বৃহস্পতিবার (৯ জুন) বিকেল ৩টায় টানা চতুর্থবারের মতো সংসদে বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী। করোনার ধাক্কা সামলে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় ফেরার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করা হবে। ২০২১-২২ অর্থবছরে বাজেট বরাদ্দ ছিল ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। সেই হিসাবে ২০২২-২৩ নতুন বাজেটের আকার বাড়ছে ৭৪ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা। সামনের অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়ন করতে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৬ হাজার ২৭১ কোটি টাকা। ফলে ঘাটতি বাজেট (অনুদানসহ) হবে ২ লাখ ৪১ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭.৫ শতাংশ। আর দেশে সব পণ্যের দাম বাড়ায় আগামী অর্থবছরের জন্য মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য কিছুটা বাড়িয়ে ৫.৬ শতাংশ করা হয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ হবে। বাংলাদেশ অনেকটাই আমদানিনির্ভর দেশ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আমদানি ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। রপ্তানিপণ্যের কাঁচামালসহ নিত্যপণ্যের বড় আমদানি করা হয় প্রতিবছর। ফলে একদিকে যেমন বাড়ছে মূল্যস্ফীতির চাপ, অন্যদিকে নিত্যপণ্যের দামে লাগাম টানা যাচ্ছে না।
এদিকে তরুণ আলেমদের বাজেট ভাবনা ও প্রত্যাশা জানার চেষ্টা করেছেন আওয়ার ইসলাম নির্বাহী সম্পাদক আব্দুল্লাহ তামিম।
বাজেট কেমন হওয়া উচিত এ বিষয়ে কথা বলেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, ড. মুফতি হুমায়ুন কবির।
তিনি বলেছেন, ‘প্রতিটি রাষ্ট্রে প্রতি বছর বাজেট নির্ধারণ করা হয়। যা ইসলামে অনুমোদিত। কেননা, মহান আল্লাহ পৃথিবী সৃষ্টির শুরুতে আন্তর্জাতিক বাজেট নির্ধারণ করে রেখেছেন।
আল্লাহ তায়ালা সর্ব প্রথম তার সৃষ্টির মাঝে কলমকে সৃষ্টি করেছেন। কলম সৃষ্টি করার পর তিনি তাকে কিয়ামত পর্যন্ত যা হবে এর বিবরণ বা পুরো পৃথিবীর বাজেট লিপিবদ্ধ করার নির্দেশ প্রদান করলেন। তখন কলম সবকিছু মহান আল্লাহর নির্দেশে লিপিবদ্ধ করেছিল। যা আদি-অন্তিম বাজেট ছিল।
তেমনি সেখান থেকে নিয়ে প্রতি প্রাণির জন্মের শুরুতে ফেরেশতা সারা জীবনের বাজেট লিপিবদ্ধ করেন। হাদিসে এসেছে মায়ের জরায়ুতে যখন বীর্য প্রবেশ করে তা চল্লিশ দিন অতিক্রম হওয়ার পর জমাট বাধা রক্তে পরিণত হয় অতঃপর ৮০ দিন হওয়ার পর মাংসপিণ্ড হয় একশ বিশ দিন হওয়ার পর পূর্ণ আকৃতি লাভ করে তখন ফেরেশতা রূহ নিয়ে আসে আর চারটি বাজেট লিপিবদ্ধ করে।
তার বয়স, তার রিজিক, আমল ও নেককার বা বদকার লিপিবদ্ধ করে থাকে। তেমনি প্রতি বছর শবে বরাতে বার্ষিক বাজেট লিপিবদ্ধ করা আরম্ভ করে ও শবে কদরে তা দায়িত্ববান ফেরেশতার হাতে হস্তান্তর করা হয়। এভাবে মহান রাব্বুল আলমীন বাজেটের কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকেন। তাই বাজেট তৈরী করা ও পরিকল্পনা করা ইসলামে সমর্থিত।
তবে ইসলাম মানুষের জন্য অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের ব্যবস্থাকে ফরয করেছেন। তেমনি বর্তমানে শিক্ষা ও চিকিৎসাও মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্তর্ভুক্ত। তাই বাজেটে এ পাঁচটি বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া জরুরি।
যে জাতি যত শিক্ষিত সে জাতি তত উন্নত। তাই শিক্ষা খাতে বাজেটে বরাদ্ধ বেশি থাকা প্রয়োজন। বর্তমানে দ্বীনি শিক্ষা অবহেলিত। যার কারণে মানুষ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত। যা থেকে উত্তরণ করতে হলে দ্বীনি শিক্ষা খাতেও বাজেটের বরাদ্ধ থাকা সমীচিন।
ইসলামের আলোকে বাজেট কেমন হওয়া চাই?
