দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসার বড় মসজিদে ছাত্রদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত শায়খুল ইসলাম আল্লামা হুসাইন আহমদ মাদানী রহিমাহুল্লাহ এর সুযোগ্য কনিষ্ঠ সাহেবজাদা সায়্যিদ আসজদ মাদানী হাফিজাহুল্লাহ এর বয়ানের বাংলা অনুবাদ..
হামদ ও দরুদ শরীফের পর মেহমান বলেন!
প্রিয় ছাত্র ভাইয়েরা! সম্মানিত আসাতিজায়ে কেরাম! মুহতারাম মুকাররম প্রিয় দ্বীনি ভাইয়েরা!
আজ তীব্র রোদের প্রখরতা উপেক্ষা করে ছাত্র ভাইয়েরা যেভাবে আমাকে সারিবদ্ধভাবে আন্তরিকতার সঙ্গে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছেন। তাতে আমার দিল বহুত বড় হয়ে গেছে। আল্লাহ আপনাদেরকে এই ভালোবাসার উত্তম প্রতিদান দান করুন। এবং আল্লাহ আমাদেরকে এখানে যেরূপ একত্রে সমবেত করেছেন। তদ্রূপ জান্নাতেও একত্রিত করুন। আমিন।
আমি ইতোপূর্বে বাংলাদেশে যতোবার এসেছি ততবার আল্লামা আহমদ শফি সাহেব রহ.উপস্থিত ছিলেন। সাথে সাথে ছিলেন। আমাকে সমাদর করতেন। আজ আমি যখন এখানে আসতেছিলাম তখন ভাবলাম যে শফি সাহেব রহ. তো নেই। হুজুররা সবাই নামাজ পড়ে বিশ্রাম নিবেন। আমাকে কে দেখবাল করবে। কে আমার সাথে কথা বলবেন। কিন্তু আপনারা আমার সাথে যে পরিমাণ ভালোবাসা প্রদর্শন করেছেন তা ভুলবার মতো নয়।
সময় অতি সংক্ষিপ্ত। আমাকে এখান থেকে আবার ঢাকা মাদানীনগর আল্লামা ইদরীস রহ.এর মাদ্রাসায় যেতে হবে। তিনিও শায়খুল ইসলাম মাদানী রহ.এর খলীফা। অতএব সংক্ষেপে কিছু আলোচনা করার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।
আমি তো আপনাদের ভাষা জানিনা তবে আমার মনে হয় আপনারা আমার ভাষা বুঝবেন। আমি আসার পর বাংলাদেশের ভেতরে এটিই প্রথম মাদ্রাসা দেখেলাম। যেখানে ছাত্রদেরকে উর্দু ভাষায়ও দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
হে প্রিয় ছাত্র ভাইয়ের! হযরত শায়খুল ইসলাম আল্লামা আহমদ শফী রহ.অনেক বড় যোগ্যবান হাস্তী ছিলেন। তিনি হযরত মাদানী রহ.এর খেদমতে ছিলেন। এবং তাঁর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করছেন। হযরত মাদানি রহ.তাঁকে তরবিয়ত দিয়েছেন। অনেক আগে বাড়িয়েছেন। কাজেই আল্লামা আহমদ শফী রহ. এর ভেতরে হযরত মাদানি রহ এ-র যোগ্যতা ও ফুয়োজাত প্রবেশ করেছে।
আমার বন্ধুরা! হযরত মাদানী রহ. তৎকালীন যুগে তার সমবয়সী আলেমদের মাঝে সবচেয়ে মুমতাজ ছিলেন। কোন বৈশিষ্ট্যের কারণে তিনি মুমতাজ ছিলেন? দু'টি বৈশিষ্ট্যের কারণেই তিনি মমতাজ ছিলেন
এক. তিনি নকশে কদম তথা জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে শতভাগ রাসূল স.)ও তাঁর সাহাবিদের পদাঙ্ক অনুসরণ করার চেষ্টা করেছেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা চব্বিশ ঘণ্টা রাসূলের অনুসরণ করেছেন। এক কদমও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নতের বাইরে উঠাতেন না।
এই একটি বৈশিষ্ট্যের কারণে তিনি সমবয়সীদের মাঝে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ছিলেন। তাঁর অন্যান্য সমবয়সীদের মাঝে-ও এই গুণ ছিল কিন্তু এই পরিমাণ কারও মাঝে ছিল না।
হযরত মেহমান! বলেন, আমি যখন দাওরা পড়িতেছিলাম তখন জুমার গোসল সম্পর্কে রাসূল সা. থেকে তিনটি হাদিস পেয়েছি এক. জুমার পূর্বে গোসল করা। দুই. জুমার দিন যে কোন সময় গোসল করা। তিন. জুমার পূর্বে এমন সময় গোসল করা যাতে করে সেই গোসল দিয়ে জুমার নামাজ আদায় করা যায়।
এখন এই তিনটি মতামতের মধ্যে কোন মতটি সবচেয়ে নৈকট্যপূর্ণ?এই নিয়ে মতবিরোধ দেখা দিলে তৎকালীন যুগের সকল মুফতি ও মুহাদ্দিসরা এ ব্যাপারে ঐক্যমত হোন যে হুসাইন আহমদ মাদানি যেই মতের ওপর আমল করে সেই মতটিই সবচেয়ে নৈকট্য পূর্ণ হবে। অতএব পরে হযরত রহ.কে দেখা গেল যে তিনি যখন শেষ বয়সে গাড়িতে করে জুমায় যেতেন তখন মাঝ পথে লোকেরা তাঁকে দেখতে পেতেন যে অবস্থায় তাঁর দাঁড়ি বেয়ে ওজুর পানি টপকিয়ে টপকিয়ে পড়ত। সুতরাং তিনি জুমার দিন জুমার গোসল দিয়ে জুমার নামাজে শরিক হতেন।
আল্লাহ তাআ'লা বলেন,
قل ان كنتم تحبون الله فاتبعوني يحببكم الله ويغفرلكم ذنوبكم.
