মাওলানা মুহাম্মাদ আবু সালেহ।।
চলে গেলেন যশ খ্যাতির মোহহীন, প্রসিদ্ধি ও আত্মপ্রচারণা বিমুখ উলূমে হাদিসের উজ্জ্বল এক নক্ষত্র। নদী বিধৌত জনপদ দক্ষিন বাংলার ইসলামী জ্ঞানের সূতিকাগার বরগুনা জেলাধীন করুনা মোকামিয়া আলিয়া মাদরাসার সাবেক মুহাদ্দিস আলহাজ্ব মাওলানা আব্দুল আজিজ (৮৫} (সুবিদখালী হুজুর নামে সমধিক পরিচিত) আর নেই।
মাওলায়ে কারিমের ডাকে সারা দিয়ে তিনি পথিক হয়েছেন অনন্ত সফরের, যাত্রী হয়েছেন না ফেরার দেশের। হ্যাঁ, সত্যিই, ক্ষণস্থায়ী জিন্দেগীর সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে রফীকে আ'লা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার প্রিয় সান্নিধ্যে চলে গিয়েছেন তিনি। আরশের মালিক আল্লাহ তাআ'লা যেন আমাদের প্রিয় মুহাদ্দিস সাহেব হুজুরকে জান্নাতুল ফেরদাউসের সর্বোচ্চ মাকাম দান করেন।
ঢাকাস্থ শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল শুক্রবার ১২ তারিখ জুমুআর নামাজের ঠিক কিছুক্ষণ আগে ইনতিকাল করেন বরেণ্য এই মুহাদ্দিস। إِنَّا لِلَّٰهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ অর্থাৎ, আমরা তো আল্লাহরই এবং নিশ্চয়ই আমরা তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তনকারী।
উলূমে হাদিসের বিস্তৃত ময়দানে মুহাদ্দিস সাহেব হুজুরের অবাধ পদচারণা সুদীর্ঘ কয়েক যুগের। বুখারী, মুসলিম, আবু দাঊদ, তিরমিযি, নাসাঈ ও ইবনে মাজাসহ হাদিসের অধিকাংশ কিতাবে তাঁর দখল ছিল প্রবাদ প্রতিম।
তাঁর আরেকটি চমৎকার উপাধি ছিল। মোকামিয়া আলিয়া মাদরাসায় তাকে ভূষিত করা হয়েছিল 'ডিকশনারি হুজুর' অভিধায়। তাঁর যাপিত জীবনের ৪১ টি বছরের প্রায় অধিকাংশ সময় তিনি অতিবাহিত করেন হাদিসের খিদমতে।
একজন মুহাদ্দিস হিসেবে শুধু হাদিসের দরসের ভেতরেই তিনি নিজেকে আটকে রাখেননি। হাদিসের গ্রন্থরাজির পাশাপাশি তিনি দরস ও তাদরিসের সাথে যুক্ত থাকতেন সমকালীন তাফসীরের কিতাবগুলোরও।
তাফসীরে জালালাইন, ফি জিলালিল কোরআন, তাফসীরে কুরতুবি, তাফসীরে মাʼরেফুল কোরআন ও তাফহিমুল কোরআনসহ অসংখ্য তাফসীর তিনি পড়তেন ও পড়াতেন। আরবীর সাথে সাথে উর্দু এবং ফারসী ভাষায়ও তাঁর ছিল সমান পারদর্শীতা।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ'লা আপন অনুগ্রহে তাকে অনেক গুণের অধিকারী করেছিলেন। বাহ্যিক অবয়বের দিক থেকে তিনি ছিলেন যেমন অত্যন্ত সুন্দর এবং সুদর্শন চেহারার অধিকারী, ব্যক্তিজীবনেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী এবং সদালাপী। সবসময় কথা বলতেন অত্যন্ত নিচু আওয়াজে। কারও সাথে রাগ করতে বা উঁচু স্বরে কথা বলতে দেখা যেত না তাকে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ'লা তাঁর একেক বান্দাকে দিয়ে একেক ধরণের কাজ করিয়ে নিয়ে থাকেন।
