সাম্প্রতিককালে কওমি শিক্ষার্থীদের মাঝে মূল কিতাবের বাইরে গাইড নির্ভরতা বেড়েছে বলে অভিযোগ সামনে এসেছে। গত বছর বেফাকের অধীনে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় পরীক্ষার সময় বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয়।
গাইডের ধরনের বাইরে থেকে প্রশ্ন আসায় কিছু শিক্ষার্থীর অস্বত্বিতে পড়েন বলে একটা কথা সামনে আসে। এরপর শিক্ষাবিদদের পক্ষ থেকে কওমি অঙ্গনের ভবিষ্যত নিয়ে আশঙ্কার কথা জানানো হয়। এ বছর যখন নতুন একটি শিক্ষাবর্ষ শুরু হল, তখন শিক্ষার্থীদের গাইড থেকে ফিরিয়ে যোগ্য করে তুলতে কি ভাবছে বোর্ড ও আলেম শিক্ষাবিদেরা – তা জানার চেষ্টা করেছেন আওয়ার ইসলামের প্রতিবেদক নুরুদ্দীন তাসলিম।
শিক্ষাবিদদের মতামত:
উম্মুল মাদারিস খ্যাত চট্টগ্রামের দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসার মুহাদ্দিস মাওলানা আশরাফ আলী নিজামপুরী আওয়ার ইসলামকে বলেছেন, ‘গত এক যুগ ধরে আমরা শিক্ষার্থীদের গাইড নির্ভরতার বিষয়টি নিয়ে শঙ্কিত ছিলাম। এ নিয়ে শিক্ষার্থীদের সচেতন করে আসছি আরো আগে থেকে’।
‘সরকারি মাদরাসাগুলোতে পড়াশোনা করে প্রকৃত আলেম বের হচ্ছে না গাইড নির্ভর পড়াশোনার কারণে। ইদানীং কওমি মাদারাগুলোতেও গাইড নির্ভর পড়াশোনার মহামারী দেখা যাচ্ছে। এতে করে মুল যোগ্যতা আর তৈরি হচ্ছে না’। তাই আমাদের পরামর্শ থাকবে সর্বোচ্চ বোর্ড হাইয়াতুল উলিইয়া, বেফাকসহ দায়িত্বশীলগণ এ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে ‘ ’-বলেন তিনি।
শিক্ষকদের দায়িত্ববোধের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে এই শিক্ষাবিদ বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা নিজের শিক্ষক থেকে সবকিছু শেখার চেষ্টা করে এবং শিক্ষককেই অনুসরণ করে, তাই এ ক্ষেত্রে আমাদের দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে, তবেই শিক্ষার্থীরা সঠিক পথ খুঁজে পাবে’।
নারায়ণগঞ্জের জামিয়া রাব্বানীয়া আরাবিয়ার নাজেমে তালিমাত, মাওলানা জাহিদুল ইসলাম বলেছেন, ‘প্রকৃত যোগ্যতা অর্জন করতে শিক্ষার্থীদের কিতাবভিত্তিক পড়াশোনার কোন বিকল্প নেই। গাইড নির্ভর পড়াশোনায় রেজাল্ট ভালো হলেও যোগ্যতা অর্জন হয় না’।
তিনি বলেন, ‘জামিয়া রাব্বানিয়ার শিক্ষার্থীরা বরাবরই বোর্ডে ভাল রেজাল্ট করে, কিন্তু আমরা কখনোই শিক্ষার্থীদের গাইড ও বাংলা নোট দেখে পড়তে উৎসাহিত করি না’।
‘আমাদের উস্তাদরা নিজেদের পুরো সময়টা ছাত্রদের পেছনে ব্যয় করেন। বোর্ড ও বোর্ডের বাইরের প্রত্যেক জামাতের পুরো কিতাবের নেসাব শেষ করি আমরা’।