এদিকে রাজধানীর জামিয়া কারিমিয়া আরাবিয়া রামপুরা মাদরাসার শিক্ষক ও ও সার্টিফেকেট কোর্স ইন ইসলামিক ইকনোমিক এন্ড ফাইন্যান্স (সিআইইএফ) সার্টিফাইড- এর মুফতি আবুল ফাতাহ কাসেমি বলেছেন, ইসলামের আলোকে বাজেট না বলে আদর্শ বাজেট বললে প্রশ্নটা আরো অর্থবহ হবে। তাই আমরা আদর্শ বাজেটের পরিচয় জানবো। আইনানুগ পন্থায় একটি দেশের সরকার আয় ও ব্যয়ের বাৎসরিক যে সীমা নির্ধারণ করে তাকে আদর্শ বাজেট বলে। যাতে জনগনের আশা আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটবে। একটি আদর্শ বাজেট বলতে আমরা তাই বুঝি। সে হিসেবে বাজেট সরকারের কাছে জনগনের আমানত। আমানতে যেভাবে খেয়ানত করা নিষেধ ঠিক তেমনি বাজেটে খেয়ানত করাও ইসলামে নিষেধ। খেয়ানত কিভাবে হয় তা অবশ্য ব্যাখ্যা সাপেক্ষ বিষয়।
ইসলাম একটি স্বভাবজাত ধর্ম হিসেবে ইসলামে বাজেটের গুরুত্ব অনেক। আমানতের জায়গা থেকে বাজেটে প্রত্যেক জনগনের হক নিশ্চিত করতে পারলেই তা আদর্শ বাজেট হতে পারে। আর আদর্শ বাজেটই ইসলাম প্রত্যাশা করে।
একটি বাজেট কিভাবে আদর্শ বাজেট বা আমানাহর মানদণ্ড উত্তীর্ণ হতে পারে?
ইসলামের আলোকে বাজেটে খাতভিত্তিক প্রাধান্য দেয়া ইসলামের ঐতিহাসিক নীতি।
এক্ষেত্রে ফিকহুল আওলায়িয়্যাহ (আল আকদাম ফাল আকদাম) বা প্রাধান্য দেয়া নীতির আলোকে জনগুরুত্বপূর্ণ খাতগুলো যেমন দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো খাতগুলোর জন্য অতিরিক্ত তহবিল ও অন্যান্য সুবিধা বরাদ্দ দিতে হবে। তবে প্রণিধানযোগ্য খাত শনাক্ত করার ক্ষেত্রে ফিক্বহুল আওলাউয়্যাহ নীতির পাশাপাশি ইসলাম আরো তিনটি মৌলিক নীতি প্রস্তাব করে। সেগুলো হচ্ছেÑ এক. জরুরিয়্যাত বা অতি গুরুত্বপূর্ণ। দুই. হাজিয়্যাত বা গুরুত্বপূর্ণ।
তিন. এবং তাহসিনিয়্যাত বা পরিপূরক। বাজেট প্রণয়নে জরুরিয়্যাত নীতি মূলত অগ্রাধিকার উপযোগী খাতগুলো শনাক্তকরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।
যেসব খাত মূলত রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা, মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস, জীবন ও সম্পদ রক্ষা এবং দেশের জন্য উন্নত গুণাবলিসম্পন্ন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তৈরির ক্ষেত্রে অপরিহার্য সেসব খাতকে জরুরিয়্যাতের ভিত্তিতে সবার আগে বরাদ্দের আওতায় নিয়ে আসা উচিৎ।
পরবর্তী সময়ে যেসব খাত সার্বিকভাবে প্রয়োজনীয় কিন্তু উল্লিখিত খাতগুলোর চেয়ে তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ সেসব খাতকে হাজিয়্যাত নীতির অধীনে অন্তর্ভুক্ত করা এবং যেসব খাত গুরুত্ব বিবেচনায় উল্লিখিত দুটির কোনোটিরই সমপর্যায়ের নয় বরং কিছুটা বিলাসিতাকেন্দ্রিক সেসব খাতকে তৃতীয় তথা তাহসিনিয়্যাত নীতির অধীনে রেখে বাজেট প্রণয়ন করলে তা আমানতের মানদণ্ড উত্তীর্ণ হতে পারে।
একটি মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে দেশের বাজেটে কোন খাতে বেশি বরাদ্দ দেয়া উচিত?
দেখুন আমানতের বিষয়টি মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে না দেখে একটি আদর্শ রাষ্ট্র হিসেব বলতে পারেন। কারণ ইসলামই উত্তম আদর্শ নিশ্চিত করতে পারে।
তাই আদর্শ ও ইসলাম বলতে গেলে একই। দেশের যে খাতে সবচেয়ে বেশি মানুষ জড়িত সে খাতে বেশি বরাদ্দ দিতে হবে। আমাদের দেশে বর্তমানে চিকিৎসা ও শিক্ষা খাতে বেশি বরাদ্দ দরকার। নীতি নৈতিকতা সম্পন্ন জাতি গঠনে এ খাতে বরাদ্দ দেয়ার বিকল্প নেই। দেশের বেকার শিক্ষিত অশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর দিক বিবেচনায় কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে জোর দেয়া উচিত।
এ ক্ষেত্রে খেলাধুলার মত পরিপুরক খাতে নামমাত্র বরাদ্দ দিয়ে সরকারি বেসরকারি সব ধরণের শিক্ষা খাতে যথেষ্ট বরাদ্দ দিয়ে শিক্ষা খাতকে শক্তিশালি করতে পারে।
বেসরকারি শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দেয়ার রূপ কি হতে পারে?
বেসরকারি শিক্ষাখাতের ব্যাপক আলোচনা না করে আমি কেবল বেসরকারি কওমি শিক্ষার কথা বলি। সরকার দেশের লক্ষ লক্ষ কওমি মাদরাসার গ্রাজুয়েট শিক্ষার্থীদের উন্নত প্রশিক্ষণ, সঠিক ব্যবস্থাপনা ও কার্যকরী পদক্ষেপ নিয়ে বিদেশে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের বিপুল ব্যবস্থা করতে পারে। বেসরকারি এ খাতটিকে ছোট করে দেখার কোন সুযোগ নেই। বাজেটেই এ খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ দিয়ে সরকার বছরে প্রচুর রেমিটেন্স আয় করতে পারে।
এনটি