদা হাবিবা: মা-বাবা প্রতি যেমন সন্তানের দায়িত্ব আছে ঠিক তেমনই সন্তানের প্রতিও মা-বাবার কিছু দায়িত্ব রয়েছে। মায়ের প্রতি সন্তানের অন্যতম অধিকার বা জন্মগত অধিকার হচ্ছে মাতৃদুগ্ধ পান করানো। পবিত্র কোরআনের সূরা বাকারার ২৩৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহপাক ইরশাদ করেছেন, মায়েরা তাদের সন্তানদের পূর্ণ দুই বছর মাতৃদুগ্ধ পান করাবে। আর যদি তোমরা সন্তানদেরকে অন্য কোন নারীর দুগ্ধপান করানোর কথা চিন্তা করো, তাতেও কোন ক্ষতি নেই। তবে এ জন্য শর্ত হচ্ছে, তাদেরকে বিনিময় দিতে হবে প্রচলিত পদ্ধতিতে।
মা কোনভাবে অক্ষম হলে তবুও সন্তানকে দুধ পান করানোর জন্য বিকল্প পথ দেখিয়েছে ইসলামে। পবিত্র কোরআনের সাতটা সূরায় আটটা আয়াত এসেছে এই মাতৃদুগ্ধ পানকে কেন্দ্র করে। আবার এই দুধ পান করাকে কেন্দ্র করেই আল্লাহ সন্তানদের প্রতি নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, আমি তো মানুষকে তার পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি। জননী কষ্টের পর কষ্ট বরণ করে সন্তানকে গর্ভে ধারণ করে এবং তার স্তন্যপান ছাড়াতে দু বছর অতিবাহিত হয়। সুতরাং তুমি আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। আমারই নিকট (সকলের) প্রত্যাবর্তন। (লুকমান: ১৫)
শিশুদের জন্য মায়ের বুকের দুধের বিকল্প নাই। এই সত্য আধুনিক বিজ্ঞানও উপলব্ধি করে। তাই তো দুধ পান করার গুরুত্ব তুলে ধরা ও মানুষের মধ্যে ব্রেস্টফিডিংয়ের বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে প্রতি বছর আগস্টের প্রথম সপ্তাহে পালন করে মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ। মাতৃ দুগ্ধপানে সহায়তার ক্ষেত্রে বিশ্বের ৯৮টি দেশের মধ্যে শীর্ষস্থানে বাংলাদেশ। ৯১ দশমিক ৫ স্কোর নিয়ে সবুজ তালিকায় স্থান পেয়েছে।
আল্লাহ তাআলা হজরত মুসা আলাইহিস সালামের জন্মের পর তাঁর মাকে নির্দেশ দেন, আমি মুসার মায়ের অন্তরে ইঙ্গিতে নির্দেশ দিলাম, তাকে দুধ পান করাও। (সুরা কাসাস: ৭) জন্মের পর শিশুর জন্য সর্বোত্তম খাবার হলো মায়ের বুকের দুধ। আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক নবজাতক শিশুর জন্য মায়ের বুকে দুধ সৃষ্টি করে রাখেন। যা হালকা মিষ্টি ও উষ্ণ; যা নবজাতক শিশুর নাজুক অবস্থার জন্য বিশেষ উপযোগী। নবজাতক শিশুকে মায়ের বুকের দুধ পান করানোর প্রতি উদ্বুদ্ধ করতে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, স্তন্যদানকারী ও গর্ভবর্তী নারী থেকে রমজানের রোজা রাখার বাধ্যবাধকতা উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। (আবু দাউদ, তিরমিজি) অন্য একটি হাদীসে তিনি আরো বলেছেন, মায়ের দুধের কোনো বিকল্প নেই। (মুসতাদরক আল ওয়াসায়েল, খণ্ড: ১৫, পৃ: ১৫৬) বর্তমান সময়ে চিকিৎসা বিজ্ঞান শিশুকে মাতৃদুগ্ধের বিষয়ে যে গুরুত্বের কথা বলছে, সে গুরুত্বের কথা ইসলাম আজ থেকে দেড় হাজার বছর পূর্বেই ঘোষণা করেছে।
ইন্টারন্যাশনাল বেবি ফুডস একশন নেটওয়ার্কের (আইবিএফএএন) তথ্য অনুযায়ী, শিশুকে মায়ের দুধ না খাওয়ালে নিউমোনিয়াজনিত মৃত্যুর ঝুঁকি প্রায় ১৫ গুণ, ডায়রিয়ায় মৃত্যুর ঝুঁকি প্রায় ১১ গুণ, শিশুদের অপুষ্টি ও অন্যান্য কারণে মৃত্যুর ঝুঁকি প্রায় ১৪ গুণ এবং জন্ডিস, কানপাকা ও পরিপাকতন্ত্রের সংক্রমণসহ ডায়রিয়ার শঙ্কা বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়া শারীরিক বৃদ্ধি ও বুদ্ধির বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়; বয়সের তুলনায় ওজন অতিরিক্ত বৃদ্ধি পায়; দীর্ঘস্থায়ী রোগের (ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, স্থূলতা) ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।তাই জন্মের পর থেকে দুই বছর বয়স পর্যন্ত শিশুকে মায়ের দুধ দিয়ে যেতে হবে। ছয় মাস পর্যন্ত শুধুই বুকের দুধ এবং তারপর থেকে বুকের দুধের পাশাপাশি পানি ও অন্যান্য খাবার দিতে হবে।
সময়ের সাথে সাথে মানুষ যতো আধুনিক ও শিক্ষিত হচ্ছে তত বেশি ব্রেস্ট ফিডিং বা মাতৃদুগ্ধ পানে আগ্রহী হচ্ছেন। অবশ্য কর্মজীবি মায়েদের আন্তরিক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মাতৃত্বকালীন ছুটি শেষে কাজে ফেরার কারণে সন্তানকে কৃত্রিম খাবার বা বেবিফুড, গরুর দুধ বা পাউডার দুধ খাওয়াতে বাধ্য হন। এটা মোটেও কাম্য নয়। এ সমস্যা সমাধানে কর্মজীবি মায়েদের জন্য প্রায় বন্ধু সম একটি যন্ত্র “ব্রেস্ট পাম্প”। কাজের সময় শিশুকে স্তন্য দান সম্ভব না হলে তারা এই পাম্পের সাহায্যে মতৃদুগ্ধ সংগ্রহ করে তা যথাযথ উপায়ে সংরক্ষণ করতে পারেন। মায়ের অনুপস্থিতিতে পরিবারের অন্য কেউ বোতলের মাধ্যমে শিশুকে সেই দুধ খাওয়াতে পারবেন। ফলে মায়ের অনুপস্থিতিতেও শিশুটি মাতৃদুগ্ধের উপকারিতা থেকে বঞ্চিত হবে না।
কেএল/