‘কোন কিতাব কিভাবে পড়ালে ছাত্রদের উপকার হবে এনিয়েও আমরা প্রতি সপ্তাহে তালিমী মুজাকারা করি’ বলেন এই শিক্ষাবিদ।
‘এজন্য বাংলাদেশের কওমি মাদারাসার দায়িত্বশীলদের প্রতি আহ্বান থাকবে তারা যেন শিক্ষার্থীদের কিতাব নির্ভর করার পুরোপুরি চেষ্টা করেন। এবং বোর্ডের প্রতি অনুরোধ থাকবে তারা যেন এমনভাবেই প্রশ্ন করেন যাতে শুধু যোগ্য ছাত্ররাই সঠিক উত্তর দিতে পারে, এতে করে শিক্ষার্থীদের মাঝে সচেতনতা বাড়বে’ বলে মনে করেন মাওলানা জাহিদুল ইসলাম।
বোর্ডের ভাবনা:
বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক মাওলানা যুবায়ের আহমাদ বলেছেন, ‘প্রশ্নপত্র যেন গাইডের ধরনের বাইরে থেকে করা হয় এ বিষয়ে বোর্ডের সভাপতি আমাদের শুরু থেকেই বলে এসেছেন। গত পরীক্ষায় বিষয়টি লক্ষ্য রাখা হয়েছে। এত করে কিছু শিক্ষার্থীর হয়তো কষ্ট হয়েছে, কিন্তু সার্বিকভাবে বিষয়টি প্রশংসিত হয়েছে’।
‘ছাত্রদের মাঝেও এই অনুভুতি এসেছে যে গাইড থেকে বেরিয়ে এসে মিল কিতাবের সঙ্গে মুনাসাবাত তৈরি করতে হবে’ বলেন বেফাকের মহাপরিচালক।
তিনি বলেন, ‘সমস্যা এমন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল যে অনেক শিক্ষার্থী মুল কিতাব বন্ধ করে গাইড নিয়েই পড়ে থাকতো। প্রশ্নের ধরনে পরিবর্তন আনায় এবার শিক্ষার্থীরা অবশ্যই এটা নিয়ে ভাববে’ মনে করেন তিনি।
‘প্রতিবার পরীক্ষা শেষে পরীক্ষা বিষয়ক উপ-কমিটির একটি পর্যবেক্ষণ মিটিং অনুষ্ঠিত হয়। অল্প কিছুদিন পরই আমাদের এবারের উপ-কমিটির মিটিং অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে এই বিষয়গুলো আরো কিভাবে জোরদার করা যায় তা নিয়ে আলোচনা হবে’-মাওলানা যুবায়ের আহমাদ।
তিনি আরো বলেছেন, ‘সামনে শিক্ষার্থীদের গাইড বিমুখ করতে আরো বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হবে, তাই কিতাবের সঙ্গে মুনাসাবাত ছাড়া শিক্ষার্থীদের সামনে আর কোন পথ খোলা নেই’।
এদিকে সিলেট আযাদ দ্বীনী এদারায়ে তালীম বাংলাদেশের মহাসচিব ও হাইয়াতুল উলইয়ার সদস্য মাওলানা আব্দুল বছীর বলেছেন, ‘নোট ও গাইড শুধুমাত্র পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করার মাধ্যম। এর মাধ্যমে কিতাবের সঙ্গে মুনাসাবাদ তৈরি হয় না শিক্ষার্থীদের’।
‘‘হাইয়ার মিটিং-এ আলোচনা হয়েছে; প্রশ্ন করার সময় যেন এমনভাবেই প্রশ্ন করা হয় যে এর উত্তর শুধু সেই শিক্ষার্থীরাই দিতে পারবে যারা কিতাব দেখে পড়াশোনা করে। গতবারের প্রশ্নে এমনটাই হয়েছে, এটাই শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত জীবনকে উজ্জ্বল করে এবং আমরা বরাবরই এ বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে আসছি’ বলেন মাওলানা আব্দুল বছীর।