যদি তোমরা আল্লাহর ভালোবাসা পেতে চাও তাহলে রাসূ( স.)এর اتباع কর। اطاعت নয়.কারণ এতায়াত তো স্রেফ আদেশ পালনকে বলা হয়। অতএব আল্লাহর ভালোবাসা পেতে হলে রাসূলের এততেবা তথা অনুসরণ করতে হবে অর্থাৎ নিজের জীবনকে এমনভাবে পরিচালনা করতে হবে যেন এক কদম রাসূলের সুন্নতের বাইরে না যায়। তবে রাসূলের ভালোবাসা কুড়িয়ে নিতে পারবে। আর রাসূলের ভালোবাসা অর্জন করতে পারলে আল্লাহ তাআ'লা তোমাদেরকে ভালোবাসবে। এবং আল্লাহ তোমাদের পাপ মোচন করবে। পাপ মোচন করলে কি হবে আল্লাহ আমাদেরকে চিরসুখের জান্নাত দান করবে। এটিই আসল সফলতা।
হে আমার ভাইয়েরা! আল্লামা আহমদ শফী রহ. এত বড় গুণী কিভাবে হয়েছেন। হযরত মাদানি রহ.এর খেদমতে থেকেই হয়েছেন। তাঁরা এত বেশি গুণের অধিকারী ছিলেন যে এখন পর্যন্ত আমরা তাদের থেকে উপকৃত হতেই আছি উপকৃত হতেই আছি। তাঁরা আল্লাহর কাছে এত বড় দামি কিভাবে হলেন একমাত্র এত্তেবায়ে সুন্নতের কারণে। আমরাও তাদের মতো রাসূল সা. ও সাহাবিদের জীবনী অনুসরণ করে চলতে পারলে তাদের মতো মর্যাদাবান হতে পারব। আমি যখন একবার হজে গিয়েছিলাম তখন একজন অনেক লম্বা গঠনের মানুষ আমার কাছে এসে আমার হাঁটুর উপর মাথা রেখে কাঁদতে শুরু করলেন। এমনভাবে কাঁদলেন যে আমার হাঁটু চোখের অশ্রুতে ভিজে যায়। আমি তাঁকে বললাম তুমি কে? তিনি বললেন আমার বাড়ি পাকিস্তান। আমার আব্বু আপনার পিতার ছাত্র ছিলেন। আমার আব্বু আপনার আব্বুর রুমে থাকতেন। আমি আমার আব্বুর কাছ থেকে শুনেছি। আব্বু বলতেন। আমি সাহাবায়ে কেরামের জীবনী পড়ে সাহাবায়ে কেরামদের জেনেছি কিন্তু আমি হযরত মাদানি রহ.কে জীবিত সাহাবিদের নমূনা হিসেবে পেয়েছি। এই জন্য আমি আপনাকে দেখে নিজেকে কন্ট্রোল করতে না পেরে আপনার কাছে কেঁদে ফেললাম।
হে প্রিয় ছাত্র ভাইয়েরা! তোমরা যে উদ্দেশ্যে এখানে এসেছ সেই উদ্দেশ্য অর্জন করতে থাক। হযরত শায়খুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানি রহ. যখন দাওরায়ে হাদিস শেষে যখন হজ্জে গিয়েছিলেন তখনকার একটি ঘটনা স্বয়ং তিনি নিজেই লিখেছেন।
সেই সময় হযরত মাদানি রহ. মাত্র যুবক ছিলেন। এবং হযরত গৌনগুহী রহ. এর কাছে কেবলমাত্র বায়আত গ্রহণ করেছিলেন। তখনকার সময়ে মদিনায় উটের ব্যাবহার ছিলো। আপনারা কি কখনো উটে চড়েছেন? উট দেখেছেন? জি। উট এমনভাবে চলে যে উটের উপর শক্ত ভাবে গেড়ে না বসলে উট থেকে পড়ে যায়।
হযরত মাদানি রহ. স্বয়ং নিজে বলতেছে যে আমি যখন উটে চড়ে আবেক যাচ্ছিলাম তখন মাঝ পথে আমার ঝিমুনি এসে যায় ফলে আমি উটের উপরেই ঘুমিয়ে পড়ি। আমি হঠাৎ স্বপ্নে দেখেছি যে বিশ্ব নবী সা. আমার কাছে এসেছেন। আমি তাঁকে দেখা মাত্রই হযরত সা.এর পায়ে লুটিয়ে পড়লাম। তখন হুজুর স. আমাকে বললেন, তুমি কি চাও বলো। তখন আমরা হলে চাইতাম অট্টালিকা, দুনিয়ার কল্যাণ, জান্নাত ربنا آتنا في الدنيا حسنة وفي الاخرة حسنة وقنا عذاب النارالنار এটা চাইতাম। কিন্তু হযরত মাদানি রহ. এগুলো থেকে একটাও চাননি। তিনি চেয়েছেন , ميں جو كتابيں پڑهي هوئي هيں وه ياد هو جاے اور جو كتابيں نه پڑهيں هوں وه مطالعه كا فرصت ملے اور اسكو سمجهنے كا استعداد حاصل هوں. তখন রাসুলুল্লাহ সাঃ বললেন, جاؤ ميں نے تجهكو ديا. যাও আমি তোমাকে দিলাম। সুবহানাল্লাহ। এলমের প্রতি কি পরিমাণ অনুরাগ থাকলে এক অনন্য সুযোগের সময় দুনিয়া আখিরাতের কিছু না চেয়ে এলমের কথা বলতে পারেন।