তাঁর ইচ্ছে বুঝার সাধ্যও আমাদের নেই। মুহাদ্দিস সাহেব হুজুরের ক্ষেত্রেও হয়তো তেমনই একটি বিষয় রয়েছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ'লা তাকে হাদিসের দরসের ক্ষেত্রে এত পরিমান ইলমি যোগ্যতা দিয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু তাকে অন্য একটি যোগ্যতা হয়তো কিছুটা কম দিয়েছিলেন বলেই মাঠে ময়দানে, বিশেষ করে সাধারণ মানুষের মাঝে ওয়াজ নসিহত করার ক্ষেত্রে বিনয়ের সাথে অপারগতা প্রকাশ করতেন জ্ঞানের এই বটবৃক্ষ।
ইলমে হাদিসের অতি সূক্ষ্ম বিষয়াদিতে তাঁর ছিল অগাধ পান্ডিত্য। তাঁর হাদিসের দরসগুলোতে মাদরাসার ছাত্রগণই শুধু অংশগ্রহণ করতেন না, বরং ছাত্র শিক্ষক এবং আলেম ওলামা নির্বিশেষে দক্ষিন বাংলার বৃহত্তর অঞ্চলের অনেক মানুষ তাঁর মাধ্যমে উপকৃত হয়েছেন। হাদিসের বড় বড় উস্তাদ এমনকি তাঁর সহকর্মী মুহাদ্দিসীনে কেরামও তাকে অত্যন্ত সম্মান ও সমীহ করতেন এবং হাদিস বিষয়ক যে কোন সমস্যায় তাঁর কাছে ছুটে যেতেন।
তিনি অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে সেসবের সমাধান দিতে কখনও কার্পন্য করতেন না। এত বড় মাপের আলেম ছিলেন তিনি কিন্তু আত্মগরিমা বা আত্ম অহমিকা তাকে স্পর্শ করতে পারতো না। আলোকিত জ্ঞানের পথের এই নিরবচ্ছিন্ন সাধকের ব্যক্তিজীবনও ছিল নিতান্ত সাদাসিধে। আড়ম্বরহীন এবং জৌলুশবিহীন জীবন পছন্দ ছিল তাঁর।
কঠোর পরিশ্রমী সদালাপী এই মানুষটির একান্ত ব্যক্তিগত জীবন কাছে থেকে দেখার সুযোগ যাদের হয়েছে, তারাই জানেন তিনি অধিক পরিমান নফল ইবাদতে মশগুল থাকতে ভালোবাসতেন। বিশেষ করে কুরআনুল কারিমের তিলাওয়াত, রাতের নফল নামাজ অত্যন্ত পাবন্দির সাথে নিয়মিত আদায় করতে খুবই যত্নবান ছিলেন।
সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে বিনীত অনুরােধ, ইলমে হাদিসের খেদমতে তার বিস্তৃত কর্মের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে তাঁর হাতে গড়া শিক্ষার্থী, মুহিব্বীন, অনুগামী এবং গুণগ্রাহীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে সক্রিয় হওয়ার বিকল্প নেই। অদ্য ১৩/৮/২০২২ ইং তারিখ সকাল ৯ ঘটিকায় চতরা ওলামা মঞ্জিল আল আমিন দ্বীনিয়া মাদরাসা মাঠে জানাজা শেষে পটুয়াখালী জেলাধীন মির্জাগঞ্জ উপজেলার সুবিদখালী ইউনিয়নের চতরা গ্রামের নিজ বাড়িতে পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত করা হয়েছে।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার দরবারে বিনীত প্রার্থনা, তিনি যেন মুহাদ্দিস সাহেব হুজুরের জ্ঞাত অজ্ঞাত সকল অপরাধ ক্ষমা করেন এবং জান্নাতে তাকে সুউচ্চ মর্যাদায় আসীন করেন! আমিন!!
-এটি