আপনারা সকলেই জানেন। হযরত আদম আলাইহিসসালামকে কি কারণে সকল ফেরেস্তাদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছিলেন। ইলমের কারণেই শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছিলেন। আল্লাহ তাআ'লা কুরআনে কারিমে রাসুলুল্লাহ সাঃ কে বলেছেন, رب زدني علما رب اشرح لي صدري ويسرلي امري واحلل عقدة من لساني يفقهوا قولي. অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা রাসুলুল্লাহ সাঃ কে জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য দোয়া শিখিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা রাসুলুল্লাহ সাঃ কে সমগ্র মানুষকে যে পরিমাণ ইলম দেয়া হয়েছে বিশ্ব নবী সাঃকে একা সে পরিমাণ এলম দিয়েছিলেন। নবী স. নিজেই বলেন, اوتيت علم الاولين والاخرين
আমাকে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী যুগের সকল ইলম দান করেছেন যে নবীকে সমগ্র পৃথিবীর জ্ঞান দেয়া হয়েছে তাঁকে পর্যন্ত জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য দোয়া করতে বলেছেন। আর আমাদের অবস্থা তো এমন সার্টিফিকেট পেলে- পাগড়ি পেলে নিজেকে মনে করি অনেক বড় আলেম।সবাই নিজেকে মনে করে অনেক বড় মুহাদ্দিস অনেক বড় মুফাসসির অনেক বড় শায়খুলহাদিস অনেক বড় মুফতি। যদি কাউকে ১৫ টি মাদ্রাসায় হাদিস পড়াতে বলে সে পনেরটি মাদ্রাসার শায়খুল হাদিস হওয়ার জন্য পাগলপারা হয়ে যাবে। কিন্তু আমাদের আকাবিরদের অবস্থা কেমন ছিল দেখেন। হযরত মাদানি রহ.এর শাগরেদ আব্দুল্লাহ রহ. যিনি বুখারী শরীফ ও তিরমিজি শরীফের হাফেজ ছিলেন। অথচ তিনি তা কাওকে জানান দেয়নি। আপনারা কি একথা আহমদ শফি রহ.এর কাছে শুনেছেন? না। আল্লাহ আমাদেরকে তাদের মতো কবুল করুন।
দুই. হযরত মাদানি রহ. যেকারণে মমতাজ ছিলেন। হযরত মাদানি রহ. খেদমতে খলকুল্লাহ তথা মাখলুকের সেবা করতেন। তিনি ট্রেনে কোন বিধর্মী কাফের মুসলমান যে কাউকে দেখতেন তার সেবা করা শুরু করে দিতেন। কেউ ট্রেনে বাথরুম অপরিষ্কার রেখে চলে এলেও হযরত রহ. অগোচরে তা পরিস্কার করে চলে আসতেন। কেউ অসুস্থ হতেন তো হযরত রহ. তার সেবা শুশ্রূষা করতেন।
এই কারণে আল্লাহ তাআলা হযরত রহ.কে ভালোবেসেছেন। তোমরা দশ হাজার ছাত্র আছো এখান থেকে কেউ যদি মুহতামিম সাহেব হুজুরের ছেলের সেবা কর তাহলে হযরত মুহতামিম সাহেব সেই ছাত্রকে সবচেয়ে বেশী ভালোবাসবেন এবং তাকে সবচেয়ে বেশি চিনবেন। অথচ তার ছেলেকে জন্ম দেয়ার ক্ষেত্রে তার কোন ক্ষমতা ছিল না। এভাবে আল্লাহর সৃষ্টির যদি তুমি সেবা কর তাহলে আল্লাহ তোমাকে ভালোবাসার পাত্র বানিয়ে নিবেন। আল্লাহ আমাদেরকে তাদের মতো জীবন গড়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
অনুলিখন: মো: আবু জর
-কেএল